বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি মহানায়ক উত্তম কুমার অনন্য অভিনয় জাদুতে মুগ্ধতা বিলিয়েছেন দুর্নিবার। তার অভিনীত ছবি মানেই ভালোলাগার এক বিশাল প্রাপ্তি। পর্দায় এ নায়ক যেমন উজ্জ্বল তেমনই তার ব্যক্তিজীবনের চলাচলেও ছিল নানান রঙের মিশেল। সেই অজানা জীবনের গল্প তার বয়ান থেকে অনুলিখন করেছেন প্রখ্যাত সাংবাদিক-সাহিত্যিক গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষ যা পরবর্তী সময়ে ‘আমার আমি’ নামে বই আকারে প্রকাশ হয়। সে বই থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে উত্তম কুমারের আত্মজীবনী-
আমি ইন্দ্রপুরীতে ‘কামনা’র শুটিং করছি এক ফ্লোরে, অন্য ফ্লোরে ‘দেবী চৌধুরানী’র শুটিং করছিলেন শেথলদা অর্থাৎ প্রদীপকুমার। আমি তখন সম্পূর্ণ নতুন। শেতলদা তখন পুরনো।
আমি একদিন আমার ফ্লোর থেকে বেরিয়ে পাশের ফ্লোরে গেছি।
সহজ সরল মন আর একরাশ কৌতূহল নিয়ে গেছি। আমি নতুন গেছি পুরাতনের কাচ দেখতে। সামনে দেখি শেতলদা। এই শেতলদার সঙ্গে দু-একবার অ্যামেচার থিয়েটার করেছিলাম। সেই সূত্রে বললাম, শেতলদা কেমন আছেন?
তিনি উত্তর দিলেন না। বার বার জিজ্ঞাসা করার পর তিনি বললেন, তোমাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না, সেই মুহূর্তে লজ্জায় অপমানে আমি যেন মরমে মরে গেলাম। ফিরে এলাম সেটে। আমাকে গম্ভীর দেখে ছবিদি বার বার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। আমি বললাম।
ছবিদি সেদিন আমাকে সান্ত¡না দিয়েছিলেন। বলেছিলেনÑএতে দুঃখ পেতে নেই। কিছু কিছু মানুষ আছে তারা আঘাত করে। কিছু কিছু মানুষ আছে একটু বড় হলে, নাম করলে, পয়সা হলে অতীত ভুলে যায়। আপনজনদেরও চিনতে পারে না। তুমি বড় হলে যদি আমাদের ভুলে না যাও তাই দেখো। আমি কাউকে ভুলিনি আজও। যা হোক, এই ছবি রিলিজ হওয়ার আগেই ‘মর্যাদা’ ছবিতে কাজ করার সুযোগ এল। তবুও মন শান্ত হয় না।
আমি যেন তৃপ্ত হতে পারি না কিছুতেই।
১৯৫০ সালের গোড়ার দিকের একদিন সকালের ঘটনা।
অবসন্ন মন নিয়ে সেদিন আমি বাড়িতেই আছি। একলা ঘরে সেদিন কী যেন একটা বই পড়ছি। এমন সময় বুড়ো অর্থাৎ আমার ভাই তরুণ এল। তারপর সরাসরি আমার কাছে দাঁড়াল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কী রে, আমাকে কিছু বলবি?
Ñদাদা, তুই একবার নিচে যা, রাজেনবাবু বসে আছেন, তোকে ডাকছেন।
বলল বুড়ো।
Ñতুই যা বল গিয়ে আমি আসছি। তাচ্ছিল্যভরেই কথাটা বললাম। রাজেনবাবু আমাকে ডাকছেন এই খবরটা তখন আমাকে উৎসাহিত করতে পারেনি। নিতান্ত অনিচ্ছাভরেই আমি নিচে নেমে এলাম। বৈঠকখানা ঘরে বসেছিলেন রাজেনবাবু, আমাদের আরামকেদারায় গা এলিয়ে দিয়ে।
রাজেনবাবু শুধু আমার বাবার বন্ধু নন, ছবির একজন পরিচালকও বটে। বৈঠকখানায় ঢুকেই আমি নমস্কার করলাম।
রাজেনবাবু হাসতে হাসতে বললেন, কেমন আছ?
ইতিমধ্যে আমি অনেকটা সহজ হয়েছি। নিজেকে অনেকটা মানিয়ে নিয়েছি। সহজভাবে বললাম, ভালোই আছি।
আমি বিশেষ আগ্রহ নিয়ে ওঁর পাশে বসলাম।
রাজেনবাবু বলরেন, ‘ওরে যাত্রী’ নামে একটি ছবি করছি, সেই ছবির ব্যাপারেই এসেছি, তুমি একটা রোলে কাজ করবে?
আমি ভিতরে ভিতরে ভীষণ খুশি হলাম। হাসলাম। অত্যন্ত উৎফুল্ল হয়েই বললাম, নিশ্চয়ই করব, চান্স দেবেন আমাকে?
রাজেনবাবু কথা দিলেন। আমাকে দেখা করতে বলে চলে গেলেন সেদিন। নতুন ছবির সুযোগ পাবার প্রতিশ্রুতি পেয়ে আমি একদিকে যেমন উচ্ছ্বসিত, অন্যদিকে তেমনি অনেকদিন গৌরীকে না দেখার চাপা বেদনায় কাতর। বারবার মনে হতে লাগল, এই সময় তাকে যদি কাছে পেতাম বেশ হতো। কিন্তু উপায় নেই। মনের দুঃখ মনে চেপে নির্দিষ্ট দিনে ও নির্ধারিত সময়ে মা-বাবাকে প্রণাম করে হাজির হলাম স্টুডিওতে।
ভবানীপুর পূর্ণ থিয়েটারের সামনে থেকে ট্রাম ধরে সোজা চলে এলাম টালিগঞ্জ ট্রাম ডিপোতে। বাঁদিকে বাঁক নিলেই ইন্দ্রপুরী স্টুডিও। আমি সরাসরি ঢুকে গেলাম ইন্দ্রপুরীতে। আমি স্টুডিওতে ঢুকতেই স্বয়ং রাজেন চৌধুরী আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে এলেন ভুতনাথবাবুর কাছে। ভূতনাথবাবুই ছিলেন ‘ওরে যাত্রী’ ছবির প্রযোজক। তিনি আমাকে কাছে ডেকে দু’চারটে কথা বললেন। কাকে ডেকে যেন বললেন, ওকে মেক-আপ রুমে নিয়ে যাওÑ
আমাকে কী মেক-আপ নিতে হবে তাও বলে দিলেন রাজেনবাবু। তারপর একটি লোক আমাকে মেক-আপ রুমের দিকে নিয়ে যেতে এল। আমি তাকে অনুসরণ করলাম। এলাম মেক-আপ রুমে। অনেকক্ষণ আমাকে বসে থাকতে হলো। চুপচাপ ঠায় মুখে হাত দিয়ে বসে রইলাম। সবাই ব্যস্ত। প্রত্যেকের কাছে প্রত্যেকে কত আপন। সবাই সবার সুখ-সুবিধে দেখছে। কিন্তু আমার খবর নিচ্ছে না কেউ। কেউ কেউ যেন একটা অদ্ভুত জীব দেখার মতো আমাকে দেখে চলে যাচ্ছে। আমাকে আমল দিচ্ছে না কেউ। আমি শুধু নীরবে বসে আছি।
অনেকক্ষণ এই রকম এক অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে আমাকে কাটাতে হলো। যখন রীতিমতো হাঁপিয়ে উঠেছি তখন আমার ডাক পড়ল মেক-আপ নেবার। মেক-আপ নিলাম। দেখতে দেখতে আমি পুরোদস্তুর একজন ডাক্তার বনে গেলাম। আমাকে ডাক্তার সাজিয়ে দেওয়া হলো। গলায় স্টেথোসকোপ ঝুলিয়ে আমি মেক-আপ রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। এলাম স্টুডিও-ফ্লোরে।