বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি মহানায়ক উত্তম কুমার অনন্য অভিনয় জাদুতে মুগ্ধতা বিলিয়েছেন দুর্নিবার। তার অভিনীত ছবি মানেই ভালোলাগার এক বিশাল প্রাপ্তি। পর্দায় এ নায়ক যেমন উজ্জ্বল তেমনই তার ব্যক্তিজীবনের চলাচলেও ছিল নানান রঙের মিশেল। সেই অজানা জীবনের গল্প তার বয়ান থেকে অনুলিখন করেছেন প্রখ্যাত সাংবাদিক-সাহিত্যিক গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষ যা পরবর্তী সময়ে ‘আমার আমি’ নামে বই আকারে প্রকাশ হয়। সে বই থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে উত্তম কুমারের আত্মজীবনী-পরদিন যথাসময়ে আবার ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে হাজির হলাম। বুকভরা একরাশ আশা। মনের জোর সম্বল করে আবার স্টুডিওর আঙিনায় এসে দাঁড়ালাম। মনে মনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলাম যে, কারও কোনো বিরূপ মন্তব্যে কান দেব না, বিচলিত হব না।
আশ্চর্য! এই দিনেও তারা থামলেন না।
হঠাৎ কে যেন বলে উঠলেন, হিয়ার কামস নিউ দুর্গাদাসÑ
আবার কেউ কেউ বললেন, দুর্গাদাস! না না, তার চাইতে বল ছবি বিশ্বাস।
ও ছবির মতোই হবে একদিন দেখে বুঝতে পারছ না?
এমনি ধরনের কত শ্লেষ-উক্তিতে আমার নতুন স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা মনটা যে ভেতরে ভেতরে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে তা তারা বুঝতেও পারছিল না।
তবুও আমি নীরব ছিলাম।
আমার হঠাৎ কেমন যেন মনে হলো যে, এই সব বাজে লোকদের কাছ থেকে দূরে সরে থাকা দরকার। তবে ওদের হাতে রাখতে পারলে ওদের মুখ আপনা থেকে বন্ধ হয়ে যাবে। মনে হলো, প্রতিষ্ঠা পেতে হলে নিদেন এই জগতে টিকে থাকতে হলে প্রথমেই এই বিষাক্ত বীজের মুল উৎপাটন প্রয়োজন। কারও ভালো করার ক্ষমতা এদের নেই, মন্দ করতেই শুধু এদের জন্ম।
ভাবলাম, কী করে ওদের হাত করা যায়! মিষ্টি ব্যবহারে, না চা আর সিগারেটে! আমি অবশেষে ওদের চা-সিগারেট খাওয়াতে শুরু করলাম। অবাঞ্ছিতের দল অবশেষে আমার কব্জার মধ্যে এল।
সেই ছবিতে কাজও করলাম আমার সমস্ত ক্ষমতা উজাড় করে দিয়ে।
ছবি শেষ হলো। এই ছবিতে আমি আশাতীত পারিশ্রমিক পেলাম। ভুতনাথবাবু আমার কাজের মর্যাদা দিলেন।
সর্বসাকুল্যে পেলাম আমি সম্ভবত সাতশো টাকা।
এই ছবি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৫১ সালে।
এ সব ঘটনার আগে আরও দুটো বছর আমি পেছনে রেখে এগিয়ে এসেছি। দুর্বিসহ যন্ত্রণায় ভরা সেই দুটো বছর।
এই বছর দুটো আমাকে যেমন কাঁদিয়েছে অন্যদিকে তেমনি সাহসও জুগিয়েছে অনেক। বাঁচার পথ দেখিয়েছে। একদিকে নিরাশার অন্ধকার গহ্বরে আমাকে যেমন নিক্ষেপ করেছে, অন্যদিকে আশার চরমতম সোপানে পৌঁছে দিয়েছে। আমার মনে হয়েছিল গৌরীকে আশা করা অন্যায়। তাই তাকে আমি ভোলবার চেষ্টা করে চলছিলাম একদিকে, অন্যদিকে ভোলবার চেষ্টা করেও পারছিলাম না বলে নিজের মনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম।
এমন সময় একদিন গৌরীই আমার গোটা জীবনের রং যেন পালটে দিল। আমি তখন একদিকে ‘ওরে যাত্রী’ ছবিতে কাজ করে চলেছি, অন্যদিকে দশটা-পাঁচটার কেরানি-জীবনের মধ্যে থেকে নিজেকে ভুলিয়ে রেখেছি। গতানুগতিক জীবনযাত্রা।
নিজেকে পূর্ণ প্রকাশের আগে যেন অনেকটা নিঃশেষ করে ফেলেছি। স্তিমিত মন নিযে আমি এগিয়ে চলেছি মাত্র। বিক্ষিপ্ত আমার চলমান জীবনযাত্রা।
ঠিক এমন সময় আমি শুনতে পেলাম গৌরী তাদের বাড়িতে এক অঘটন ঘটিয়ে ফেলেছে।
কোনো এক পাত্রের সঙ্গে তার বিয়ে। পাত্র দেখে গৌরীর অভিভাবকরা একেবারে মনস্থিরই করে ফেলেছেন। সব ব্যবস্থা পাকাপাকি। গৌরী কিন্তু বেঁকে বসেছে। ঠিক করেছে সে কিছুতেই ওই পাত্রকে বিয়ে করবে না।
কথাটা কানে আসতে আমি যেন কেমন বিব্রত বোধ করতে থাকলাম। একটা অস্বস্তির পোকা যেন আমার মাথার ভেতরটা কুরে কুরে খাচ্ছিল।
এই অবস্থায় একদিন আমি বাড়িতে আছি। সেই সময় রীতিমতো হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল গৌরী আমাদেরবাড়িতে। উদভ্রান্ত সে। চোখে-মুখে একটা বিষাদের ছাপ। ওকে খুব অসহায় মনে হচ্ছিল আমার। এইভাবে আসতে দেখে সেদিন আমি বিস্ময়ের আতিশয্যে চমকে উঠেছিলাম।
তারপর সব কথা সে আমাকে খুলে বলেছিল। আমার হাত দু’খানা শক্ত করে চেপে ধরে ছলছল চোখে বলেছিল গৌরী, এই তো সুযোগ, কথা দাও, এবার তুমি আমাকে তোমার মতো করে আনতে পারবে!
কী করে আনব! কেমন করে তা সম্ভব এই মুহূর্তে! তা ভাববার অবকাশ আমার ছিল না। তৎক্ষণাৎ আমিও দৃঢ় স্বরে বলেছিলাম, গৌরী এই মুহূর্তে আমার মতো করে তোমাকে আনতে আমি প্রস্তুত।
গৌরী তারপর আর একটা কথাও বলার সুযোগ দেয়নি। কথা বলার কোনো অবকাশও তখন আমার ছিল না। গৌরী হঠাৎ কেমন যেন উত্তেজিত হয়ে গেল। দৃপ্ত স্বরে বলল, ওঠো, চলো আমার সঙ্গেÑ
গৌরী তারপর আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে চলল সরাসরি ওদের বাড়িতে।