বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি মহানায়ক উত্তম কুমার অনন্য অভিনয় জাদুতে মুগ্ধতা বিলিয়েছেন দুর্নিবার। তার অভিনীত ছবি মানেই ভালোলাগার এক বিশাল প্রাপ্তি। পর্দায় এ নায়ক যেমন উজ্জ্বল তেমনই তার ব্যক্তিজীবনের চলাচলেও ছিল নানান রঙের মিশেল। সেই অজানা জীবনের গল্প তার বয়ান থেকে অনুলিখন করেছেন প্রখ্যাত সাংবাদিক-সাহিত্যিক গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষ যা পরবর্তী সময়ে ‘আমার আমি’ নামে বই আকারে প্রকাশ হয়। সে বই থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে উত্তম কুমারের আত্মজীবনী-কিছুদিন পর আবার অপ্রত্যাশিতভাবে আমার উত্থানের হদিশ পেলাম। আমি যেন স্পষ্ট দেখতে পেলাম অনেক বন্ধুর পথ পিছনে ফেলে রেখে আলো দেখতে পাচ্ছি।
সেদিনকার তারিখটা মনে নেই। অফিস থেকে ফিরে একটা চিঠি পেলাম। এম.পি’র কর্ণধার মুরলীধর চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন।
চিঠিটা পেযে আমি যে কতটা আনন্দে ভরে গিয়েছিলাম তা এখন ভাষায় বোঝাতে পারবো না।
মুরলীবাবু স্বয়ং আমাকে চিঠি দেবেন এমন বিশ্বাসের জন্ম হবার মতো কোনো সুযোগই তো আমি কোথাও রেখে আসিনি।
যা হোক, চিঠিটা পড়লাম। তার সঙ্গে দেখা করার নির্দেশ আছে চিঠিতে। অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে তিনি আমাকে তাদের ধর্মতলার অফিসে দেখা করতে বলেছেন চিঠিতে।
তৎক্ষণাৎ চিঠির নির্দেশ মেনে নিলাম।
অফিস যাবার নাম করে একেবারে সোজা হাজির হলাম মুরলীধরবাবুর কাছে। নম্র বিনয়ের সঙ্গে নমস্কার জানিয়ে বললাম, আপনি আমাকে ডেকেছেন?
মুরলীবাবু আমাকে বসতে বললেন। সামান্য দু’চারটে কথা। তারপরই তিনি আমাকে এমপি. প্রোডাকশন্সের জন্য তিন বছরের অঙ্গীকারে মাস মাইনের স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে গ্রহণ করলেন। প্রথম বছর মাসিক চারশো টাকা আমার পারিশ্রমিক নির্ধারিত হলো। তাতেই আমি খুশি। মহাখুশি। চুক্তিপত্রে সই করে সেদিন চলে এলাম। জেনে এলাম আমায় অভিনয়ের পরীক্ষা দিতে হবে। পরীক্ষা নেবেন সন্তোষদা, অর্থাৎ সন্তোষ সিংহ।
তখনকার দিনে সন্তোষ সিংহ ছিলেন প্রখ্যাত নট। অভিনয় শিক্ষক হিসেবে ছিলেন বলিষ্ঠ। সেই সন্তোষ সিংহের কাছে পরীক্ষা! ব্যাপারটা আমাকে খুবই উৎসাহিত করল।
যথাসময়ে সন্তোষবাবুর দরবারে ধরা দিলাম শিক্ষানবিশ হিসেবে। তারপর থেকে সন্তোষবাবুর কাছে তালিম নিতে শুরু করলাম।
কিছুদিন পর এমপি. প্রোডাকশন্সের কর্তৃপক্ষ সন্তোষবাবুর কাছে জানতে চাইলেন নায়ক হিসেবে আমাকে চলবে কি না। সন্তোষবাবুর রায়ের জন্য আমি উদগ্রীব। যথাসময়ে তিনি জানিয়ে দিলেন। তার সুস্থ মতামতে আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।
আমার মাস মাইনের কথাটা চূড়ান্তভাবে স্থির হয়ে গেল।
প্রথম বছর চারশো, দ্বিতীয় বছর ছ’শ, আর তৃতীয় বছরে আমি পাব সাতশো টাকা।
এই সময়ে এম.পি কর্তৃপক্ষ ‘সহযাত্রী’ নামে একটি ছবি তৈরি করবেন বলে মনস্থ করেছেন এই খবরটা জানতে পারলাম।
ভেতরে ভতরে ওই ছবির হিরো হবার স্বপ্নও দেখছি, এমন সময় জানতে পারলাম ছবিটির নায়ক হিসাবে স্থির করা হয়েছে অসিতবরণকে।
অসিতবরণ তখন প্রতিষ্ঠিত নায়ক। নায়ক হিসেবে তখন তার খ্যাতিও অনেক। অসিতবরণ ছবির নায়ক শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। ইচ্ছেটা প্রকাশ করার মতো তেমন কোনো সুযোগই পাচ্ছিলাম না। আমি তখন অনেকের মতো মাস মাইনের আর্টিস্ট ছাড়া তো আর বিশেষ কিছুই নই। তাই সাহস করে বলতে পারিনি কথাটা। এদের সঙ্গে এমনভাবে চুক্তিবদ্ধ যে বাইরের কোনো ছবিতে কাজ করব সে উপায়ও নেই! সুতরাং চুপ করে ভেতরে ভেতরে গুমরে থাকা ছাড়া আর কোনো পথই আমার খোলা ছিল না।
তখনও আমার পোর্ট কমিশনার্স অফিসের চাকরিটা আছে। অফিসে যাই। বাড়ি আসি।
মাঝে-মধ্যে এমপি স্টুডিওতে হাজিরা দিই। এই নিয়ে আছি।
এমন সময় খবর পেলাম, অসিতবাবু আরও কয়েকটি ছবির কাজে ব্যস্ত থাকার জন্যে জানিয়েছেন সহযাত্রীতে কাজ করতে পারবেন না।
নিতান্ত স্বার্থপরের মতো আমার মনটা তখন উদ্বেলিত হয়ে উঠল। অবশেষে ভাগ্যদেবতা সুপ্রসন্ন হলেন। কর্তৃপক্ষ শেষ পর্যন্ত আমাকেই নায়ক হিসাবে মনোনীত করলেন।
এবার রীতিমতো পরোক্ষভাবে অর্থাৎ সাহসিকতার সঙ্গে অফিসের চাকরিটার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা শুরু করে দিলাম। আমি তখন আবার আমার স্বপ্নকে সার্থক করে তোলার স্বপ্নে বিভোর। যায় যাবে যাক চাকরিÑএমনই তখন আমার মনের অবস্থা।
‘সহযাত্রী’ ছবির পরিচালনার দায়িত্ব ছিল তখন অগ্রদূত গোষ্ঠীর। এই ছবির শুটিং আরম্ভ করার আগে একদিন সরাসরি হাজির হলাম স্টুডিও অফিসে, বিভুতি লাহার কাছে। বিভুতিবাবু অর্থাৎ খোকাদা তখন অফিসেই ছিলেন। এই ছবিতে কাজ করার ব্যাপারে তিনি যথেষ্ট উৎসাহ দিলেন, সাহস জোগালেন।
ভাবলাম পোর্ট কমিশনার্সের চাকরিটা ছেড়ে দেব। ভাবনা যখন একরকম স্থির, ঠিক তখনই বিভুতিবাবুর সঙ্গে আমার আলাপ। তার ছবির নির্বাচিত নায়ক আমি, তবুও তিনি আমার দুর্ভাগ্যের সিঁড়ি তৈরি হোক তা কোনোমতেই চাননি। একবার বলেছিলাম, এবার আমি চাকরিটা ছেড়ে দেব ভাবছি।
উত্তরে বিভূতি লাহা বলেছিলেন, কয়েকটি ছবিতে পর পর পুরো কাজ না পাওয়া পর্যন্ত চাকরি ছাড়ার ব্যাপারে চূড়ান্ত মনস্থির করা বোধ করি উচিত হবে না।
আরও বলেছিলেন, হঠকারিতা দিয়ে নিজেকে কোনো মহান ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা দেওয়া যায় না, এটাই আমার স্থির বিশ্বাস।