× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার , ৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৯ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

সিরিয়া ছাড়া সবই যেন বিশ্বের কাছে গুরুত্বপূর্ণ

অনলাইন

জোনাথন ফ্রিডল্যান্ড
(৬ বছর আগে) ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৮, শুক্রবার, ১১:৫৮ পূর্বাহ্ন

সিরিয়ায় বেসামরিক মানুষ নিহত হওয়া ছাড়া যেকোনো কিছুই আমাদের কাছে আগ্রহদ্দীপক। খালি আজকের পত্রিকাগুলোর ফ্রন্টপেজ দেখুন। গার্ডিয়ানের প্রধান সংবাদ ছিল সিরিয়ার দামেস্কের পূর্বে অবস্থিত গুতা শহরতলীর নিরস্ত্র বাসিন্দাদেরকে হত্যা করা নিয়ে। কিন্তু বৃটেনের বাকি সব মিডিয়ার প্রধান সংবাদ হলো আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থার কেলেঙ্কারি, এক নতুন আর্থিক রেগুলেটরের আয়করের ইতিবৃত্ত ও ‘স্ট্রিক্টলি’ নামে একটি নাচের অনুষ্ঠান থেকে এক প্রতিযোগীকে বাদ দেওয়া।
এমন মুখরোচক ভীড়ে গুতা শহরতলীতে চালানো রক্তগঙ্গা একটু বেশিই ম্যাড়ম্যাড়ে। হ্যাঁ, বাশার আল আসাদের সরকার বিদ্রোহী-অধ্যুষিত এলাকায় এত বোমাবর্ষণ করেছেন যে, ৪০ ঘণ্টা ১৯৪ জন মানুষ নিহত হয়েছে, যাদের অনেকেই শিশু। দুই দিনে সরকারী বাহিনী সাতটি হাসপাতালে আক্রমণ করেছে। যেসব স্বাস্থ্যকর্মী হতাহতদের উদ্ধারের চেষ্টা করেছিলেন, তাদের ওপর বারবার হামলা চালানো হয়েছে।
কয়েক মাস ধরে প্রায় ৪ লাখ বাসিন্দার এই শহরটিতে খাদ্য সরবরাহ বন্ধ। ফলে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে বিকল্প আছে কেবল দুইটি। বোমা হামলার শিকার হওয়া অথবা তীব্র ক্ষুদায় ভোগা। এই অবরোধ যে আরও কড়া হবে, তারই ইঙ্গিত মিলছে। এ সব কিছুই জাতিসংঘ বেশ নিখুঁতভাবে নথিবদ্ধ করেছে। কিন্তু সত্যি করে বলুন তো, কার কী আসে যায়?
আজকে গার্ডিয়ানের প্রথম পাতায় ছিল সিরিয়া। কিন্তু আমরা কেউই নৈতিকভাবে উচুঁ অবস্থানে নেই। এই রক্তারক্তি চলছে আজ সাত বছর হতে চলল। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই রাজনীতিবিদ, সংবাদমাধ্যম ও জনগণ - আমাদের বেশিরভাগই একে অগ্রাহ্য করে চলেছি। পেছন ফিরে তাকাই। দিনের পর দিন যখন সিরিয়ায় এই হত্যাযজ্ঞ চলছিল, তখন অন্যান্য অনেক ইস্যু আমাকে ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছিল। যেমন, ডনাল্ড ট্রাম্পের টুইট, বা ব্রেক্সিট। এই নৃশংসতার প্রতি বিশ্বের ‘আমি কী করতে পারি?’ মনোভাবের অংশ আমি নিজেও।
আসুন নিজেদেরকে আর প্রবোধ না দিই। আমাদের এই নীরবতা দুষ্কর্মে অংশ নেওয়ার সামিল। আমরা ক্ষোভ প্রকাশ করিনি, যার ফলে আসাদ বার্তা পেয়েছেন: যা করে যাচ্ছিলে, তা চালিয়ে যাও, কেউ তোমাকে থামাবে না। আমি যদি আসাদ হতাম, তাহলে এসব দৈবাৎ সমালোচনা নিয়ে আমার অত উদ্বেগ থাকতো না। রেডিওতে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর নিন্দা জ্ঞাপন, ইউনিসেফের ফাঁপা বিবৃতি যে ‘শিশুরা যে কতটা কষ্ট ভোগ করছে তা বর্ণনা করার ভাষা আমারা হারিয়ে ফেলেছি’--এসবে আমার কিছুই আসতো যেত না। কারণ, আমি জানতাম যে, এসব সংক্ষিপ্ত উদ্বেগের তোড় ক’দিন বাদেই শান্ত হয়ে যাবে। আমি ফের হত্যাযজ্ঞ চালাতে পারবো। শুধু আমাকে যে নিয়ম মেনে চলতে হবে, তা হলো, প্রতিদিন এত বেশি মানুষ মারা যাবে না, যাতে সবাই বিষয়টি আমলে নেওয়া শুরু করে।
গত বছর এপ্রিলেই এই শিক্ষা পেয়ে যাওয়ার কথা আমার। আমি ইদলিব প্রদেশে রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করে, শিশুদের ওপর রাসায়নিক গ্যাস প্রয়োগ করে সীমা অতিক্রম করে ফেলেছিলাম। কিন্তু আমাকে শুধু এতটুকু পরিণতি ভোগ করতে হয়েছিল যে, সিরিয়ার বিমানঘাঁটিতে সীমিত আকারে যুক্তরাষ্ট্র ক্রুজ মিশাইল নিক্ষেপ করেছিল। বেশি গুরুতর কিছু না করলে, হত্যাকা- একটা সীমিত মাত্রার মধ্যে রাখলেই, আমাকে কেউ কিছু বলবে না।
বিশ্বের যে এই উদাসীনতা, তার ব্যাখ্যা কী? এর আংশিক কারণ হলো, এসব ঘটছে এমন এলাকায় যা আমাদের দেশ থেকে অনেক দূরে। দামেস্কের ব্যারেল বোমার চেয়ে ট্রাম্প ও ব্রেক্সিট আমাদের জন্য বড় নৈতিক হুমকি নয়। কিন্তু ট্রাম্প ও ব্রেক্সিট নিয়ে আমেরিকা ও বৃটেন যেন নিমগ্ন হয়ে আছে। আর সাম্প্রতিক দিনগুলোতে, ত্রাণ সংস্থাগুলোও পড়েছে বিপদে। সময়টা স্বাভাবিক থাকলে এই সংগঠনগুলো সিরিয়ার মতো স্থানে চলমান পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের সতর্ক করতো। কিন্তু এখন এসব সংস্থা নিজেরাই কেলেঙ্কারিতে বিপর্যস্ত। এখন তারা নিজেদের অভ্যন্তরীন বিষয়ের দিকে নজর দিচ্ছে বেশি।
আরও একটি কারণ হলো, এই সংঘাত অনেক দিন ধরে চলছে। সাত বছর ধরে আমরা জানি যে, সিরিয়ায় এক ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ চলছে। আমরা এখন এর সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। রাসায়নিক গ্যাসের প্রভাবে সিরিয়ান শিশুদের শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার শব্দ এখন আমাদের কাছে এই দশকের ‘ব্যাকগ্রাউন্ড নয়েজ’। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমরা জানিই না, এই সিরিয়া নিয়ে কী করা উচিত।
আমি আগেও লিখেছি এই কথা। ২০০৩ সালের ভয়াবহ ইরাক আক্রমণের একটি বড় পরিণতি হলো, তথাকথিত মানবিক হস্তক্ষেপকে এখন উড়িয়ে দেওয়া হয়। এই মানবিক হস্তক্ষেপ হলো এই বিশ্বাস যে, মাঝেমাঝে কোনো শাসকগোষ্ঠীর হাতে নিজ জনগণের হত্যাকা- ঠেকাতে হস্তক্ষেপ করাটা ক্ষতিকর কিছু নয়। কিন্তু ইরাক যুদ্ধ এই মানবিক হস্তক্ষেপের ধারণাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছে। ফলে এখন কেউই এই হস্তক্ষেপের কথা বলে না। কীভাবে সিরিয়ার এই হত্যাযজ্ঞ ঠেকাতে হবে, তা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। আমরা শিগগিরই এই হত্যাযজ্ঞ নিয়ে কথা বলাই থামিয়ে দেব। এটি স্রেফ আমাদের দৃষ্টিসীমা থেকে হারিয়ে যাবে।
কিন্তু মনোযোগ দেওয়া ও প্রতিবাদ করাটা যে একেবারে বিফলে যায়, তা নয়। আসাদকে উদ্দেশ্য করে কিছু বললে লাভ হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই হয়তো নেই। ঠিক একইভাবে, যেসব বিদ্রোহী গোষ্ঠী সরকার-নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোতে বোমা নিক্ষেপ করে, তারাও কিছু শুনবে না। কিন্তু আসাদের সমর্থক, অর্থাৎ রাশিয়া ও ইরান সরকার তো নাগালের বাইরে নয়। ফেসবুক ও টুইটারে মস্কো এখন খুবই সক্রিয়। দেশটি এখন নিজেদের প্রোপাগান্ডা চ্যানেল আরটি’র পেছনে লাখ লাখ ডলার ঢালছে। এ থেকে আমরা বুঝি যে, পশ্চিমা দুনিয়ার জনমত নিয়ে মস্কো অন্তত সংবেদনশীল।
এই যুদ্ধ শেষ হচ্ছে না। নীরবে জ্বলেপুড়ে ছাইও হয়ে যাচ্ছে না। বরং, যারা এই যুদ্ধকে কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করছেন, তারা বলছেন উল্টোটা: সংঘাত বিস্তৃত হচ্ছে। গুতা শহরের বাসিন্দাদের জন্য, সোমবার ছিল গত তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে প্রাণঘাতি দিন। এতদিন ধরে আমরা রাশিয়া, ইরান ও সিরিয়াকে যে বার্তা দিয়েছি, সেটা হলো ‘আমি কী করতে পারি?’ মনোভাব। কিন্তু আমরা যদি এই হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করতে চাই, তাহলে আমাদের এই দাবিতে মুখর হতে হবে।
(জোনাথন ফ্রিডল্যান্ড বৃটিশ সংবাদপত্র দ্য গার্ডিয়ানের একজন কলামিস্ট। তার এই নিবন্ধ গার্ডিয়ানের ওয়েবসাইট থেকে অনুবাদ করেছেন মাহমুদ ফেরদৌস।)
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর