সিরিয়ার ঘৌটা শহরে টানা সাত দিন ধরে সরকারি বাহিনীর হামলা অব্যাহত থাকার পরেও সেখানে যুদ্ধবিরতির বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়েছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ। রাশিয়ার আপত্তির মুখে শুক্রবারেও ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি নিরাপত্তা পরিষদ। ফলে এই বিষয়ে শনিবার আবারো নিরাপত্তা পরিষদে ভোটাভুটি হওয়ার কথা রয়েছে। এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এ খবর দিয়েছে দ্য গার্ডিয়ান।
খবরে বলা হয়, ঘৌটায় ৩০ দিনের যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব নিয়ে কয়েকদিন ধরেই নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনা চলছে। বৃহস্পতিবার নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে সিরিয়ায় অস্ত্র বিরতির প্রস্তাব উত্থাপন করে সুইডেন ও কুয়েত। এতে জোর সমর্থন জানায় যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স।
কিন্তু স্থায়ী সদস্য রাশিয়া এতে আপত্তি জানানোর ফলে যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। ফলে এই বিষয়ে শুক্রবার ভোটাভুটির সিদ্ধান্ত নেয় পরিষদ। শুক্রবার পুরো দিনজুড়ে রাশিয়াকে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে রাজি করার প্রচেষ্টা চালায় নিরাপত্তা পরিষদের অন্য সদস্যরা। সিরিয়ায় ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধ করতে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের প্রতি আহ্বান জানিয়ে চিঠি পাঠান ফ্রান্স ও জার্মানির সরকার প্রধান। এতে তারা পূর্ব ঘৌটায় আটকে পড়া লাখ লাখ বেসামরিক নাগরিকের শোচনীয় অবস্থার কথা তুলে ধরেন। কিন্তু নিজেদের অবস্থানে অনড় রাশিয়া। বরং তারা নতুন শর্ত জুড়ে দেয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বলেন, বিদ্রোহীরাও যদি এই প্রস্তাব মেনে চলে, তাহলে রাশিয়া ৩০ দিনের যুদ্ধ-বিরতির প্রস্তাবে সম্মত হবে। আর যুক্তরাষ্ট্রকে এর নিশ্চয়তা দিতে হবে। তিনি বলেন, বিদ্রোহীরা দামেস্কের আবাসিক অঞ্চলগুলোতে গুলবর্ষণ বন্ধ করবে, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। যে প্রস্তাব এমন নিশ্চয়তা দিতে পারবে, আমরা তা মেনে নিতে প্রস্তুত। আমরা এমন ব্যবস্থা নেয়ার প্রস্তাব দিচ্ছি যা সত্যিকার যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে। আর পূর্ব ঘৌটার বাইরে ও ভেতরের সবাইকেই এর নিশ্চয়তা দিতে হবে।
শুক্রবার সকাল ১১টায় নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাবের বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়। কিন্তু আবারো প্রস্তাবের পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক-বিতর্ক শুরু হওয়ায় অধিবেশন দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত মুলতবি করা হয়। এই সময়ে অনানুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাবের বিষয়ে রাশিয়াকে রাজি করানোর চেষ্টা করে পরিষদের সদস্যরা। কিন্তু সেখানেও কোনো সমাধান আসেনি। ফলে প্রস্তাবের বিষয়ে রাশিয়ার আপত্তি নিয়েই শনিবার আবারো ভোটাভুটির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। নিরাপত্তা পরিষদের নির্বাচিত অস্থায়ী ১০ সদস্য দেশ বলেছে, যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের বিষয়ে তারা একমত। এটি শুক্রবারেই পরিষদে অনুমোদন হবে বলে আশা করেছিলেন তারা। কুয়েতের মানসুর আল ওতাইবি বলেন, নিরাপত্তা পরিষদ প্রস্তাব পাস করার খুব কাছেই রয়েছে।
যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাবে রাজি হওয়ার আহ্বান জানিয়ে পুতিনকে দেয়া চিঠিতে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোন ও জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল বলেছেন, বেসামরিক নাগরিকদের ওপর নির্বিচারে হামলা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের দপ্তর থেকে প্রকাশিত আরেকটি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ফ্রান্স ও জার্মানি ঘৌটায় সব সহিংসতার অবসান চায়। পাশাপাশি সেখানে ত্রাণ পৌঁছানোর জন্য নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপিত যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে সমর্থন দেয়ার জন্য সব সদস্যের প্রতি আহ্বান জানায় দেশ দু’টি। এ ছাড়া শুক্রবার নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পররাষ্ট্র বিষয়ক প্রধান ফেডেরিকা মোঘেরিনি সিরিয়ায় সহিংসতা বন্ধ করে সেখানে অবিলম্বে ত্রাণ পৌঁছানোর ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, পূর্ব ঘৌটার মানুষদের ওপর যে নৃশংসতা চালানো হচ্ছে তা অবর্ণনীয়। এই গণহত্যা এখনই বন্ধ করা উচিত।
এদিকে, সিরিয়ার হত্যাযজ্ঞের জন্য রাশিয়াকে দায়ী করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়া, ইরান ও সিরিয়া যা করছে তা মানবাধিকারের অবমাননা। আমি আপনাদেরকে এটাই বলবো। আর যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবের বিরুদ্ধে রাশিয়ার অবস্থানের সমালোচনা করেছেন জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিকি হ্যালি। এক টুইটার বার্তায় তিনি বলেন, ‘রাশিয়া যুদ্ধবিরতির বিরোধিতা করছে। এটা অবিশ্বাস্য। নিরাপত্তা পরিষদের ভোটাভুটির আগে আর কত মানুষ মারা যাবে? চলুন আমরা আজ রাত্রেই এটি সম্পন্ন করি। সিরিয়ার মানুষ আর অপেক্ষা করতে পারছে না।’
উল্লেখ্য, শনিবার সপ্তম দিনের মতো সিরিয়ায় সরকারি বাহিনীর হামলা অব্যাহত রয়েছে। পূর্ব ঘৌটার আকাশে সিরিয়া ও এর মিত্রদের বোমারু বিমানের গর্জন চলছে। এগুলো নির্বিচারে বেসামরিক সিরিয়ানদের ওপর বোমা নিক্ষেপ করছে। এখন পর্যন্ত সেখানকার ৪৭০ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে ১৫০ জনই শিশু। আর হামলায় আহত হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার মানুষ।