× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার , ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৭ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

ভারত মহাসাগরে শীতল যুদ্ধ

শেষের পাতা

মানবজমিন ডেস্ক
২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, সোমবার

দ্রুত বদলে যাচ্ছে ভারত মহাসাগরীয় কৌশলগত পরিবেশ। কয়েক বছরে এখানে ক্রমবর্ধমান হারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেখা গেছে  এ অঞ্চলের দুটি বড় শক্তি চীন ও ভারতকে। তারা ক্রমাগত এ অঞ্চলে তাদের কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি করে চলেছে। তবে এখন এক্ষেত্রে নতুন নতুন দেশকে এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে। তারা ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তাদের প্রভাব বিস্তার করতে তৎপর। এটাকে দেখা যেতে পারে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নতুন কৌশলের মাত্রা হিসেবে। এখানে বড় ও মধ্যম মানের অনেক শক্তি তাদের প্রভাব ও অবস্থানকে জাহির করতে চায়। এই যে আঞ্চলিক প্রভাবের বলয় এতে বড় পরিবর্তনের জন্য দায়ী চীন।
এতে কোনো সন্দেহ নেই। ভূ-রাজনৈতিক বা ভৌগোলিক কারণে ভারত মহাসাগর থেকে দূরে রয়েছে চীন। স্থলপথে এখানকার সুবিধা পাওয়া তাদের জন্য সম্ভব নয়। কারণ, চারদিক দিয়েই তারা ভারত মহাসাগর থেকে দূরে। তবে নৌপথে এই ভারত মহাসাগরে তাদের সুবিধা পাওয়ার বিষয়টি সুদূরপ্রসারী ও অনিশ্চিত একটি বিষয়। বিদেশি তেলের ওপর নির্ভরশীল চীন। এছাড়া এ অঞ্চলে রয়েছে তাদের আরো কিছু স্বার্থ। তাই একথা অপরিহার্যভাবে বলা যায় যে, ভারত মহাসাগরের সুবিধা পেতে হলে চীনকে অনেক বেশি মূল্য দিতে হবে।
কিন্তু ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে একটি সামরিক ভূমিকা রাখার বিষয়ে অনেকে যতটা প্রত্যাশা করেছিল এখন চীন তার চেয়ে খুব দ্রুতগতিতে অগ্রসর হচ্ছে। এ জন্য চীন ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে নৌ ও সামরিক ঘাঁটি গড়ে তোলার দিকে মনোযোগ দিয়েছে। তারা এরই মধ্যে গত বছর জিবুতিতে একটি ঘাঁটি উদ্বোধন করেছে। পাকিস্তানের গোদার-এ অথবা এর কাছাকাছি নতুন একটি ঘাঁটি নির্মাণ করবে বলে মনে হচ্ছে। এ ছাড়া পূর্ব আফ্রিকায়ও সম্ভবত চীনের ঘাঁটি রয়েছে। এ অঞ্চলটি সম্ভবত মধ্য/পূর্ব ভারত সাগরের ভেতরে। নিজেদের স্বার্থের ওপর প্রভাব ফেলে এমন কোনো কন্টিনজেন্সির জবাব দিতে চীনকে সর্বোচ্চ সহায়তা দেবে এসব ঘাঁটি।
ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আধিপত্য রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে তাদের প্রতি চীন চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারবে বলে মনে হয় না। কিন্তু শক্তির কোনো শূন্যতা সৃষ্টি হলে সেখানে কৌশলগত সুযোগ নেবে চীন।
এ অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি এবং কীভাবে তার জবাব দেয়া হবে বিশেষত তা নিয়ে ভারতও উদ্বিগ্ন। এর মধ্যে ভারতের আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ রয়েছে। রয়েছে কাছাকাছি মালাকা প্রণালী। রয়েছে সিসিলি, মৌরিতিয়াস। এসব স্থানে ঘাঁটি বা কৌশলগত স্থাপনা নির্মাণের দিকে অগ্রসর হচ্ছে তারা। সম্প্রতি ভারত ও ফ্রান্সের মধ্যে একটি ‘লজিস্টিক এক্সচেঞ্জ’ চুক্তি চূড়ান্ত হয়েছে। এর অধীনে পশ্চিম ভারত মহাসাগরে ফ্রান্সের স্থাপনা নির্মাণের জোরালো সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তা ব্যবহার করছে ভারত। সর্বশেষ ভারত ও ওমানের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর অধীনে ভারতীয় নৌবাহিনী ওমানের দুকম বন্দরের সুবিধা নিতে পারবে লজিস্টিক ও মেরামতের প্রয়োজনে। এ চুক্তির আওতায় দুকমের কাছে তেল সংরক্ষণের একটি স্থাপনার উন্নয়ন করা হবে। এটা ভারতের তেল সংরক্ষণের একটি কৌশল। ভারত মহাসাগরে একই সঙ্গে চীনের নড়াচড়া এবং তার জবাবে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের প্রতিক্রিয়ায় বিশ্লেষকরা আরেকটি নতুন শীতল যুদ্ধের আশঙ্কা করছেন। তারা মনে করছেন ভারত মহাসাগরকে কেন্দ্র করে শুরু হতে পারে আরেকটি শীতল যুদ্ধ। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন সম্প্রতি নতুন ‘অবাধ ও মুক্ত ইন্টো-প্যাসিফিক কৌশল’ ঘোষণা করেছেন। কিন্তু ঘটনা এখানেই শেষ নয়। ভারত মহাসাগরে চীনই একমাত্র নতুন ফ্যাক্টর নয়। এক্ষেত্রে প্রচলিত নয় এমন খেলোয়াড়কেও দেখা যাচ্ছে। তারা ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সক্রিয় হয়ে আছে। এমন শক্তিগুলোকে বলা হচ্ছে আঞ্চলিক মধ্যম মানের শক্তি। এর মধ্যে আছে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, তুরস্ক ও ইরান। এসব দেশ এর আগে বা আধুনিক ইতিহাসে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিরাপত্তায় অনুল্লেখ্য অথবা কোনো ভূমিকাই রাখে নি। এসব দেশ এর আগে তাদের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন সমস্যা নিয়েই কাজ করেছে। কিন্তু কিছু কারণে তারা ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বিষয়ে অধিক পরিমাণে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ভবিষ্যতে তারা ভালো ভূমিকা রাখবে বলেই মনে হচ্ছে। বর্তমান সময়ে নতুন এসব প্লেয়ারদের মধ্যে, যেমন সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত বা তুরস্কের বিষয়টিতে দৃষ্টি রাখতে পারি। তারা হর্ন অব আফ্রিকা অঞ্চলজুড়ে নৌ ও সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করছে। জিবুতিতে একটি নৌঘাঁটি নির্মাণের জন্য সম্প্রতি একটি চূড়ান্ত চুক্তি করেছে সৌদি আরব। সৌদি আরবের ঘনিষ্ঠ মিত্র সংযুক্ত আরব আমিরাত সবেমাত্র ইরিত্রিয়ার আসাবে একটি বড় ধরনের নৌ ও বিমান স্থাপনা নির্মাণ করেছে। তারা সোমালিয়ার মোগাদিসুতে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পরিচালনা করছে। অন্যদিকে সুদানের সঙ্গে সম্প্রতি প্রতিরক্ষাবিষয়ক একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে তুরস্ক। এ চুক্তির অধীনে লোহিত সাগরে অটোম্যান সাম্রাজ্যের সময়কার পুরনো সুয়াকিন বন্দর পুনঃনির্মাণ করবে তুরস্ক। সেখানে নৌঘাঁটিরও উন্নয়ন করার কথা রয়েছে। কাতার ও মোগাদিসুতে তুরস্কের যে সামরিক সুবিধা বা ঘাঁটি আছে তার সঙ্গে যোগ হবে এ প্রয়াস। তবে হর্ন অব আফ্রিকা অঞ্চলে এ দেশগুলোর এমন প্রভাব বিস্তারের ফলে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের মধ্যে নতুন করে তীব্র বিরোধিতা দেখা দিতে পারে। এতে সৃষ্টি হতে পারে শক্তিশালী দুটি ব্লক। তার একদিকে থাকবে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিশর। অন্যদিকে থাকবে তুরস্ক, ইরান ও কাতার। ইয়েমেনে এই প্রতিদ্বন্দ্বী ব্লকগুলোর মধ্যে চলছে প্রক্সি যুদ্ধ। এই দুটি ব্লকের মধ্যে বৈরিতা নতুন করে আরো দীর্ঘমেয়াদি প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টি করতে পারে। আঞ্চলিক বিরোধ সৃষ্টি হতে পারে। সম্প্রতি তুরস্ক ও সুদানের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছে প্রতিরক্ষা ও গোয়েন্দা সহযোগিতা নিয়ে তাতে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে সুদান ও মিশরের মধ্যে। তুরস্ক-সুদান চুক্তির মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে ইরিত্রিয়ায় সেনা মোতায়েন করেছে মিশর। নীল নদের ওপর একটি ড্যাম নির্মাণের পরিকল্পনা করছে ইথিওপিয়া এমন খবরে এ ব্যবস্থা নেয়া।
এই যে বিরোধ তা সংক্রমিত হবে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে। মালদ্বীপ ও কমোরোস দ্বীপপুঞ্জে ইরানের যে প্রভাব আছে তাকে চেক দিতে সক্রিয় রয়েছে সৌদি আরব। কমোরোস ও মালদ্বীপ উভয়েই ইরান ও কাতারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। তারা সৌদি আরবের ইসলামিক মিলিটারি এলায়েন্ট এগেইনস্ট টেরোরিজম-এর সঙ্গে চুক্তি করেছে। অনেকেই হয়তো মানতে চাইবেন না, তবু মালদ্বীপে সৌদি আরবের নৌ-ঘাঁটি থাকলে তাতে ইরানের ওপর বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করবে। ওদিকে মালদ্বীপের সঙ্গে সৌদি আরবের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে ক্রমবর্ধমান হারে উদ্বিগ্ন ভারত। আবার সৌদি আরবের ঘনিষ্ঠ মিত্র সংযুক্ত আরব আমিরাত তার পাখা বিস্তার করছে। তারা ভারত মহাসাগরে ছোট ছোট দ্বীপরাষ্ট্রকে আর্থিক ও রাজনৈতিক সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। যেমনটি দিচ্ছে সিসিলিকে প্রতিরক্ষা সহায়তা। সংযুক্ত আরব আমিরাত এখন ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ব্যাপক রাজনৈতিক ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছে। ইন্ডিয়ান ওশিন রিম অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারের পদের দিকে তাদের চোখ। যদি তারা এটা পায় তাহলে আঞ্চলিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে বড় একটি প্ল্যাটফরম পাবে তারা। অন্যদিকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের শত্রু হিসেবে পরিচিত ইরান অল্প সময়ের মধ্যেই ইন্ডিয়ান ওশিন নেভাল সিম্পোজিয়ামের চেয়ার হতে চলেছে। এসব নিয়ে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে দেখা দিতে পারে নতুন এক শীতল যুদ্ধ।
(দ্য ডিপ্লোম্যাটে প্রকাশিত ড. ডেভিড ব্রিউস্টারের লেখা নিবন্ধ অবলম্বনে। ডেভিড ব্রিউস্টার অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ন্যাশনাল সিকিউরিটি কলেজের সিনিয়র বিশ্লেষক)  
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর