বাংলাদেশের ইতিহাসে অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কখনই টেকসই হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন। তিনি বলেছেন, অন্যায় এখানে চিরস্থায়ী হয়ে টিকতে পারে না। আইনের শাসনকে উপেক্ষা করে বেআইনিভাবে পুলিশ, প্রশাসন এরা যদি চেষ্টা করে কিছুদিন মনে হবে যে সব শক্তি তাদের মধ্যে চলে এসেছে। কিন্তু জীবনে বহু বার দেখেছি যখন ঐক্য হয় দ্রুত এটার পতন ঘটে। এটা বাঙালির ইতিহাসের গর্বের বিষয়। অন্যায় এখানে চিরস্থায়ী হয় না, হবে না। গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবের কনফারেন্স লাউঞ্জে এক শোকসভায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। গণফোরাম নেতা ডা. রওশন হাকিম, ফজলুল কবির কাউসার, আবুল হাসনাতের মৃত্যুতে এ শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়।
ড. কামাল বলেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে অনড় হলে অসাধারণ শক্তির সৃষ্টি হয়। নম্বইয়ের দশকে যেটা অসম্ভব মনে হয়েছে তা ঐক্যের কারণে সম্ভব হয়েছে। নব্বই সনে বৃটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, তোমাদের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আমি দেখা করে এসেছি। তিনি তো আরো পনের বছর আছেন। তিনি খুব কনফিডেন্ট। আমি বলেছিলাম, ওনাকে তো পনের সপ্তাহ থাকবে বলে দেখি না। আমার বিশ্বাস ছিল বাংলার মানুষ অন্যায়কে চিরদিন সহ্য করে না। তারা ঐক্যবদ্ধভাবে ঝুঁকি নেবে। যে কারণে আমি নিরাশ হচ্ছি না। বাংলার মাটিতে অন্যায় টিকবে না। আজকেও অন্যায় মেনে নেবে না। আমি শতভাগ নিশ্চিত অন্যায় টিকবে না। তিনি আরো বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে শুধু সরকার কি করছে সেটা দেখলে হবে না। দেশের মানুষ হিসেবে আমাদের কিছু কর্তব্য আছে। সরকার ব্যর্থ হচ্ছে। কিন্তু আমরা সতেরো কোটি মানুষ কি এই ব্যর্থতা মেনে নেব যে সরকার শহীদদের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। যদি মনে করেন ব্যর্থ হচ্ছে আমাদের কিছু করণীয় আছে কিনা সেটা চিন্তা করা দরকার। জনগণ ঐক্যবদ্ধ হলে অগণতান্ত্রিক দূর হবে উল্লেখ করে ড. কামাল আরো বলেন, এখন সকলের মুখে ঐক্যের কথা শুনছি। সরকার, বিরোধী দল সবাই ঐক্যের কথা বলছে। এটা ঐতিহাসিক সত্য। বাংলাদেশে যা কিছু অর্জন হয়েছে জনগণের ঐক্যের মধ্যে হয়েছে। বাংলাদেশের যে কোনো বিবেকবান-নীতিবান মানুষ যে কোনো দল করুক না কেন তারা সেই জিনিসটা প্রমাণ করেছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপসহীনভাবে অবস্থান নিলে অন্যায়কারীরা পরাজিত হয়, জনগণ বিজয়ী হয়। আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ সেই ঐক্য আবার প্রতিষ্ঠা করতে পারব যেটা দিয়ে ভাষা আন্দোলন, একাত্তরে বিজয় এসেছিল, ছিয়াশির পরে নব্বইয়ে গণতন্ত্র এনেছিল সেই ঐক্য প্রতিষ্ঠা করব। যে রাজনীতির জন্য অতীতে সংগ্রাম হয়েছে সেই রাজনীতিকে বাঁচিয়ে রাখব। যারা এই রাজনীতিকে সমর্থন করে তাদের সঙ্গে আমরা সংঘবদ্ধ হবো। গণফোরাম সভাপতি বলেন, গণফোরাম প্রতিষ্ঠার সময় বিশ্বাস ছিল, যে রাজনীতির মধ্য দিয়ে ভাষা আন্দোলন হয়েছে, ছয় দফা, এগারো দফা আন্দোলন হয়েছে, স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় এসেছে সেই রাজনীতি হলো সুষ্ঠু রাজনীতি, সুস্থ রাজনীতি। সুস্থ রাজনীতির যে শক্তি বারবার পরীক্ষিত হয়েছে। পরীক্ষিত রাজনীতিতে প্রত্যেকবারে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় জয়যুক্ত হয়েছে। ন্যায়ের যে জয় এটা বাংলার মাটিতে অনিবার্য। শহীদের রক্তে রঞ্জিত মাটিতে অন্যায় কোনোদিন চিরস্থায়ী হতে দেবে না এটা আমি একশভাগ বিশ্বাস করি। প্রয়াত গণফোরাম নেতাদের রাজনৈতিক জীবন থেকে স্মৃতিচারণ করে ড. কামাল বলেন, যাদের জন্য শোকসভা করছি তাদের অন্তর থেকে বিশ্বাস ছিল এদেশের মানুষ অন্যায়কে কোনোদিন মেনে নেবে না। তারা তাদের বিশ্বাস থেকে কোনোদিন সরে যাননি। যারা আন্তরিকভাবে রাজনীতি করেছে তাদের পরিবারকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। তারা দেশ-জাতিকে অন্যায় থেকে মুক্ত করার জন্য ঝুঁকি নিয়েছেন। এরকম লোকেরা না থাকলে আমরা পথ হারিয়ে থাকতাম। আমরা আজকেও সেই বিদেশিদের সেই উপনিবেশিক শাসনের মধ্যে থাকতাম। তাদের মধ্যে ন্যায়-অন্যায়ের বোধ ছিল, রুখে দাঁড়ানোর শক্তি ছিল। আপসহীনভাবে দাঁড়ানোর শক্তি ছিল। তারা আমাদের ঋণী করে রেখে গেছেন। শোকসভায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী আওম শফিক উল্লাহ, অ্যাডভোকেট জগলুল হায়দার আফ্রিক, অধ্যাপিকা বিলকিস বানু, মোশতাক আহমেদ, খান সিদ্দিকুর রহমান, হারুন অর রশিদ তালুকদার, সাঈদুর রহমান, মিজানুর রহমান, শফিউর রহমান বাচ্চু, হোসনে আরা খানম এবং ডা. রওশন হাকিমের কন্যা ডা. তাসমিনা হাকিম, ফজলুল কবির কাউসারের স্ত্রী অধ্যাপিকা নাসরিন খানম ও আবুল হাসনাতের ছেলে আনান হাসনাত প্রমুখ।