বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি মহানায়ক উত্তম কুমার অনন্য অভিনয় জাদুতে মুগ্ধতা বিলিয়েছেন দুর্নিবার। তার অভিনীত ছবি মানেই ভালোলাগার এক বিশাল প্রাপ্তি। পর্দায় এ নায়ক যেমন উজ্জ্বল তেমনই তার ব্যক্তিজীবনের চলাচলেও ছিল নানান রঙের মিশেল। সেই অজানা জীবনের গল্প তার বয়ান থেকে অনুলিখন করেছেন প্রখ্যাত সাংবাদিক-সাহিত্যিক গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষ যা পরবর্তী সময়ে ‘আমার আমি’ নামে বই আকারে প্রকাশ হয়। সে বই থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে উত্তম কুমারের আত্মজীবনী-
ইতিমধ্যে আমি কিন্তু চুপ করে থাকিনি। বরাবরই সব কিছু শেখার একটা স্পৃহা আমার ছিল। যখন স্কুলে পড়তাম তখন সাঁতার শিখতাম, ভলিবলও খেলতাম। আসলে বন্ধুবান্ধব আমাকে বলত, তুই একটু স্বাস্থ্যচর্চা কর, তোর ঘাড়ের দিকটা একটু বাঁকা-কিন্তু অমন থাকলে হিরো হিরো মানায় নাÑ মেরুদ- সোজা করতে হবেÑ আর তা করতে হলে একসারসাইজ করতে হবে।
আমি তাই করতে লাগলাম। ভলিবল খেললে নাকি ভালো হয়- আমি তাই খেলতাম। এর মধ্যে সিনেমার অভিনয চলছে। এমন সময় আমার হিন্দি-উর্দু শেখার খুব ইচ্ছে হলো। কিন্তু কার কাছে শিখি? কে শেখাবে আমাকে! খুব ভাবছি, মনে মনে মাস্টারও খুঁজছি। সেটা ১৯৫০ অথবা ৫১ সালের কথা। একদিন অনুভাকে অর্থাৎ অনুভা গুপ্তাকে বললাম কথাটা। অনুভা বলল, এতে এত ভাববার কী আছেÑ আমি খুব ভালো মাস্টার দেব।
তারপর একদিন আমি স্টুডিওতে একটা ফ্লোরে কাজ করছিÑ অনুভা বোধহয় তখন তপন সিংহের ‘অঙ্কুশ’ ছবিতে কাজ করছিল। ওর সঙ্গে দেখা হলো। একজনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে বলল, ইনি আমাদের মাস্টারজিÑএর কাছে তুমি শেখো। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম। মাসিক পঞ্চাশ টাকায় মাস্টারজি আমাকে উর্দু-হিন্দি শেখাতে রাজি হয়ে গেলেন। সপ্তাহে তিনদিন।
প্রথম থেকেই ভদ্রলোকের ব্যবহারে আমি মুগ্ধ। মাস্টারজির আসল নাম জানতে পারলাম। নাম আমানুল হক। ইউপির ছেলে। খুবই ছেলেবেলায় কলকাতায় চলে এসেছিলেন। এসেছিলেন কবিতা লিখতে। কলকাতায় এলে নাকি ভালো করে কবিতা লেখা যাবে, কিন্তু এসে দেখেছিলেন, এই শহর তো কবিতার শহর নয়Ñ এ শহর শুধু ইট-কাঠ-পাথরের শহর। কঠিন বাস্তবের শহর। সেদিন কীভাবে যেন আশ্রয় পেয়েছিলেন অমর মল্লিক আর ভারতীদেবীর কাছে। মাস্টারজি বসেছিলেন একদিনÑ ওঁরাই আমার মা-বাবার মতো ছিলেনÑ ওঁরাই একদিন এই মাস্টারজির বিয়ে দিয়েছিলেন এক হিন্দু-বাঙালি মেয়ের সঙ্গে!...
এই ছবিতেই প্রথমে অভিনয় করতে এলেন সুপ্রিয়া। ডাক নাম বেণু।
সুপ্রিয়া ব্যানার্জি এসেছিলেন আমার ছোট বোনের ভূমিকায় অভিনয় করতে। নবাগতা হিসেবে তিনিও সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। মনে পড়ে, মনে পড়ে অনেক স্মৃতিতে ঘেরা আমার হারানো অতীত।
বড় বেশি করে মনে পড়ে আনন্দবাজার পত্রিকার সমালোচনা স্তম্ভ। বসু পরিবারের সমালোচনায় আমার প্রসঙ্গে আনন্দবাজারের সেদিনের সমালোচনা।
Ñসুখেনের ভূমিকায় উত্তমকুমার মনে ধরার মতো চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেনÑ
সেদিন থেকে হলো আমার নবজন্ম। আমি আগামী দিনের প্রতীক্ষায় রইলাম। মনে মনে সাধনা করে চললাম। পূজা করে চললাম অভিনয়-শিল্পের। অর্ঘ্য সাজালাম আগামী দিনের দর্শকদের জন্য।
ছবি তখনও চলছে। এদিকে আমি যেন আর পোর্ট কমিশনার্সের চাকরিতে মন বসাতে পারছি না।
সব কথা গৌরীকে খুলে বললাম। বললাম, গৌরী, এভাবে অফিসের কাজে যে আর ফাঁকি দিতে পারি নেÑ আমি চাকরিটা ছেড়ে দিতে চাইÑ ভবিষ্যতে যদি হেরে যাই তুমি আঘাত পাবে না তো?
গৌরী বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে বলেছিল, তোমার ব্যর্থতা-আমার ব্যর্থতা, তোমার সাফল্যÑ আমার সাফল্য। সুতরাং আঘাতের কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
চাকরিটা ছেড়ে দিলাম। যে চাকরিটা একদিন অনেক চেষ্টা করে পেয়েছিলাম, সেই চাকরি আমি মুহূর্তে ছেড়ে দিলাম। চাকরিটা ছাড়তে গিয়ে সেদিন যে ব্যথা আমি পেয়েছিলাম তা আজ আর বলে কোনো লাভ নেই।
এটাই চরম সত্য যে আমি আর ফিরে যেতে পারিনি। আমি নিজের মনের কাছে দিন দিন অপরাধী হয়ে যাচ্ছিলাম। পোর্ট কমিশনার্সের চাকরির সঙ্গে আর বিশ্বাসঘাতকতা করা চলে না। চলতে দেওয়া উচিত নয়।
শেষ হয়ে গেল আমার কেরানি জীবন।