১৯৬০ সালে স্বাধীনতা লাভের পরে ইকব মানুষেরা বাণিজ্য সরকারি খাতসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। ইউরুবা, হুচা ও ইকব এই তিন বৃহত্তম জাতি গঠনের প্রাধান্য বিস্তারের লড়াই চলছিল। আচিবি মনে করেন তাদের সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে অন্তর্গত মানসিক গণন্ত্রাতিক মূল্যবোধ রয়েছে। যা নাইজেরিয়ার অর্থনৈতিক আধুনিকায়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাই ইকব মানুষের প্রাধান্য তিনি স্বীকার করেছিলেন। কিন্তু বহু নাইজেরিয় এই ইকব প্রাধান্য মানতে নারাজ ছিলেন। আচিবিও স্বীকার করেছেন ইকব মানুষেরা আত্মগর্ব সম্পন্ন হটকারী এবং বস্তুবাদী হতে পারেন। কিন্তু পৃথিবীর সব ইকব মানুষেরা একত্রিত হয়ে অবশিষ্ট নাইজেরিয়দের উপরে প্রাধান্য বিস্তারের পরিকল্পনা রয়েছে যা সন্দহ করা হতো তা তিনি নাকচ করেছিলেন।
প্রতিপক্ষ জনগোষ্ঠীর সন্দেহ ছিল ইকব মানুষদের মধ্যে ব্যক্তিবাদ কায়েম করা ব্যক্তির প্রতি স্তুতি খুব শক্তিশালী ছিল।
স্বাধীনতার মাত্র ৬ বছর পরে দুর্নীতি এবং ভয়ঙ্কর নির্বাচন কারচুপির প্রেক্ষিতে নাইজেরিয়ার তার প্রথম সামরিক অভ্যুত্থান প্রত্যক্ষ করেছিল। আর সেই অভ্যুত্থানে দেশটির প্রথম মুসলিম প্রধানমন্ত্রী আবু বকর তাফুয়া ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন। যদিও সামরিক অভ্যুত্থানকারীদের অধীকাংশই ইকব জনগোষ্ঠীর ছিলেন। কিন্তু আচিবি তাই বলে একে একটি ইকব অভ্যুত্থান বলতে নারাজ ছিলেন। তার আংশিক কারণ ছিল এই যে, অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী মেজর নিয়গু দেশের উত্তর অঞ্চলে বেড়ে উঠেছিলেন। তিনি ছিলেন নামমাত্র ইকব। কিন্তু যখন নাইজেরিয় উত্তর অঞ্চলিয় নেতৃবৃন্দ নিহত হলেন তখন তা বয়ে আনল রক্তক্ষয়ী সংঘাত। উত্তরাঞ্চলে বসবাসরত ত্রিশ হাজার ইকব নিহত হলেন। আর সেই রক্তস্নানকে পেছনে রেখে ১৯৬৭ সালে জেনারেল এমেকা ঘোষণা দিলেন যে দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে বসবাসরত ইকব জনগোষ্ঠী আর এমন একটি দেশের নাগরিক হিসেবে নিজেদের যুক্ত রাখবে না। যেখানে ইকব মানুষকে অবাঞ্ছিত মনে করা হয়।
গার্ডিয়ান নিবন্ধে এরপর বলা হয়েছে, জেনারেল এমেকা নেতৃত্বাধীন ওই আন্দোলন সামরিক শক্তি দিয়ে প্রতিহত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। আর তখন নিজের তেলের স্বার্থ রক্ষায় উদগ্রিব যুক্তরাজ্য সরকার ইকব জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। এসব ঘটনায় সংঘুব্ধ লাগোসে কর্মরত আচিবি চাকরি ছাড়েন এবং তিনি ফিরে আসেন দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে বসবাসরত তার পরিবারের মাঝে। এলাকাটি তখন স্বাধীন বায়াফ্রা প্রজাতন্ত্রের অন্তর্গত বায়াফ্রার জনগণকে পর্যুদস্থ করতে নাইজেরিয় সেনাবাহিনী তখন বাংলাদেশের ইতিহাসের ২৫শে মার্চের মতো নিষ্ঠুর অপারেশন সার্চ লাইট পরিচালনা করতে শুরু করেছিল। আর বায়াফ্রার জনগণ যাদের সহায়-সম্পদ প্রস্তুতি বলে কিছু ছিল না তারা তাদের ভাষায় দখলদার হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে সর্বাত্মক প্রতিরোধ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আচিবির বর্ণনায় বায়াফ্রার মুক্তিকামী জনগণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় তখন সামরিক কাজে ব্যবহার উপযোগী ট্যাঙ্ক তৈরি করেছিল। শত্রুর মোকাবিলায় তৈরি করেছিল বাকেট বোমা। আচিবি যদিও সহিংসতার নিন্দা করেছিলেন কিন্তু স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অনুশোচনা করেছেন এই বলে এই কি আমার দেশের সেই জনগণ। যারা একদিন জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল তারা এখন দুর্নীতির পঙ্কে নিমজ্জিত হয়েছে।
তিনি তার স্মৃতিকথায় প্রধানত একটি নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে নিরপেক্ষভাবে একটি ঐতিহাসিক ঘটনাবলির বিশ্লেষণ করেছেন। বায়াফ্রার মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে দুটি জীবন্ত বিবরণী আচিবি চিত্রিত করেছেন। স্যেন্ডহাস্ট প্রশিক্ষিত দুই তরুণ তাদের একজন ওজুকু এবং নাইজেরিয় প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াকুবু ওই বিবরণ দিয়েছেন। অনভিজ্ঞতার কারণে এই দুই নেতা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনঃগঠনে যথাসময়ে যথা সুযোগ কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছেন। তারা সংঘাত বন্ধ করতে পারেননি আচিবি বায়াফ্রার কূটনৈতিক রাফকে উদ্ধৃতি করে বলেছেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা ওজুকু বাস্তবসম্মত পথ অনুসরণ করার বদলে তিনি ইগোকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। বাস্তবতার ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছিলেন মতাদর্শ রাজনীতিকে। সুতরাং যুদ্ধের পরে যখন খাদ্যের অভাব দেখা দিলো আর বৃটেন খাদ্য সরবরাহের হাত বাড়িয়ে দিলো তখন তা তারা প্রত্যাখ্যান করলো।
আচিবি তার বইয়ের পরের চ্যাপ্টারগুলোতে তার ব্যক্তিগত গল্প শুনিয়েছেন। যুদ্ধ সত্ত্বেও তিনি লক্ষণীয়ভাবে একটি ফলপ্রসূ জীবন বেছে নিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে একজন লেখকের রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকে আর সেটা পূরণ করতে তিনি বায়াফ্রা স্বাধীনতা আন্দোলনের মুখপাত্র হিসেবে একজন আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রদূত হয়ে উঠেছিলেন। কানাডা, সেনেগাল সফর করে বায়াফ্রার স্বাধীনতা আন্দোলনের সপক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে ভূমিকা রেখেছিলেন। এ সময় তিনি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ক্রীস ওকিগব একটি প্রকাশনা সংস্থা খুলেছিলেন। এই প্রকাশনা সংস্থা থেকে মুক্তিযুদ্ধকালীন পুস্তক ও লিফলেট ছাপা হতো। এভাবে আচিবি লিখে ফেলেছিলেন স্বাধীনতার ইসতিহার। এমনকি তিনি বায়াফ্রার তথ্য ও যোগাযোগ মন্ত্রী হয়েছিলেন। আচিবি নতুন জাতীরাষ্ট্রের জন্য যে বুদ্ধিভিত্তিক মতাদর্শ তৈরি করেছিলেন তাতে ঐতিহ্যগত ইকব দর্শন মার্কিন স্টাইলের উদার নৈতিকতা ও সমাজতন্ত্রের মিশেল ঘটেছিল।
আচিবি যুদ্ধকালে তার পিতার গ্রামে আশ্রয় নেয়ার আগ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় তাড়ার মুখে এক শহর থেকে আর এক শহর পালিয়ে বেড়িয়েছেন। নৃশংসতার ভয়াল স্মৃতি তাদেরকেও তারা করছে। একদিন একটি মার্কেটে আচিবির স্ত্রী কৃস্টি লক্ষ্য করেছিলেন যে বোমার আঘাতে একজন গর্ভবতী নারী দ্বিখণ্ডিত হয়েছেন। আচিবির এসব নৃশংসতার বিবরণ দিয়েছেন যার মধ্যে তার মা ও বন্ধুর সংক্ষিপ্ত বিবরণ রয়েছে। তবে, তার যুদ্ধকালীন ভয়ার্ত অভিজ্ঞতা এবং মর্মান্তিক স্মৃতি মূর্ত করে তুলেছেন তার কবিতায়। তার বিখ্যাত উদ্বাস্তু মা ও শিশু। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে তিনি প্রকাশ করেছিলেন ‘বি ওয়ার সোল ব্রাদার’ সাবধান অন্তরাত্মার ভ্রাতা। এটা কম তাৎপর্য নয় যে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম যখন বিশ্ব প্রত্যক্ষ করছে তখন তিনি প্রকাশ করেছিলেন ‘বি ওয়ার সোল ব্রাদার’।
বায়াফ্রার মুক্তিযুদ্ধ যে নৃশংসতার জন্ম দিয়েছিল তা বাংলাদেশের সংঘটিত মানবতা বিরোধী অপরাধের মতো বিশ্বে মানুষের দৃষ্টি আর্কষণ করেছিল। যুদ্ধকালীন ইকব জনগোষ্ঠীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল মানষিক স্বাস্থ্যের বৈকল্য। বায়াফ্রার আকাশে উড়েছিল শকুন। বায়াফ্রার সংঘাতটি প্রথম সংঘাত যা টিভি পর্দায় সম্পূর্ণ চিত্রিত হয়েছিল। দেশে দেশে মানুষ টিভি পর্দায় দেখেছিল যুদ্ধে নৃশংসতা। বায়াফ্রার মানুষের পক্ষে সবর হয়েছিলেন জোয়ান বায়েজ, জন লেলন, মার্টিন লুথার কিংস এবং কার্ল ফোনেগাতের মতো ব্যক্তিত্ব।
গার্ডিয়ানের এই তথ্য দেয়া হয়েছে ১৯৭০ সালে এই সংঘাত যখন শেষ হলো তখন দেখা গেল যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন ৩০ লাখ বায়াফ্রার নাগরিক আর কেন্দ্রীয় সরকারের নিহতের সংখ্যা ১ লাখ। আচিবি বাংলাদেশের পেক্ষাপটের মতোই দাবি করেছেন বায়াফ্রার স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছেন। তাদের কেবলি মৃতের সংখ্যা বিবেচনায় ভয়াবহতা নির্দেশ করা যাবে না। কারণ যারা শহীদ হয়েছেন। তারা গণহত্যার শিকার হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের নেতা ওযুকু রণাঙ্গন থেকে পালিয়ে পার্শ্ববর্তী আইভরিকোস্টে আশ্রয় নিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক হয়ে তিনি কিভাবে পালিয়ে যেতে পারলেন সেজন্য ব্যাপক সমালোচনার তীর তাকে ঠিকই বিদ্ধ করেছিল। তবে, আচিবি যুদ্ধের এই মহানায়কের এই পলায়নকে এই মর্মে যৌক্তিতকতা দেন যে তিনি যদি যুক্তকালে নাইজেরিয়ার অবস্থান করতেন তাহলে গোয়ান অপেক্ষাকৃত যুদ্ধ কম সহানুভূতিশীল থাকতেন এবং ইকব সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি কম সহানুভূতি দেখাতেন।
ইকব মানুষেরা যুদ্ধ শেষে যদিও নাইজেরিয় সমাজে পুনঃএকত্রিত হয়েছেন। তবে, আজও তারা অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার। উল্লেখ্য, যে জেনারেল ইয়াকুবু ১৯৬৭ সালে তিনি ফেডারেল মিলিটারি সরকারের প্রধান এবং সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হয়েছিলেন। ৩২ বছর বয়সেই তিনি ছিলেন আফ্রিকার নবীনতম রাষ্ট্রপ্রধান। ১৯৭০ সালে জানুয়ারিতে ৩০ মাসব্যাপী যুদ্ধ যখন শেষ হলো তখন ইয়াকুবু ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, এই যুদ্ধের কোনো বিজয়ী নেই এবং এজন্য যুদ্ধ পরবর্তীকালে কারো বিনাশসাধন ঘটবে না। এই চেতনার ভিত্তিতেই ইকব জনগোষ্ঠীকে মূল ধারায় আনার চেষ্টা করা হয়। থ্রি আর নীতির ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করায় চেষ্টা চলেছিল। এই তিনটি আর হলো রিহেবিলিটিশন, রিকনস্ট্রাকশন, এবং রিকন্সটয়শন।