জাল সনদের অভিযোগ দ্রুত নিষ্পত্তি ও হয়রানি কমাতে এবার ডিজিটাল পদ্ধতিতে এগুচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ)। এজন্য প্রত্যেক বোর্ড ও বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষক নিবন্ধন দেয়া প্রতিষ্ঠানের প্রবেশাধিকার চায় সংস্থাটি। কারও সনদ সন্দেহ ও যাচাই করার প্রয়োজন হলে ডিআইএ সরাসরি এসব প্রতিষ্ঠানের ওয়েব সাইটে প্রবেশ করে যাচাই করে নেবে। প্রতিষ্ঠানের পরিদর্শনের জন্য নতুন অটোমেশন সফটওয়্যারে এ সংক্রান্ত প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে। এখন থেকে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ এক মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে মন্ত্রণালয় চার সদস্যের উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। শিক্ষকরা চূড়ান্তভাবে নির্দোষ প্রমাণিত হলে ভোগান্তির শিকার হতে হবে না। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের যুগ্ম সচিব (আইন ও অডিট) শামিম আল রাজির সভাপতিত্বে গত ১৩ই মার্চ একটি সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। শামিম আল রাজিকে কমিটির আহ্বায়ক, উপ-সচিব (কলেজ), উপ-সচিব মাধ্যমিককে সদস্য ও উপ-সচিবকে (অডিট) কমিটির সদস্য সচিব করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে ডিআইএ যুগ্ম পরিচালক বিপুল চন্দ্র সরকার বলেন, প্রতিষ্ঠান অডিট করতে গিয়ে প্রচুর জাল সনদ ধরা পড়ছে। দিন দিন এ সংখ্যা বাড়ছে। এতে জাল সনদের ব্যাপারে উদ্বেগ বাড়ছে। এনালগ পদ্ধতিতে যাচাই করতে গিয়ে অনেক সময় লেগে যাচ্ছে। এতে রিপোর্ট করা ও অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হচ্ছে। তাই বোর্ড-বিশ্ববিদ্যালয়সহ যেসব সংস্থা শিক্ষকদের সনদ দেয়, ওই সব সংস্থা থেকে যাচাই করতে ডিআইএ সরাসরি ক্ষমতা চেয়েছে।
অটোমেশন সফটওয়্যারে শিক্ষা মান ও শিক্ষকদের ক্লাসের পারফরমেন্স যাচাইয়ের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এ সফটওয়্যারের মাধ্যমে শিক্ষকরা ক্লাসে কী ধরনের পাঠদান দেয়া হয় তাও যাচাই করতে পারবে এ সফটওয়্যার। ডিআইএ কর্মকর্তারা জানান, এ সফটওয়্যার উদ্ধোধন হওয়ার পর শিক্ষকরা আগামীকাল কোন বিষয়ে ক্লাস নেবেন, সে ক্লাস লেকচার স্কুলের ওয়েবসাইটে দিতে হবে। শিক্ষার্থীরা এটার ওপর পড়াশোনা করে পরের দিন ক্লাসে আসবে। আর ডিআইএ মাঝেমধ্যে স্কুলের ওয়েব সাইটে ঢুকে ক্লাস লেকচার পর্যবেক্ষণ করবেন। সেক্ষেত্রে যদি পর্যবেক্ষণ থাকে সেটিও শিক্ষকদের আউটপুট দেয়া হবে। অর্থাৎ ক্লাসের লেকচার মনিটরিং করবে ডিআইএ।
এ ব্যাপারে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের উপসচিব (অডিট) ও কমিটির সদস্য সচিব মো. রাহেদ হোসেন বলেন, ডিআইএর প্রতিবেদন নিষ্পত্তির দীর্ঘসূত্রতা কমানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এতে অনেকের এমপিও স্থগিত, কারও অবসর সুবিধাও আটকে আছে। তাই অভিযোগ দ্রুত নিষ্পত্তি করতে এ কমিটি করা হয়েছে। কমিটির কাজ হলো- প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এক মাসের মধ্যে বাস্তবায়ন করা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ডিআইএর প্রতিবেদন বাস্তবায়ন করতে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্বান্ত হয়েছে ওই সভায়। এগুলো হলো- প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী অবৈধভাবে এমপিও গ্রহণ বা আর্থিক দুর্নীতির অর্থ এক মাসের মধ্যে সরকারি কোষাগারে ফেরত দিতে হবে। জাল ও ভুয়া সনদে চাকরি করা এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের কারণ দর্শাতে হবে। জবাব সন্তোষজনক না হলে এমপিও বন্ধ ও এক মাসের মধ্যে অর্থ ফেরত দিতে হবে। বর্তমানে ডিআইএ প্রতিবেদনের আলোকে মন্ত্রণালয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছে ব্রডশিটের মাধ্যমে জবাব চায়। তারা দায়সারা জবাব দিতো। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) যাচাই-বাছাই না করেই প্রতিষ্ঠানের জবাবের সঙ্গে একমত হয়ে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠাতো। এর ফলে দুর্নীতিবাজ শিক্ষকরা ছাড় পেয়ে যেতো। অবৈধভাবে সরকারের কোটি কোটি টাকা ভোগ করতো শিক্ষক-কর্মচারীরা। এই পথ বন্ধ করতে মাউশির কাছে বিধি অনুযায়ী জবাব চাইবে কমিটি। এক মাসের মধ্যে তা নিষ্পত্তি করবে।
ডিআইএ কর্মকর্তারা জানান, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন ডিআইএর কর্মকর্তারা প্রশাসনিক, আর্থিক ও একাডেমিক- এই তিনটি বিষয়ে ৩৬ হাজার এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন ও নিরীক্ষা করে। ২০১৪ সাল থেকে পরিদর্শন করতে গিয়ে শিক্ষকদের সনদ যাচাই করা হচ্ছে। মন্ত্রণালয়, মাউশি, এনটিআরসিএ-এর এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে জাল সনদে এমপিভুক্ত হয়েছেন হাজারও শিক্ষক। গত আড়াই বছরে সাত শতাধিক জাল সনদে চাকরি করা শিক্ষককে চিহ্নিত করেছেন ডিআইএর কর্মকর্তারা। এরমধ্যে কম্পিউটার, লাইব্রেরিয়ান এবং বিএড এই তিন বিষয়ের শিক্ষক বেশি। বেতন-ভাতা হিসেবে তারা প্রায় ১৭ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এই টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত দেয়ার সুপারিশ করে ডিআইএ। এছাড়া বিভিন্ন আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে হাতিয়ে নেয়া অর্থ ফেরতেরও সুপারিশ করে। কিন্তু মন্ত্রণালয় ও মাউশির একটি চক্র অভিযুক্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ায় সরকারের বিপুল পরিমাণ অর্থ গচ্ছা যাচ্ছে।