বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য সকল রাজনৈতিক দল, ধর্ম, বর্ণ, ব্যক্তি ও সংগঠনকে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের আহ্বান জানিয়েছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেছেন, আসুন দেশনেত্রীকে মুক্ত করার জন্য, দেশের মানুষের অধিকার, ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করি। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে পূর্বঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে গতকাল নয়াপল্টন দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এক মানববন্ধনে তিনি এ আহ্বান জানান।
বিএপি’র কেন্দ্র ঘোষিত এ কর্মসূচি বেলা ১১ টা থেকে ১২ টা পর্যন্ত পালন করার কথা থাকলেও সকাল ১০ টার পর থেকে নেতাকর্মীরা কার্যালয়ের সামনে জড়ো হতে শুরু করে। এ সময় তারা খালেদা জিয়ার ছবি সম্বলিত প্ল্যাকার্ড নিয়ে ‘খালেদা জিয়ার মুক্তি চাই, মুক্তি চাই’, ‘খালেদা জিয়ার কিছু হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে’- ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকেন। ১১ টায় দলের মহাসচিবসহ সিনিয়র নেতারা মানববন্ধনে যোগ দেন। এর আগে রোববার খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে ৮ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করে বিএনপি। এর মধ্যে ওইদিন রোববার বিকালে রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় ঢাকা মহানগর উত্তর ও সোমবার বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেটে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিক্ষোভ মিছিল করে।
মানববন্ধনে সভাপতির বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আগামী নির্বাচনের জন্য একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে হবে। দেশনেত্রী খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে হবে। সমস্ত রাজবন্দিদের মুক্তি দিতে হবে, মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। নির্বাচনের আগে পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হবে। তাহলেই শুধুমাত্র একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রেক্ষাপট তৈরি হবে। তিনি বলেন, এই মানববন্ধনের মধ্য দিয়ে গোটা জাতি ও সরকারকে জানাতে চাই- অন্যায়ের বিরুদ্ধে গোটা জাতি আজ ঐক্যবদ্ধ। অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলে খালেদা জিয়া ও গণতন্ত্রকে মুক্ত করা হবে।
এ সময় তিনি সকল রাজনৈতিক দল, বর্ণ, ধর্ম, ব্যক্তি ও সংগঠনকে গণতন্ত্র মুক্ত করার জন্য ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে শামিল হওয়ার আহ্বান জানান। মির্জা আলমগীর বলেন, প্রায় আড়াই মাস হতে চললো খালেদা জিয়াকে অন্যায়ভাবে আটক রেখেছে ফ্যাসিবাদী ও স্বৈরাচারী সরকার। তাকে এমন একটি পরিত্যক্ত কারাগারে রাখা হয়েছে যেখানে কেউ বসবাস করে না। একটি স্যাঁতসেঁতে কক্ষে খালেদা জিয়াকে রাখা হয়েছে। যেখানে তিনি প্রতিদিন অসুস্থ হচ্ছেন। প্রতিদিন ক্রমান্বয়ে তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ছে। ১৪ দিন ধরে তাঁর পরিবারের সদস্যরা এবং আমরা কেউ সাক্ষাৎ করতে পারিনি। শুধুমাত্র মঙ্গলবার খালেদা জিয়ার পরিবারের সদস্যরা দেখা করতে পেরেছেন। তাদের মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি দেশনেত্রী এতোই অসুস্থ যে, দোতলা থেকে নিচতলা পর্যন্ত নেমে আসতে পারছেন না। আমরা বারবার বলেছি তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসকদের মাধ্যমে বিশেষায়িত হাসপাতাল, বিশেষ করে ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া প্রয়োজন। কারণ যে ধরনের এমআরআই করা দরকার তা বাংলাদেশে একমাত্র ইউনাইটেড হাসপাতালে রয়েছে। তার দুই হাঁটুতে আর্টিফিশিয়াল মেটালিক প্রতিস্থাপন করা আছে।
সরকারকে এতো কিছু বলার পরও খালেদা জিয়ার পছন্দমতো ব্যক্তিগত চিকিৎসকদের মাধ্যমে চিকিৎসার সুযোগ দিচ্ছে না। বিএনপি মহাসচিব বলেন, আমাদের উচ্চ পর্যায়ের একটি টিম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছেন। অথচ এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। আমরা জানি ক্ষমতা হারানোর ভয়ে এই সরকার আতঙ্কিত। যদি খালেদা জিয়া কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বাইরে থাকেন তাহলে গণতন্ত্রের মুক্তির আন্দোলন কোনোভাবেই প্রতিরোধ করতে সক্ষম হবে না তারা। তাদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী হবে। তিনি বলেন, সরকার বিভিন্ন প্রকার মিথ্যা প্রচারণার মাধ্যমে আমাদের নেতা-কর্মীদের অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠাচ্ছে। আজকের এই মানববন্ধনের অনুমতি দেয়ার পরও পুলিশের আচরণ গণতন্ত্রের পক্ষে নয়। এই অবস্থার প্রেক্ষিতে আমাদের একমাত্র দায়িত্ব হল ঐক্যবদ্ধ থাকা।
আমাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধ থেকে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দেশনেত্রীকে মুক্ত করতে হবে। মির্জা আলমগীর বলেন, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। আমরা গতকালও বলেছি, আজকেও বলছি এই বিতর্ক সৃষ্টি করে সরকার নিজেরাই নিজেদের গহ্ববরে পড়েছে। কারণ কোন মতেই বৃটিশ আইনে নাগরিকত্ব বর্জনের কোনো কারণ নেই। নাগরিকত্ব কখনো কেউ বর্জন করে না। সব সময়ই নাগরিকত্ব রেখেই রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করে। তারেক রহমানও সেটাই করেছেন। অথচ এটা নিয়ে সরকার মিথ্যা প্রচারণা চালিয়েছে যে, তারেক রহমান তার নাগরিকত্ব বাতিল করেছেন। কিন্তু তিনি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বর্জন করেননি। সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশের নাগরিক ছিলেন, আছেন এবং ভবিষ্যতেও থাকবেন।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, খালেদা জিয়াকে রাজনৈতিকভাবে হয়রানি ও নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে মিথ্য মামমলায় সাজা দিয়ে কারাগারে আটক রেখেছে সরকার। কারণ সরকার ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির মত আরেকটি প্রতারণার নির্বাচন করতে চায়। গত নির্বাচন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী দেশের মানুষ এবং বিদেশিদের সঙ্গেও প্রতারণা করেছেন। কিন্তু এবার তাদের সে স্বপ্ন পূরণ হবে না। বিএনপি ও খালেদা জিয়াকে বাইরে রেখে দেশে কোনো নির্বাচন হবে না, হতে দেয়া হবে না। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সংসদ ভেঙে সবার অংশ গ্রহণে নির্বাচন করতে বাধ্য করা হবে। অর্থাৎ আগামী নির্বাচন হবে সংসদ ভেঙে দিয়ে নিরপেক্ষ সরকারেরে অধীনে। স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, দেশের কোথাও আমাদের কথা বলার অধিকার নেই, কথা বলার জায়গা নেই। আমরা কোথাও সভা-সমাবেশ করতে চাইলে অনুমতি দেয়া হয় না। কোথাও সভা-সমাবেশ করতে চাইলে আমাদের উপর হামলা নির্যাতন করা হয়।
নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আপনারা নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে সবাইকে সংগঠিত করুন। এইভাবে আপনারা যার যার এলাকায় সুসংগঠিত হয়ে প্রস্তুত থাকুন। সময় আসবে আমাদের রাজপথে কঠোর আদোলন করার। তখন আমাদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে এ সরকারকে পরাজিত করে গণতন্ত্র ও মানুষের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনতে হবে। গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে এই স্বৈরাচার সরকার ভেসে যাবে। বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুুদ চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে এখন একটি স্বৈরশাসক দেশ পরিচালনা করছে। যাদের কাছে বিরোধী দলের কোনো রাজনৈতিক স্বাধীনতা নেই। তারা বিএনপিসহ বিরোধী দলকে কোনো সভা-সমাবেশ করতে দিচ্ছে না। সব নাগরিক অধিকার কেড়ে নিয়েছে।
আমাদের রাস্তায় দাঁড়াতে দেয়া হয় না। সরকারের অপশাসনে বাংলাদেশ আজ বিশ্বে স্বৈরাচারী দেশে পরিণত হয়েছে। বর্তমান সরকারের দুঃশাসন দীর্ঘ করতে দেশের সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দেশকে বিকলাঙ্গ করেছে। বর্তমান সরকার আইয়ুব খানের পথ অনুসরণ করছে। ১৯৬৮ সালে আইয়ুব খান সরকারও উন্নয়নের মিছিল করেছিল। তারপরও ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। শেখ হাসিনা সরকারও উন্নয়নের মিছিল করেছে। এবার গণতন্ত্র ফিরে আসবেই। আমাদের বিজয় সুনিশ্চিত। বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে।
এখন আর পেছনে ফেরার সুযোগ নেই। দেশনেত্রীর মুক্তির দাবির এই কাফেলায় সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। বিএনপি আয়োজিত এ মানববন্ধনে বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, মো. শাহজাহান, আবদুল আউয়াল মিন্টু, ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, আহমেদ আযম খান ও আবদুল মান্নান বক্তব্য দেন।
এছাড়া চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান, আবদুল হাই, জয়নুল আবদিন ফারুক, হাবিবুর রহমান হাবিব, আবুল খায়ের ভূঁইয়া, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবির খোকন, সাংগঠনিক সম্পাদক এমরান সালেহ প্রিন্স, বিএনপি’র ক্রীড়া সম্পাদক ও জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক আমিনুল হক, স্বনির্ভর বিষয়ক সম্পাদক শিরিন সুলতানা, প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক এবিএম মোশাররফ হোসেন, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক এডভোকেট আবদুস সালাম আজাদ, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রশিদ হাবিব, সহ-যুব বিষয়ক সম্পাদক মীর নেওয়াজ আলী নেওয়াজ, সাবেক এমপি নাজিমুদ্দিন আলম, স্বেচ্ছাসেবক দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান, সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক সাইফুল ইসলাম ফিরোজ, সাংগঠনিক সম্পাদক ইয়াসিন আলী, যুবদলের সিনিয়র সহ-সভাপতি মোরতাজুল করিম বাদরু, সিনিয়র যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম নয়ন, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক নজরুল ইসলাম আজাদ, মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক সুলতানা আহমেদ, ছাত্রদলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মামুনুর রশিদ, সহ-সভাপতি আলমগীর হাসান সোহান, আতিক আল হাসান মিন্টু, যুগ্ম সম্পাদক মফিজুর রহমান আশিক প্রমুখ।
এদিকে বিএনপি’র মানববন্ধন এ কর্মসূচি ঘিরে সকাল থেকেই দলটির নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে অতিরিক্ত পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ছিলেন সতর্ক অবস্থানে। ওদিকে গ্রেপ্তার এড়াতে মানববন্ধন কর্মসূচির শেষদিকে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রশিদ হাবিবসহ বিএনপি ও অঙ্গদলের মাঝারি সারির নেতারা দ্রুত নয়াপল্টন ত্যাগ করেন।