× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার , ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৭ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

রাশিয়ায় জালিয়াতির প্রশিক্ষণ, ঢাকায় কোটিপতি হওয়ার মিশন

প্রথম পাতা

স্টাফ রিপোর্টার
২৬ এপ্রিল ২০১৮, বৃহস্পতিবার

লেখাপড়ার উদ্দেশে রাশিয়া গিয়েছিলো মেহেরপুরের শরিফুল ইসলাম। ৩০ বছর বয়সী এই তরুণ ২০০৩ সালে উচ্চতর ডিগ্রির জন্য রাশিয়ার পিপলস ফ্রেন্ডশিপ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি কোর্সে ভর্তি হয়। যোগ্যতা অর্জন করে দেশে ফেরার কথা থাকলেও সে ফিরে জালিয়াতির প্রশিক্ষণ নিয়ে। ঢাকা ফিরে বিভিন্ন ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড      জালিয়াতি করে টাকা কামানোর মিশনে নেমেছিলো। জালিয়াতির সুযোগ নিতে কাজ করেছে বিভিন্ন সুপার শপে।

সর্বশেষ ছিল চেইন শপ স্বপ্নের বনানী শাখায়। সুপার শপে ক্রেডিট কার্ডে কেনাকাটা করা ক্রেতাদের কার্ডের তথ্য ডিজিটাল হাতঘড়ির মাধ্যমে সংগ্রহ করতো শরিফুল। পরে কার্ড ক্লোন করে ব্যাংকের বুথ থেকে টাকা তুলে নিতো।
বিভিন্ন ব্যাংকের অন্তত ১৪০০ ক্রেডিট কার্ড তৈরি করে সে এ জালিয়াতি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। সুপার শপে চাকরি করলেও তার ছিল বিলাসবহুল গাড়ি। জীবনযাপনও ছিল বিলাসী। মঙ্গলবার পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের হাতে ধরা পড়ার পর পাওয়া গেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য। রাশিয়া থেকে দেশে ফিরে চট্টগ্রামের একটি সুপার শপে চাকরি নিয়েছিলো শরিফুল। সেখান থেকেই কার্ড জালিয়াতি শুরু। জালিয়াতি করে ধরা পড়ে যায় জেলে। দীর্ঘ ১৮ মাস কারাভোগের পর ঢাকায় এসে শুরু করে আদম ব্যবসা। ব্যবসায় ব্যর্থ হয়ে ফের নামে কার্ড জালিয়াতিতে। কয়েকটি খ্যাতনামা সুপার শপে চাকরি নেয় বিভিন্ন সময়ে। সর্বশেষ স্বপ্নের বনানী আউটলেটে চাকরি করার সময় হাতিয়ে নেয়া গ্রাহকের তথ্য ব্যবহার করে টাকা উত্তোলন করে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে। স্বপ্নের কয়েকজন গ্রাহক তাদের অজান্তে কার্ডের মাধ্যমে টাকা উত্তোলন হয়েছে বলে অভিযোগ করেন কর্তৃপক্ষের কাছে। ওই শপের কর্মী শরিফুল কার্ডপাঞ্চ করার সময় স্লিপে গ্রাহকের তথ্য লিখে রাখতো বলেও তারা অভিযোগ করেন। এ অভিযোগ পেয়ে শরিফুলের সঙ্গে স্বপ্ন কর্তৃপক্ষ যোগাযোগ করার পর থেকেই লাপাত্তা হয় সে।

গ্রেপ্তারের পর সিআইডির জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এসেছে জালিয়াতির চাঞ্চল্যকর তথ্য। শরিফুল জানিয়েছে, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাশিয়ান নাগরিক ইভানোভিচের সঙ্গে একই কক্ষে থাকতো। রুমমেট ইভানোভিচের কাছ থেকেই আয়ত্ত করে কার্ড জালিয়াতির কলা-কৌশল। শরিফুল ইসলাম ২০১০ সালে দেশে ফিরে এসে চাকরি নেয় চট্টগ্রামের একটি সুপারশপে। উদ্দেশ্য ছিল কার্ড জালিয়াতি। অনেকটা সফলও হয়েছিলো। সুপারশপে আগত ভিআইপি ক্রেতাদের টার্গেট করে। হাতিয়ে নেয় বেশ কিছু টাকা। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। টের পেয়ে গ্রাহকরা অভিযোগ করেন সুপারশপে ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে। পুলিশের কাছে ধরা পড়ে যান জেল হাজতে। ২০১৩ সালে তার বিরুদ্ধে দুইটি মামলা হয়। এসব মামলায় দীর্ঘ ১৮ মাস জেল খাটে।

এরপর স্টুডেন্টস কনসালটেন্সি ফার্ম খুলে। কিছু দিন ব্যবসা করার পর সুবিধা করতে পারেনি। ফের পরিকল্পনা করে কার্ড জালিয়াতির। সেই লক্ষ্যেই নামকরা সুপারশপে চাকরির তদবির শুরু করেন। একে একে চাকরি করে নামকরা অনেক সুপারশপে। আর সুযোগ বুঝেই সুপারশপে আগত গ্রাহকের কার্ডের যাবতীয় তথ্য ও পিন নম্বর ক্লোন করে হাতিয়ে নেয় টাকা। এভাবেই শরিফুল অল্প দিনেই হয়ে যায় কোটিপতি। চলাফেরা করতো দামি গাড়িতে। থাকতো অভিজাত বাসায়। গতকাল সিআইডির প্রধান কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম এসব তথ্য তুলে ধরার সময় সুপার শপ স্বপ্ন ও কয়েকটি ব্যাংকের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিল।  

সিআইডি জানিয়েছে, ২৮শে ফেব্রুয়ারি সুপারশপ স্বপ্নে চাকরি নিয়েছিলেন শরিফুল ইসলাম। অভিজাত এলাকা বনানীর একটি শাখায় কাজ করতো। ১০ই মার্চ গ্রাহকের কার্ড ক্লোন করে বিভিন্ন ব্যাংকের বুথ থেকে শরিফুল প্রায় ২০ লাখ টাকা তুলে নেয়। এর আগে ৯ই মার্চ থেকে স্বপ্নের অফিসে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। কারণ এর আগেই তার গতিবিধি ধরা পড়ে যায় স্বপ্নের অন্য কর্মচারীদের কাছে। এক গ্রাহকের এটিএম কার্ডের পিন নম্বর হাতে লেখার সময় তার গতিবিধি ধরা পড়ে। তখন স্বপ্ন কর্তৃপক্ষের কাছে ওই গ্রাহক অভিযোগ করেছিলেন। অভিযোগ পেয়ে শরিফুলকে আর খুঁজে পায়নি স্বপ্ন কর্তৃপক্ষ। তখন থেকে তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। পরে বিষয়টি সিআইডিকে জানালে, দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর তাকে মঙ্গলবার আটক করা হয়। এসময় তার কাছ থেকে একটি এলিয়ন গাড়ি,  ১টি ল্যাপটপ, ক্লোন করা ১ হাজার ৪০০ কার্ড, একটি ম্যাগনেটিক স্ট্রিপ কার্ড রিডার ও রাইটার, তিনটি পজ মেশিন, গ্রাহকের তথ্য চুরিতে সচল ডিজিটাল হাতঘড়ি, দুটি মিনি কার্ড রিডার ডিভাইস, ১৪টি পাসপোর্ট,  ৮টি মোবাইল ফোন সেট, ডাচ্‌ বাংলা ব্যাংকের কার্ড ও তিনটি জাতীয় পরিচয়পত্র উদ্ধার করা হয়।  

সিআইডি আরো জানায়, মূলত সে একটি বিশেষ ডিজিটাল হাতঘড়ি দিয়ে গ্রাহকের এটিএম কার্ডের তথ্য সংগ্রহ করতো। পরে এ তথ্য দিয়ে কার্ড ক্লোন করতো। কার্ড তার হাতে আসার পর সেই কার্ডটি তার হাতে থাকা বিশেষ ঘড়িতে তিন বার স্ক্যান করাতো। আর স্ক্যানের কাজটি কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সম্পন্ন করতো। এটিএম কার্ড স্ক্যানের সঙ্গে সঙ্গে ওই কার্ডের যাবতীয় তথ্য শরিফুলের আয়ত্তে চলে যেত। এমনকি গ্রাহক যখন তার এটিএম কার্ডের পিন নম্বর দেয়ার জন্য পজ মেশিনের বাটন চাপতেন তখন সেই পিন নম্বরও কৌশলে সে নিয়ে নিতো। পরে গ্রাহককে দেয়া মানি রিসিট রি-প্রিন্ট দিয়ে সেই পিন নম্বর লিখে রাখতো আবার কখনো হাতের মধ্যে সেই পিন লিখে রাখতো। পরে চায়না মার্কেট থেকে আলীবাবার মাধ্যমে আনা ক্লোন মেশিন দিয়ে এটিএম কার্ড ক্লোন করে  এবং ভার্জিন কার্ডে তা স্থাপন করে নিতো। সিআইডি বলছে, শরিফুল এখন পর্যন্ত ব্র্যাক ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, ইবিএল, ইউসিবিএল ও ব্যাংক এশিয়ার গ্রাহকদের কার্ড জালিয়াতি করেছে। তার ব্যাংক হিসাবে বিভিন্ন সময় লেনদের হওয়া তথ্য যাচাই করে দেখা গেছে এখন পর্যন্ত কয়েক কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। তার একটি ব্যাংক হিসাবে ১৫ লাখ টাকা পাওয়া গেছে। বাকি টাকা কোথায় রয়েছে এখনো তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। শরিফুলের বিরুদ্ধে মিরপুর থানায় একটি প্রতারণা মামলা করা হয়েছে। আর যেহেতু টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে সেজন্য মানি লন্ডারিং ও ডিভাইস দিয়ে জালিয়াতি করার জন্য আইসিটি আইনে মামলা করার প্রস্তুতি চলছে। রিমান্ডে তার কাছ থেকে আরো তথ্য সংগ্রহের কথা জানিয়েছে সিআইডি।

মোল্যা নজরুল ইসলাম বলেন, অভিযোগের ভিত্তিতে শরিফুলকে পেতে আমাদের অনেক বেগ পেতে হয়। কারণ সে খুব ধুরন্ধর প্রকৃতির। সে যখন কার্ড দিয়ে বুথে টাকা তুলতে যেত তখন নানা কৌশল অবলম্বন করতো। তার চেহারা যাতে না চেনা যায় সেজন্য সে পরচুলা ও কালো সানগ্লাস ব্যবহার করতো। আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত শতাধিক ভুক্তভোগীর অভিযোগ জমা হয়েছে। মোল্যা নজরুল বলেন, প্রতারকের হাত থেকে বাঁচার জন্য গ্রাহকদের একটু সচেতন হতে হবে। এটিএম বুথ থেকে টাকা উত্তোলন বা সুপারশপে কেনাকাটা করার সময় কার্ডের পিন নম্বর দেয়ার সময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

গতকালের সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ব্র্যাক ব্যাংকের হেড অব কমিউনিকেশন জাবা জাবিন মাহবুব। তিনি জানান, বুথ থেকে টাকা উত্তোলনের সময় গ্রাহকের মোবাইলে এসএমএস চলে যায়। গ্রাহকের একের পর এক অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিষয়টি ব্যাংক কর্তৃপক্ষের নজরে আসে। পরে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকের সমস্ত টাকা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ দিয়ে দেয়। আর এখন থেকে আর যেন কোনো গ্রাহক প্রতারণার শিকার না হোন সেজন্য প্রতিটি কার্ডে ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি সিস্টেম করা হচ্ছে।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর