× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার , ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

গারোদের জীবন

বাংলারজমিন

ওমর ফারুক সুমন, হালুয়াঘাট (ময়মনসিংহ) থেকে
২৬ মে ২০১৮, শনিবার

ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী উপজেলা হালুয়াঘাটের আঁচকিপাড়া, ঝলঝলিয়া, জখমকূড়া, বুটিয়া পাড়া, গাবড়াখালি, ঘিলাভূই, নালিতাবাড়ীর পানিহাতা, বারোমারীসহ আশপাশের উপজেলার গারো আদিবাসীদের দিনকাল ভালো যাচ্ছে না। এসব সীমান্তের পাহাড়িয়া অঞ্চলের গারোদের জীবনমানে প্রতিনিয়ত চলছে বাঁচার লড়াই। কেউ নেয় না তাদের  খোঁজ-খবর। সরকার আসে সরকার যায় উন্নয়ন হয় অনেক কিছুর। কিন্তু সীমান্তবর্তী পাহাড়ি গারোদের ভাগ্যের কোনো উন্নয়ন হয় না- কথাগুলো আক্ষেপের সুরে বলেন হালুয়াঘাট উপজেলার কড়ইকান্দা গ্রামের গারো নারী ধরনী রিছিল। তার ভাষায় অভাব-অনটন, দুঃখ-দুর্দশাই যেন হালুয়াঘাট উপজেলার গারোদের নিত্যদিনের সঙ্গী। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের গারো পাহাড়ের পাদদেশে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্ত ঘেঁষে অবস্থিত পাহাড়ি জনপদ ময়মনসিংহ জেলার গারো পাহাড়। জানা গেছে, ময়মনসিংহ, শেরপুর ও  নেত্রকোনা জেলার ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী ও নালিতাবাড়ী, নেত্রকোনার দুর্গাপুর, ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া  উপজেলায় গারো, হাজং, কোচ, বানাই, হদি, বর্মন ও বংশীসহ বিভিন্ন জাতি-গোত্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী মিলে প্রায় ৫০ হাজার পরিবারের বসবাস।
এদের মধ্যে ৭০ ভাগ নৃতাত্ত্বিক পরিবারের সদস্যরা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। অথচ এককালে এদের সবকিছুই ছিল। ছিল  গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ, গোলা ভরা ধান। কিন্তু  কালের আবর্তনে সবকিছু হারিয়ে আজ তারা দিশেহারা। এখন এদের অধিকাংশের নেই নিজস্ব  কোনো জমি-জমা। এসব জনগোষ্ঠীর পরিবারের সদস্যরা বন বিভাগের জমির উপর ঘর-বাড়ি নির্মাণ করে বসবাসের পাশাপাশি শ্রম বিক্রিসহ নানাভাবে পরিবারের সদস্যদের জীবন জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। বাকি ৩০ ভাগ নৃতাত্ত্বিক জসগোষ্ঠীর পরিবারের সদস্যদের জমি থাকলেও বন্য হাতির তাণ্ডবে গত ১২/১৪ বছর ধরে তাদের জমিতে কোনো ফসল উৎপাদন করতে পারছে না। এ কারণে অনেক জমি জোরপূর্বক দখল করে নিয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালী সন্ত্রাসীরা। নানাভাবে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে। ফলে এ উপজেলার নৃ-তাত্ত্বিক এখন দিনমজুর ভূমিহীনে পরিণত হয়েছে। জানা যায়, নালিতাবাড়ি উপজেলার বাকাকুড়া গ্রামের রঘুনাথ কোচের দুই একর রেকর্ডিয় জমি সন্ত্রাসীদের অত্যাচারে চাষাবাদ করতে না পেরে সে এখন পথে নেমেছে। এ ছাড়া নওকুচি গ্রামের পাজাই কোচনীদের জমি দখল করে নিয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মহিলারাই ক্ষেতে খামারে, মাঠে-ময়দানে এমনকি সংসারের সব কাজ কর্ম করে থাকে। আর পুরুষরা বাড়িতে বসে তাদের ছেলে মেয়েদের দেখাশোনা করে থাকে। তবে, অতীতের তুলনায় অনেক পুরুষ এখন আর ঘরে বসে থাকতে চাইছে না। বছরে দুই মাস আমন ও ইরি বোরো মৌসুমে এ উপজেলার নারী-পুরুষ শ্রমিকরা কৃষির উপর শ্রম বিক্রি করে যা পায় তাই দিয়ে কোনো রকমে পরিবারের সদস্যদের জীবন জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। বাকি ১০ মাস তাদের থাকতে হয় বেকার, নির্ভর করতে হয় গারো পাহাড়ের বনাঞ্চলের উপর। মহিলারা গারো পাহাড় থেকে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ ও তা বাজারে বিক্রি করে পরিবারের সদস্যদের জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। কিন্তু গারো পাহাড়ে আগের মতো এখন আর জ্বালানি কাঠ পাওয়া যায় না। যা কিছু পাওয়া যায় তাও আবার আনতে দিচ্ছে না বন কর্মকর্তা, কর্মচারী ও অংশীদাররা। দীর্ঘ ৪০ বছরেও এখানে গড়ে উঠেনি শ্রমিকদের জন্য কোনো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা। ফলে বর্তমানে  ময়মনসিংহ-শেরপুর ও নেত্রকোনা জেলার ছয় উপজেলায় নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর দুঃখ কষ্টের শেষ  নেই। অনেকের বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দিয়েছে বন্য হাতির দল। ১২/১৪ বছর ধরে পাহাড়ি এলাকার মানুষ প্রতিনিয়ত বন্য হাতির সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে আছে। গজনী গ্রামের মনেন্দ্র কোচ, হালচাটী গ্রামের সুরেন্দ্র  কোচ জানান- কেরোসিন কিনতে হয় তাদের। প্রথম দিকে সরকারিভাবে এবং বিভিন্ন জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে হাতি তাড়ানোর জন্য কেরোসিন বিতরণ করা হলেও এখন তা হচ্ছে না। এখন আর কেউ খোঁজ খবর নেয় না। সরকারিভাবে কয়েকটি জেনারেটর দেয়া হয়েছিল হাতি তাড়ানোর জন্য। এসব জেনারেটর আর চোখে পড়ে না। এক সময় পাহাড়ি জনপদের মানুষ পাহাড়ে জুম চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করত। কিন্তু পাহাড় উজাড় ও বন্য হাতির তাণ্ডবে জুম চাষ হারিয়ে গেছে। বন্য হাতির তাণ্ডবে অনেকে গৃহহীন। সরজমিন অনুসন্ধানে  দেখা গেছে, সহায় সম্বলহীন এসব মানুষের এখন নেই  পেটে ভাত, পরনের কাপড়। পাহাড়ি আলু নানা ধরনের বন্য প্রাণী শিকার করে খেয়ে না খেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করে আসছে। এসব মানুষ খুব পরিশ্রমী হয়ে থাকে। তাদের উন্নয়নের জন্য এনজিও বিভিন্ন কাজ করে আসলেও তা শুধু কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ। হালুয়াঘাটের জয়রামকূড়া গ্রামের পল সুরেশ বানোয়ারি বলেন, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী গারোদের জীবনযাত্রা এখন আগের তুলনায় উন্নয়নের দিকে। গারোরা এখন শিক্ষাগ্রহণসহ কর্মসংস্থানের জন্যে ঢাকা শহরে যাওয়ায় জীবনমান উন্নত হয়েছে। ভবিষ্যতে যারা অতিদরিদ্র তাদের সংকট অনেকাংশে লাঘব হবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন। আচকিপাড়া গ্রামের সুফলা ম্রং(৫৫) জানান, সাবেক ট্রাইবাল অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান বিজয় ম্রংয়ের কারণে তারা তাদের সব সম্পত্তি হারিয়েছেন। এ রকম আরো অনেক গারোই অভিযোগ করেছেন তাদের এই  নেতার বিজয় ম্রংয়ের বিরুদ্ধে। শেরপুর জেলার পাঁচটি উপজেলার মধ্যে শ্রীবরদী ও ঝিনাইগাতী ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া উপজেলায় গারোদের সংখ্যা সবচেয়ে  বেশি। এরা নানাদিক থেকে এগিয়ে গেছে। গারো নারী-পুরুষ দেশের বিভিন্ন স্থানে কর্মক্ষেত্র তৈরি করে নিয়েছে। আর নানাদিক থেকে অবহেলিত ও পিছিয়ে রয়েছে কোচ সমপ্রদায়ের লোকজন। তাদের অভিযোগ ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন  থেকেও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। এখানে তুলনামূলকভাবে পায়নি ভিজিডি ভিজিএফ কার্ড, বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধী ভাতা। শিক্ষায়-দীক্ষায়ও কোচ সমপ্রদায়ের লোকেরা রয়েছে অনেক পিছিয়ে।

অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর