১৯৩০ সালে ফিফা প্রথম বিশ্বকাপের আয়োজন করে উরুগুয়েতে। সেবার প্রতিবেশী আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে বিশ্বকাপের প্রথম শিরোপা জিতে নেয় স্বাগতিক উরুগুয়ে। এরপর প্রতি ৪ বছর অন্তর এই আসর নিয়মিত বসছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। কখনো আমেরিকায়, কখনো ইউরোপে, কখনো আফ্রিকায় আবার কখনো এশিয়ায়। শুধু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে ১৯৪২ এবং ১৯৪৬ এই ২টি বিশ্বকাপের আসর বসেনি। এ পর্যন্ত ২০টি বিশ্বকাপে ৮টি দেশ শিরোপা জিতেছে। সর্বোচ্চ পাঁচবারের শিরোপাজয়ী দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ব্রাজিল। একমাত্র ব্রাজিলই এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপের সবগুলো আসরে অংশগ্রহণ করেছে।
ব্রাজিল ছাড়া ইতালি ৪, পশ্চিম জার্মানি ৪ ও আর্জেন্টিনা ও উরুগুয়ে দু’বার শিরোপা জিতেছে। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও স্পেন শিরোপা জিতেছে একবার করে। ২০টি বিশ্বকাপ আয়োজনে মাত্র ৬ বার স্বাগতিক দেশ বিশ্বকাপ জিতেছে। আজ বিশ্বকাপ ফিরে দেখায় থাকছে ১৯৫৪ ও ১৯৫৮‘র বিশ্বকাপ।
১৯৫৪ বিশ্বকাপ: হাঙ্গেরি
চ্যাম্পিয়ন: পশ্চিম জার্মানি
রানার্সআপ: হাঙ্গেরি
১৯৫৪ সালে পঞ্চম বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজন করে সুইজারল্যান্ড। এবছর ১৬টি দল চূড়ান্ত পর্বে অংশগ্রহণ করে। ১৬টি দল ৪টি গ্রুপে খেলে। এই বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিল-হাঙ্গেরির ম্যাচটি শারীরিক শক্তি প্রয়োগের এক বীভৎস রূপ লাভ করায় ‘বর্ণের যুদ্ধ’ হিসেবে কুখ্যাত হয়ে আছে। ম্যাচটি নিয়ন্ত্রণে আনতে রেফারিকে ৩টি লাল কার্ড ও ২টি পেনাল্টির সিদ্ধান্ত দিতে হয়। খেলার পরও দু’দলের খেলোয়াড়রা মারামারিতে জড়িয়ে পড়ে। ফাইনালে হাঙ্গেরিকে সম্পূর্ণ নতুন এক জার্মান দলের মুখোমুখি হতে হয়। হাঙ্গেরি ফাইনালের আগে টানা ৩১ ম্যাচ অপরাজিত ছিল। পশ্চিম জার্মানি সেই হিসেবে ছিল বেশ দুর্বল। ফাইনালের আগেই সবাই হাঙ্গেরির খেলোয়াড়দের হাতেই শিরোপা দেখছিল। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে জার্মানির কাছে ৩-২ গোলে হেরে যায় হাঙ্গেরি। অসুস্থ অবস্থায় এদিন মাঠে নামেন হাঙ্গেরির কিংবদন্তি পুসকাস। পুসকাস ও বিজরের গোলে প্রথম ৮ মিনিটের মধ্যেই ২-০ তে এগিয়ে গিয়েছিল হাঙ্গেরি। কিন্তু জার্মানিরা অসাধারণভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে শেষ পর্যন্ত ৩-২ জিতে এই বিশ্বকাপটি।
সিমারমানকে বিস্মিত করে দিয়ে জার্মানরা খেলায় ফিরে এলো প্রথমার্ধেই দুইটি গোল শোধ দিয়ে। দ্বিতীয় অর্ধে পুসকাসের হাঙ্গেরির একচেটিয়া আক্রমণ একে একে ফিরিয়ে দিলো জার্মান গোলকিপার টনি টুরেক। একইসঙ্গে গোলপোস্টে লেগে ফিরে গেল অনেকগুলো শট। শেষমেশ বাঁ পায়ের জাদুতে দুইজন প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে খেলার ৮৪ মিনিটে জয়সূচক গোলটি করলেন হেলমুট রাহন। জার্মানি প্রথমবারের মতো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন!
১৯৫৪-এর বিশ্বকাপ বিজয় জার্মান জাতির জন্য শুধু সামান্য একটি খেলার জেতা নয়। এই বিজয় পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করলো, তাদের হারিয়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে এনে দিলো। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খেলার অধিকার না থাকার পরও মাথা নত করে হাল ছেড়ে না দেবার উদ্যম তাদেরকে আবার বিশ্বের দরবারে ফিরিয়ে আনলো। সেই থেকে আর পিছু ফিরতে হয়নি তাদের। শুধু ফুটবল নয়, জাতি হিসেবেও তারা খুব অল্প সময়ের মধ্যে হিটলারের অপকীর্তিকে পেছনে ফেলে বিশ্বে তাদের অবস্থানকে পুনরুদ্ধার করলো।
হাঙ্গেরির বিস্ময় পুসকাস ১১টি গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতা কৃতিত্ব দেখান এই আসরে।
১৯৫৮ বিশ্বকাপ: সুইডেন
চ্যাম্পিয়ন: ব্রাজিল
রানার্স আপ: সুইডেন
বিশ্বকাপের সর্বাধিক পাঁচবারের শিরোপাজয়ী দেশ ব্রাজিল। তাদের এ মিশন শুরু হয়েছিল ১৯৫৮ সালে। সেবার স্বাগতিক সুইডেনকে ফাইনালে হারিয়ে প্রথমবারের মতো শিরোপা জেতে সাম্বা নৃত্যের দেশ ব্রাজিল। এ বিশ্বকাপেই ব্রাজিল আবিষ্কার করে তাদের কিংবদন্তি ফুটবলার পেলে’কে। তিনি টুর্নামেন্টে দৃষ্টিনন্দন ফুটবল উপহার দিয়ে ৬টি গোল করেন। ফাইনালের সুইডেনের বিপক্ষে ১৭ বছর বয়সী পেলে করেন জোড়া গোল। এতে ব্রাজিল শিরোপা জেতে ৫-২ গোলে। সেবারের টুর্নামেন্টে তৃতীয় স্থান অর্জন করে ফ্রান্স। ফ্রান্সের ফরোয়ার্ড ফন্টেইন মাত্র ৬ ম্যাচে ১৩ গোল করে বিরল কৃতিত্ব দেখান। ১৬টি দলের অংশগ্রহণে এই টুর্নামেন্টে ৩৫টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। টুর্নামেন্টে মোট গোল হয় ১২৬টি।
১৯৫৪ সালের আসরে গ্রুপ পর্বে খেলা হয়েছিল দলগুলোর বাছাই নির্ণয় করে। একই সঙ্গে গ্রুপে দুই দলের পয়েন্ট সমান হলে ছিল প্লে-অফের ব্যবস্থা।
তবে ১৯৫৮ সালের বিশ্বকাপে তা পাল্টে যায়। ১৬ দল চার গ্রুপে ভাগ হয়ে প্রত্যেক দল নিজ গ্রুপের প্রত্যেক দলের বিপক্ষে খেলেছে। জয়ের জন্য ছিল ২ পয়েন্ট, আর ড্রয়ের জন্য ১ পয়েন্ট। আগের বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বেই ছিল অতিরিক্ত সময়ের নিয়ম, তবে সুইডেনের আসরে সেটা উঠে যায়। গ্রুপ পর্বে পয়েন্ট টেবিলে শীর্ষে থাকা দুটি করে দল জায়গা পায় কোয়ার্টার ফাইনালে। শেষ চার নিশ্চিত করে ব্রাজিল, ওয়েলস, ফ্রান্স, নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড, সুইডেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন, পশ্চিম জার্মানি ও যুগোস্লাভিয়া। ওয়েলসকে ১-০ গোলে হারিয়ে সেমিফাইনালে ওঠে ব্রাজিল, ওই ম্যাচেই প্রথমবার লক্ষ্যভেদ করেন পেলে।
সেমিফাইনালে ব্রাজিলের সঙ্গে সেমিফাইনাল নিশ্চিত করা বাকি তিন দল হলো- ফ্রান্স, সুইডেন ও পশ্চিম জার্মানি। নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডকে ৪-০ গোলে উড়িয়ে দিয়ে সেমিতে ওঠে ফ্রান্স। সোভিয়েত ইউনিয়নকে ২-০ গোলে হারিয়ে সুইডেন ও যুগোস্লাভিয়াকে ১-০ গোলে হারিয়ে শেষ চার নিশ্চিত করে পশ্চিম জার্মানি। সেমিফাইনালে পেলের হ্যাটট্রিকে ফ্রান্সকে সহজেই হারায় ব্রাজিল। ৫-২ গোলের জয়ে প্রথম শিরোপা জেতার সুযোগ তৈরি হয় সেলেকাওদের সামনে। অন্য সেমিফাইনালে আগেরবারের চ্যাম্পিয়ন পশ্চিম জার্মানিকে ৩-১ গোলে হারায় সুইডেন। স্বাগতিক বলে সুইডেনের সামনেও সুযোগ ছিল প্রথম বিশ্বকাপ জেতার। তবে তা হয়নি। নক আউট পর্বে দুর্দান্ত পারফর্ম করা তরুণ পেলের সামনে উড়ে যায় সুইডেন। চতুর্থ মিনিটে তারা এগিয়ে গেলেও ব্রাজিল ঘুরে দাঁড়ায় নবম মিনিটেই। ভাবার জোড়া লক্ষ্যভেদের সঙ্গে পেলের জোড়া গোলে প্রথমবার বিশ্ব জয়ের আনন্দে মাতে সাম্বার দেশ। একই সঙ্গে ১৯৫০ সালের মারাকানোজোর দুঃখে কিছুটা হলেও প্রলেপ দিতে পারে তারা।
-চলবে