১৯০৪ সালের ২১শে মে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে প্রতিষ্ঠিত হয় ফেডারেল ইন্টারন্যাশনাল দে ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (ফিফা)। কিন্তু বৈশ্বিক একটি ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে তাদের সময় লাগে ২৬ বছর। ১৯২১ সালে ফ্রান্সের সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জুলে রিমে ফিফা’র তৃতীয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। অলিম্পিকে বিভিন্ন দেশের ফুটবলের দারুণ সাফল্যে উজ্জীবিত হয়ে ওঠেন জুলে রিমে। দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই তিনি আলাদা একটি বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট আয়োজন করার চিন্তা-ভাবনা করেন। আর এরই ফলস্বরূপ ১৯৩০ সালে ফিফা প্রথম বিশ্বকাপের আয়োজন করে উরুগুয়েতে। সেবার প্রতিবেশী আর্জেন্টিনাতে হারিয়ে বিশ্বকাপের প্রথম শিরোপা জিতে নেয় স্বাগতিক উরুগুয়ে। এরপর প্রতি ৪ বছর অন্তর এই আসর নিয়মিত বসছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।
কখনও আমেরিকায়, কখনও ইউরোপে, কখনও আফ্রিকায় আবার কখনও এশিয়ায়। দরজায় কড়া নাড়ছে বিশ্বকাপের আরেকটি আসর। রাশিয়ায় বসতে যাচ্ছে ফুটবল এই মহাযজ্ঞ। আগের প্রতিযোগিতাগুলো কেমন ছিল- ফুটবল উৎসবের বানে ভেসে যাওয়ার আগে ইতিহাসের পাতায় একটু চোখ বুলিয়ে নেয়া যাক-
১৯৮৬ বিশ্বকাপ: মেক্সিকো
চ্যাম্পিয়ন: আর্জেন্টিনা
রানার্স আপ: পশ্চিম জার্মানি
১৯৭৮ সালের পর ১৯৮৬ সালে আর্জেন্টিনা দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ জেতে। এই বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক ছিলেন দিয়েগো ম্যারাডোনা। এটাকে ডিয়েগো ম্যারাডোনার বিশ্বকাপ বললে ভুল হবে না। ১৯৮৬ সালের ফুটবল মহাযজ্ঞে আর্জেন্টাইন অধিনায়কের জাদুকরী পারফরম্যান্সে মুগ্ধ হয়েছে গোটা বিশ্ব। বলতে গেলে একাই তিনি জিতিয়েছেন লাতিন আমেরিকার দেশটির দ্বিতীয় শিরোপা। বিশ্বকাপের ১৩তম আসরে নিজে ৫ গোল করার পাশাপাশি ম্যারাডোনা সতীর্থদের দিয়ে করিয়েছিলেন আরও ৫ গোল।
৩১শে মে থেকে ২৯শে জুন পর্যন্ত হওয়া মেক্সিকোর এই আসরটি আসলে হওয়ার কথা ছিল কলম্বিয়ায়। কিন্তু লাতিন দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় তারা আয়োজকের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ায়। এরপর ফিফা ১৯৭০ সালের পর আবারও ফুটবল মহাযজ্ঞের আয়োজকের দায়িত্ব দেয় মেক্সিকোকে। মেক্সিকো সিটির ফাইনালে পশ্চিম জার্মানিকে ২-১ গোলে হারিয়ে দ্বিতীয় শিরোপা ঘরে তোলে আর্জেন্টিনা। ২৫ বছর বয়সী অধিনায়ক ম্যারাডোনার হাত ধরেই এসেছে শিরোপাটি। কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ২-১ গোলের জয়ের পথে দুই গোলই করেছিলেন ম্যারাডোনা। যার একটি ‘হ্যান্ড অব গড’, অন্যটি ‘গোল অব দ্য সেঞ্চুরি’। এরপর বেলজিয়ামের বিপক্ষে সেমিফাইনালেও ম্যারাডোনা করেন জোড়া লক্ষ্যভেদ। সেই পারফরম্যান্সের ধারায় ফাইনালে পশ্চিম জার্মানিকে ঘায়েল। ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপটা তাই ম্যারাডোনা ও আর্জেন্টিনার।
প্রমবারের মতো বিশ্বকাপের মূল পর্বে খেলার সুযোগ পায় কানাডা, ডেনমার্ক ও ইরাক।
১৯৯০ বিশ্বকাপ: ইতালি
চ্যাম্পিয়ন: পশ্চিম জার্মানি
রানার্স আপ: আর্জেন্টিনা
জার্মানদের স্বপ্ন ভেঙে ডিয়েগো ম্যারাডোনার বীরত্বে মেক্সিকোর আসরে শিরোপা উদযাপন করেছিল আর্জেন্টিনা। ১৯৯০ সালের আসরেও ফাইনালে মুখোমুখি হয় আর্জেন্টিনা-পশ্চিম জার্মানি। মেক্সিকোর আসরের হতাশা দূর করে জার্মানরা আর্জেন্টিনার বিপক্ষে প্রতিশোধ নিয়ে। ফাইনালে তারা ১-০ গোলে হারিয়ে তৃতীয়বারের মতো জেতে বিশ্বকাপ শিরোপা। বিশ্বকাপের ১৪তম আসরের আয়োজক ছিল ইতালি। দ্বিতীয় দল হিসেবে দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপের আয়োজক হয় ইউরোপের দেশটি, তাদের আগে মেক্সিকো দুইবার আয়োজন করেছিল বিশ্বকাপ (১৯৭০ ও ১৯৮৬)। বাছাই পর্বে অংশ নেওয়া ১১৬ দল থেকে মূল পর্বে জায়গা পায় ২২ দল, যারা যোগ দেয় আয়োজক ইতালি ও ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনার সঙ্গে।
১৯৯০ সালের আসরকে বিবেচনা করা ‘সবচেয়ে বাজে বিশ্বকাপ’ হিসেবে। নকআউট পর্বের চারটি ম্যাচ নিষ্পত্তি হয়েছিল পেনাল্টি শুট-আউটে, ম্যাচপ্রতি গোল গড় ছিল ২.২১, লালকার্ড দেখানো হয়েছিল ১৬ বার, যেখানে আবার প্রথমবারের মতো ফাইনালে ছিল লালকার্ড দেখানোর ঘটনা।
প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পায় কোস্টারিকা, আয়ারল্যান্ড ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। এইচডি ফরম্যাটে প্রথমবার সমপ্রচার করা হয় খেলা। ইতালির এই বিশ্বকাপেই শেষবার বিভক্ত জার্মানি অংশ নিয়েছিল। এরপর বার্লিনের দেয়াল ভেঙে পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি এক হয়ে যায়।
আগের বিশ্বকাপের নায়ক ডিয়েগো ম্যারাডোনা মিস করে বসেন পেনাল্টি শট। তৃতীয় শটে তিনি ব্যর্থ হওয়ার পর চতুর্থ শটে পেদ্রো আন্তোনিও ত্রোগিলো বল জালে জড়াতে ব্যর্থ হলে আর্জেন্টিনার মাথায় হাত। তবে সের্হিয়ো গয়কোচিয়ার বীরত্বে সেমিফাইনাল নিশ্চিত করে আলবিসেলেস্তেরা। যুগোস্লাভিয়ার শেষ দুই পেনাল্টি ঠেকিয়ে নায়ক বনে যান এই গোলরক্ষক। অথচ তার খেলাই কথা ছিল না এই ম্যাচে! আর্জেন্টিনার প্রথম পছন্দের গোলরক্ষক নেরি পাম্পিদো গ্রুপ পর্বে পায়ে আঘাত পাওয়ায় সুযোগ পেয়েছিলেন গয়কোচিয়া।
লোথার ম্যাথাউসের পেনাল্টি গোলে চেকোস্লোভাকিয়াকে ১-০ ব্যবধানে হারিয়ে সেমিফাইনালে ওঠে পশ্চিম জার্মানি। স্বাগতিক ইতালিও একই ব্যবধানে হারায় আয়ারল্যান্ডকে। আর অতিরিক্ত সময়ে গড়ানো ম্যাচে ইংল্যান্ড ৩-২ গোলে হারায় ক্যামেরুনকে। গ্যারি লিনেকারের দুই পেনাল্টি গোলে ১৯৬৬ সালের পর আবার সেমিফাইনালে নাম লেখায় ইংলিশরা। এই বিশ্বকাপে জার্মানদের সামনে ছিল আগের বিশ্বকাপের যন্ত্রণা দূর করে প্রতিশোধের পর্ব সেরে নেয়ার সুযোগ, অন্যদিকে আর্জেন্টিনার সামনে ছিল নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখার। কিন্তু ১০ জনের দল নিয়ে এবার আর পারেনি ম্যারাডোনারা। ৬৫ মিনিটে জার্মানির ইয়ুর্গেন কিন্সমানকে ফাউল করা পেদ্রো মোনজোন লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়লে আর্জেন্টিনা পরিণত হয় ১০ জনের দলে।
নিষেধাজ্ঞা ও ইনজুরিতে দুর্বল আর্জেন্টিনার বিপক্ষে আক্রমণের পর আক্রমণ চালিয়েছে জার্মানরা। তবে গোলের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে তাদের ৮৫ মিনিট পর্যন্ত, যখন মেক্সিকান রেফারি এদগার্দো কোদেসাল পশ্চিম জার্মানির পক্ষে বাজান পেনাল্টির বাঁশি। সুবর্ণ এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে স্পট কিক থেকে ঠান্ডা মাথায় লক্ষ্যভেদ করেন আন্দ্রেস ব্রেহমি। গোল হজমের পরপরই গুস্তাভো দিজোত্তি লালকার্ড দেখলে আর্জেন্টিনা খেলা থেকে একেবারেই ছিটকে যায়। শেষ পর্যন্ত ৯ জনের আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ১-০ গোলের জয়ে পশ্চিম জার্মানি তৃতীয়বারের মতো ঘরে তোলে বিশ্বকাপ।