টানা বর্ষণে রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর উপজেলার দুর্গম এলাকায় পাহাড় ধসে ১১ জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে বেশির ভাগ নারী। নিখোঁজ রয়েছেন আরো তিনজন। মঙ্গলবার সকালে নানিয়ারচরের পৃথক ৫টি গ্রামে এ পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। গ্রামগুলো হলো- বুড়িঘাট, ধরমপাশা, আমতলী, বড়পুল ও ছড়াইপাড়া। রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক একেএম মামুনুর রশিদ ৮ জন মারা যাওয়ার তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
এদিকে ভারি বর্ষণ অব্যাহত থাকায় রাঙ্গামাটিতে আরো পাহাড় ধসের আশঙ্কা করছে প্রশাসন। সোমবার রাতে রাঙ্গামাটি শহরের উন্নয়ন বোর্ড, কাঁঠালতলী, চম্পক নগর, শিমুলতলী ও আনসার ক্যাম্প এলাকায়ও পাহাড় ও দেয়াল ধসের ঘটনা ঘটে।
রোববার থেকেই রাঙ্গামাটির সঙ্গে চট্টগ্রাম, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে প্রসিদ্ধ সাজেকের উপজেলা বাঘাইছড়ির বিস্তীর্ণ অঞ্চল। ছোটখাটো পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে জেলার কাউখালী, বরকল, কাপ্তাই ও জুরাছড়ি উপজেলায়। রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম মহাসড়কে অন্তত তিনটি স্থান পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় ওই পথ দিয়ে যানচলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ ছাড়া গত পাহাড় ধসের পর মেরামত করা বেশ কয়েকটি স্থানে গাছের খুঁটির দেয়া বাঁধ ধসে গেছে। গত দু’দিনে সড়কটির অন্তত ১৬টি স্থানে মাটি ধসে পড়ায় ব্যাহত হচ্ছে সড়ক যোগাযোগ। এই পরিস্থিতিতে শহরের ঝুঁকিপূর্ণ বসতি এলাকার লোকজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষে এমন নির্দেশনা জানিয়ে সোমবার সকাল থেকেই মাইকিং করা হচ্ছে। প্রাণহানিসহ ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে আগাম প্রস্তুতি হিসেবে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় নির্মাণ করা হয়েছে অস্থায়ী তাঁবু ও আশ্রয় কেন্দ্র। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে কাউখালী, কাপ্তাই, নানিয়ারচর, জুরাছড়িসহ জেলা সদর মিলিয়ে মোট ২৭টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে।
মঙ্গলবার সকালে নানিয়ারচরে নিহতরা হলেন-বড়পুল পাড়া এলাকায় একই পরিবারের সুরেন্দ্র লাল চাকমা (৪৮), তার স্ত্রী রাজ্য দেবী চাকমা (৪৫) ও মেয়ে সোনালী চাকমা (৯), হাতিমারা গ্রামের রুমেল চাকমা (১২), ফুল দেবী চাকমা (৩২), ইতি চাকমা (২৪), রীতা চাকমা (১৭) ও রিতান চাকমা (২৫)। অবশিষ্ট তিনজনের নাম-পরিচয় পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে একজন শিশু রয়েছে। তবে তারা নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় সূত্র। এদিকে স্থানীয় সূত্রগুলো দাবি করেছে আরো তিনজন নিখোঁজ আছে, তারা মাটি চাপা পড়ে থাকতে পারে বলে স্থানীয়দের ধারণা।
নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদের (ভারপ্রাপ্ত) চেয়ারম্যান কোয়ালিটি চাকমা জানান, রাতে ভারি বৃষ্টিতে পাহাড় ভেঙে ও মাটিচাপা পড়ে বুড়িঘাট ইউনিয়নে ছয়জন ও নানিয়ারচর ইউনিয়নে পাঁচজন নিহত হয়েছেন। এছাড়া টানা বর্ষণে নানিয়ারচর উপজেলার ইসলামপুরে ৪৫টি, বগাছড়িতে ৪২ ও বুড়িঘাটে একটি স্থানে পাহাড় ধস হয়েছে। এসব এলাকায় মানুষের বাড়ি-ঘরের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মানুষের জন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে বলে জানান এ মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান।
রাঙ্গামাটির ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. নিহার রঞ্জন জানান, নানিয়ারচর উপজেলায় পাহাড় ধসে ১১ জনের মৃত্যুর খবর পেয়েছি। কয়েকজনকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আনা হয়েছে। এখনো উদ্ধার তৎপরতা চলছে।
রাঙ্গামাটি ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক দিদারুল আলম জানান, আমরা উদ্ধারকাজে অংশ নিতে দু’টি টিম ঘটনাস্থলে রওনা করেছি। পাহাড় ধসের কারণে রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ি সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের এ কর্মকর্তা।
রাঙ্গামাটি সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. এমদাদ হোসেন জানান, গত চারদিনের টানা বর্ষণে রাঙ্গামাটি জেলায় প্রায় ১২৮টি স্থানে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। পাঁচটিরও অধিক স্থানে সড়ক ভেঙে গেছে। সড়কের কংক্রিট উঠে বড় বড় খানাখন্দ আর গর্তে পরিণত হয়েছে। এতে যানবাহন চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পাহাড় থেকে মাটি নেমে সড়কে স্তূপ জমেছে।
এদিকে, গত ৪ দিনের টানা বর্ষণে তছনছ হয়ে গেছে রাঙ্গামাটি শহর। পাহাড় ধসে বিধ্বস্ত হয়েছে অসংখ্য বাড়িঘর। ধসে পড়ছে পিলার, বাড়িঘরের প্লাস্টার ও সীমানা প্রাচীর। সড়কে পাহাড় উপড়ে পড়েছে গাছপালা। বৃষ্টির পানি পড়ার কারণে বৈদ্যুতিক খুঁটিগুলো থেকে ছিটকে পড়ছে আগুন। রাত থেকে দিনের অর্ধেক সময় বিদ্যুৎবিহীন ছিল রাঙ্গামাটি।
এছাড়া শহরের রাঙ্গামাটি চেম্বার অব কমার্স ভবনের পার্শ্ববর্তী সড়ক, সিনিয়র মাদরাসার পার্শ্ববর্তী দেয়াল ও চম্পকনগর এলাকায় পরিবার পরিকল্পনা অফিসের দেয়াল, টিটিসি, বিজিবি রোড, ডিয়ার পার্ক, ঘাগড়া, সাপছড়ি, রাঙ্গাপানি, পুলিশ লাইন ধসের ঘটনা ঘটেছে।
প্রসঙ্গত গত বছর ২০১৭ সালের ১৩ই জুন রাঙ্গামাটিতে পাহাড় ধসে ১২০ জন মানুষ প্রাণ হারায়। আহত হয় অর্ধশতাধিক। এছাড়া সে সময় ১৪৫টি স্থানে পাহাড় ধস হয়ে সারা দেশের সঙ্গে মাসাধিক কাল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল রাঙ্গামাটি। ওদিকে, মহেশখালীতে পাড়ার ধসে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। তার নাম বাদশা মিয়া।