ওয়ার্ল্ড এক্সপো-২০২৫’র ভোটাভুটি নিয়ে উভয় সংকটে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ দুই বন্ধু রাষ্ট্রের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এ সংকট তৈরি হয়েছে। জাপান না রাশিয়া- কাকে সমর্থন দেবে ঢাকা? পেশাদার কূটনীতিকরা বলছেন ঢাকার জন্য এবারও ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ অবস্থা! দুটি দেশের তরফে বাংলাদেশের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ভোট চাওয়া হয়েছে। রাশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করেছেন। আর সর্বশেষ জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ১৪ ঘণ্টার সফরে মঙ্গলবার ঢাকা ঘুরে গেলেন। অবশ্য সরকারের বিদেশ নীতি বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত দায়িত্বশীল প্রতিনিধিরা বলছেন- আগামী নভেম্বরে ওই ভোট হবে। ফলে এখনও বাংলাদেশ কোন সিদ্ধান্ত নেয়নি। তাছাড়া ওই নির্বাচন নিয়ে ঢাকা আগাগোড়ায় সতর্ক রয়েছে।
নীতি-নির্ধারকরা এ নিয়ে আগবাড়িয়ে বা প্রকাশ্যে কাউকেই কিছু বলছেন না। মোট কথা বাংলাদেশ কোনো কমিটমেন্টে যাচ্ছে না। ভোটের আগ পর্যন্ত ঢাকা এই অবস্থান ধরে রাখতে চায়। ক্যামেরার সামনে ডিপ্লোমেসি হয় না- পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রায়শই এমনটা বলেন। ‘ধীরে রজনী ধীরে’ এটিও তার কমন ডায়ালগ। গণমাধ্যমের সঙ্গে ব্রিফিংয়ে খানিক জটিল প্রশ্নে মন্ত্রীর মুখ থেকে এমন জবাব আসে হরহামেশাই। সেটি স্মরণ করে ঢাকার জ্যেষ্ঠ এক কূটনীতিক (বর্তমানে ভিন দেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবে রয়েছেন) মানবজমিনকে বলেন- ওয়ার্ল্ড এক্সপো-২০২০’র আয়োজক রাষ্ট্র নির্বাচনে বাংলাদেশের যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে, সেই ভোটাভুটিতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের অনুরোধ রাখতে গিয়ে বাংলাদেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতকে হাতছাড়া করেছিল। ২০১৩ সালের ওই ভোটে চড়া মূল্য দিতে হয়েছিল বাংলাদেশকে। আমিরাতে প্রায় ৩ লাখ শ্রমিক রপ্তানির সুযোগ লুফে নেয়া তো যায়নি, উল্টো অনেক দিন দেশটিতে বাংলাদেশিদের ভিসা বন্ধ ছিল। সেই নির্বাচনের প্রথম রাউন্ডে বাংলাদেশ রাশিয়াকে সমর্থন দিলেও চূড়ান্ত লড়াইয়ে আমিরাত তথা দুবাইকে ভোট দেয় বাংলাদেশ। প্রথম পর্বের ভোটে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের অনুরোধ রক্ষার বিষয়টি ঢাকাকে বেকায়দায় ফেলেছিল বলে আবুধাবিকে বোঝানোর চেষ্টা হলেও এই যুক্তিতে আবুধাবি সন্তুষ্ট হয়নি। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাত হচ্ছে সৌদি আরবের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র জনশক্তি রপ্তানির গন্তব্য।
ঢাকার ওই কূটনীতিকের মতে, রাজনৈতিক এবং কৌশলগত কারণে সেই নির্বাচনে রাশিয়াকে সমর্থন দেয় বাংলাদেশ। তাছাড়া, ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মস্কো সফরে খোদ প্রেসিডেন্ট পুুতিন বাংলাদেশের ভোটটি চেয়েছিলেন। সব মিলে প্রথমপর্বে রাশিয়াকে ভোটটি দিয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু প্যারিসে আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী ব্যুরোর ১৫৪তম সাধারণ অধিবেশনে আমিরাতই চূড়ান্ত জয় পায়। রাশিয়ার একাতেরিনবাগকে হারিয়ে আয়োজক হওয়ার গৌরব অর্জন করে আরব আমিরাতের শহর দুবাই।
এএফপি’র রিপোর্ট মতে, চূড়ান্ত পর্বে ১১৬-৪৭ ভোটে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়। সেই ভোটে ১৬৮ সদস্য দেশের এই সংগঠনের সবাই ভোট প্রদান করে। চার রাষ্ট্রের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলেও ভোট শুরুর ২০ মিনিট আগে ব্রাজিলের সাও পাওলো এবং তুরস্কের ইজমির প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেয়। সেগুনবাগিচার কর্মকর্তারা জানান, ৫ বছর পর পর অনুষ্ঠেয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক প্রদর্শনী ‘ওয়ার্ল্ড এক্সপো’র ২০২৫ সালের আয়োজক রাষ্ট্র হওয়ার দৌড়ে এবারও চার দেশই ছিল। কিন্তু ফ্রান্স তার প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছে কয়েক মাস প্রচারণা চালানোর পর। এখন পর্যন্ত রাশিয়া ও জাপানের সঙ্গে তৃতীয় দেশ হিসেবে মাঠে আছে আজারবাইজান। বাংলাদেশি একাধিক কর্মকর্তা বলেন- চলতি বছরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ওআইসির সহকারী মহাসচিব নির্বাচনে আজারবাইজান বাংলাদেশকে ভোট দেয়নি। তাছাড়া দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের যে পর্যায়ের কূটনৈতিক সম্পর্ক তার চেয়ে অনেক বেশি ঘনিষ্ঠতা যুদ্ধবন্ধু রাশিয়া ও উন্নয়নবন্ধু জাপানের সঙ্গে। সেই হিসেবে আপাতত ওই দুই দেশকে নিয়েই ভাবছেন নীতি নির্ধারকরা। ভোটে বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত কাকে বেছে নেবে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র সচিব (সিনিয়র সচিব) মো. শহীদুল হক গত বুধবার মানবজমিনকে বলেন, এ বিষয়ে কথা বলার এখনো সময় হয়নি। ইটস টু আরলি টু কমেন্ট। উল্লেখ্য, ওয়ার্ল্ড এক্সপোতে প্রতিটি দেশ নিজস্ব প্যাভিলিয়ন নিয়ে প্রায় ছয় মাসব্যাপী অংশ নিয়ে থাকে। সর্বশেষ ইতালির মিলান শহরে ‘ফিডিং দ্য প্ল্যানেট, এনার্জি ফর লাইফ’ শীর্ষক ‘ওয়ার্ল্ড এক্সপো-২০১৫’ অনুষ্ঠিত হয়। ২০২০ সালের ২০শে অক্টোবর থেকে ২০২১ সালের ১০ই এপ্রিল পর্যন্ত সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে ‘কানেক্টিং মাইন্ডস, কানেক্টিং দ্য ফিউচার’ শীর্ষক এক্সপো-২০২১ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।