প্রতিদিন হাজার হাজার টন বর্জ্য পানি তৈরি হচ্ছে দেশের কারখানাগুলোতে। এই বর্জ্য তরল মিশে যাচ্ছে নদী-নালা, খাল-বিল ও কৃষি জমিতে। বিষাক্ত করে তুলছে খাবার পানি। পরিবেশ ভারসাম্য হারিয়ে হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে জনজীবনে। পরিবেশ অধিদপ্তর আইন বলছে, কল-কারখানার কেমিক্যালযুক্ত এই বর্জ্য পানি পরিশোধন করতে হবে। সেই পানি আবার কাজে লাগাতে হবে। এজন্য ব্যবহার করতে হবে তরল বর্জ্য শোধনাগার বা ইটিপি প্ল্যান্ট। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ আইন কাগজ-কলমেই সীমাবদ্ধ।
বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই পদ্ধতি অতিরিক্ত ব্যয়বহুল। আর এ কারণেই মুখ থুবড়ে পড়েছে কারখানায় বর্তমানে প্রচলিত ইটিপি প্ল্যান্ট। বন্ধ রাখা হচ্ছে, বেশিরভাগ সময়। তবে এবার এই খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে কাজ শুরু করেছে ‘আগ্রহ’ নামে একটি বেসরকারি সংস্থা। শিল্প-কারখানার বর্জ্য তরল পরিশোধনের জন্য সংস্থাটি বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো নিয়ে এসেছে ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট প্রজেক্ট (আইডব্লিউএমপি)।’ এ প্রজেক্ট একদিকে কারখানা মালিকের খরচ বাঁচাবে, অন্যদিকে বর্জ্য পানি এতটাই পরিশোধন করে যা হবে পানযোগ্য। দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এই প্রযুক্তি দেশে নিয়ে এসেছেন উন্নয়নকর্মী ডালিয়া রহমান। ইতিমধ্যে তিনি বিভিন্ন কারখানার সঙ্গে এ প্রকল্প নিয়ে কাজ শুরু করেছেন। জানা যায়, একটি সাধারণ মানের ইটিপি স্থাপনে ব্যয় হয় ৪০-৮০ লাখ টাকা। অন্যদিকে একটি অত্যাধুনিক বায়োলজিক্যাল ইটিপি স্থাপনে ব্যয় হয় ২-৩ কোটি টাকারও বেশি। এছাড়া ইটিপি স্থাপনে যেসব ইকুইপমেন্ট প্রয়োজন তার সবই আমদানি করতে হয় বিদেশ থেকে। এই বিপুল টাকা ব্যয় করে ইটিপি স্থাপন করতে চান না অনেক কারখানা মালিক। ফলে দিন দিন পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, সংকট দেখা দিচ্ছে বিশুদ্ধ খাবার পানির। এসব দিক বিবেচনায় পরিবেশবান্ধব এবং ব্যয় সাশ্রয়ী ইটিপি নিয়ে কাজ করছে ‘আগ্রহ’ নামের একটি এনজিও। জার্মানির একটি প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট প্রজেক্ট’-এর আওতায় ‘আগ্রহ’ দেশে সৌর বিদ্যুৎচালিত এক বিশেষ ধরনের পরিশোধন যন্ত্র এনেছে যা গার্মেন্টস এবং টেক্সটাইল শিল্পসহ বিভিন্ন শিল্পের বর্জ্য পানি পরিশোধন করবে। এতটাই পরিশোধন হবে যে, পরিশোধিত পানি পানযোগ্য হবে। এটি প্রচলিত ইটিপির তুলনায় অধিক কার্যকরী এবং সহজেই স্থাপনযোগ্য। এর স্থাপন ব্যয় একটি সাধারণ মানের ইটিপির মতো এবং পরিচালন ব্যয় অনেক কম। কারণ এটিতে বিদ্যুতের প্রয়োজন নেই, আবার প্রচলিত ইটিপির মতো পরিচালন ব্যবস্থাও জটিল নয়। প্রচলিত ইটিপি প্রযুক্তির চেয়ে এই পদ্ধতিতে পরিশোধনে সময়ও কম লাগে। এছাড়া শোধনের পর যে স্লাজ থাকে সেটি সহজেই পরিবেশের সঙ্গে মিশে যেতে পারে। স্লাজের পরিমাণও কম হয়।
আগ্রহ’র চেয়ারপারসন ডালিয়া রহমান জানান, প্রচলিত ইটিপি নিয়ে শিল্প মালিকদের অনীহা দূর করতেই দেশে নতুন এই ইটিপি নিয়ে ‘আগ্রহ’ কাজ করছে। বিভিন্ন দেশের ইটিপি প্রযুক্তি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জার্মানির একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমরা যৌথভাবে কাজ শুরু করি। তিনি বলেন, জার্মান প্রযুক্তিই আমাদের দেশের পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। তিনি মনে করেন, এটি শিল্পবর্জ্য পরিশোধন এবং পরিবেশ রক্ষায় বড় ধরনের বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে। শিল্পবর্জ্য হ্রাসের লক্ষ্যে সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে তরল বর্জ্য নির্গমনকারী সব শিল্প প্রতিষ্ঠানে যে জিরো ডিসচার্জ পলিসি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। আগ্রহ এ লক্ষ্যে সরকার এবং সংশ্লিষ্ট শিল্প-প্রতিষ্ঠানসমূহের সঙ্গে একযোগে কাজ করছে।
উদ্যোক্তা, উন্নয়নকর্মী এবং সমাজ গবেষক ডালিয়া রহমান বলেন, কেবল পরিবেশ রক্ষাই নয়, সমাজের শারীরিক এবং মানসিক প্রতিবন্ধী, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ, বেদে সম্প্রদায়, পাহাড় এবং সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকজন, নারীদের একটি বিশাল অংশ যাতে সমাজ বিনির্মাণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে সেজন্যও ‘আগ্রহ’ কাজ করছে। যেন দেশের উন্নয়নে নিজেদের সম্পৃক্ত এবং সমাজের মূলধারায় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারে সেজন্য তাদের অর্থনৈতিক সাহায্য, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান, চাকরির সুযোগ তৈরি, ব্যবসার জন্য উদ্যোক্তা তৈরিসহ প্রয়োজনে ক্ষুদ্র ঋণ প্রদান করা হচ্ছে। শারীরিক এবং মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের পূর্ণ বিকাশের জন্য বিশেষায়িত স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ইতিমধ্যে পিছিয়ে পড়া নারীদের নানা ধরনের হস্তশিল্পের প্রশিক্ষণ দেয়ার পাশাপাশি সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা, নির্যাতন প্রতিরোধ, বাল্যবিয়ে রোধ ও আইনগত সহায়তাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ শুরু করেছে ‘আগ্রহ’। তৃণমূল পর্যায়ের প্রায় কয়েকশ’ অসহায় নারীদের নানারকম আয় বৃদ্ধিমূলক কর্মকাণ্ডের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদেরকে স্বাবলম্বী করে তুলেছে। ‘আগ্রহ’ সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসাম্য এবং অসমতা দূর করতে তাদের কাজ অব্যাহত রাখবে, যেন মানুষ সমতা, ভালোবাসা এবং মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে।