ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়েছে। ইউনিটটির ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ ওঠার পর নানা নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে গতকাল বিকাল পৌনে ৪টায় আনুষ্ঠানিকভাবে ফল প্রকাশ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান। এ সময় তিনি প্রশ্ন ফাঁসের কথা স্বীকার করলেও ভর্তি পরীক্ষা বাতিল কিংবা শুধুমাত্র পাসকৃতদের পুনরায় ভর্তি পরীক্ষা নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
এ বছর ‘ঘ’ ইউনিটে পাসের হার অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। শতকরা ২৬ দশমিক ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছেন। যা ইতিপূর্বে প্রকাশিত অন্য ইউনিটগুলোরও প্রায় দ্বিগুণ। এদিকে ভর্তি পরীক্ষা বাতিল, প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িতদের বিচার এবং সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিমের পদত্যাগ দাবি করেছে প্রগতিশীল ছাত্র জোট। বিকালে এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি করেন জোটের সমন্বয়ক উম্মে হাবিবা বেনজির। পরীক্ষা বাতিলের দাবি নিয়ে টিএসসির সন্ত্রাস বিরোধী রাজু ভাস্কর্যে আমরণ অনশনে বসেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের এক শিক্ষার্থী।
প্রকাশিত ফলাফলে দেখা গেছে, এ বছর ‘ঘ’ ইউনিটে ১ হাজার ৬১৫টি আসনের বিপরীতে ভর্তি পরীক্ষার জন্য আবেদনকারীর সংখ্যা ছিল ৯৫ হাজার ৩৪১জন।
যার মধ্যে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ৭০ হাজার ৪৪০ শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ১৮ হাজার ৪৬৩ ভর্তিচ্ছু ভর্তি পরীক্ষায় পাস করেছেন। যেখানে বিজ্ঞান বিভাগের ৪৮ হাজার ৫৯৮ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ১১ হাজার ৯৩৬, মানবিক বিভাগের ৮ হাজার ৭০৪ জন পরীক্ষার মধ্যে ৪ হাজার ১৬৯ জন এবং ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে অংশগ্রহণকারী ১৩ হাজার ১৩৮ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ২ হাজার ৩৫৮ জন পাস হয়েছে। বিভাগভিত্তিক হিসেবে বিজ্ঞান বিভাগের ২৪ দশমিক ৫৬ ভাগ, মানবিক বিভাগের ৪৭ দশমিক ৮৯ ভাগ এবং ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের ১৭ দশমিক ৯৪ ভাগ শিক্ষার্থী পাস হয়েছে।
পাসকৃত শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার বিস্তারিত ফলাফল বিশ্ববিদ্যালয়ের admission.eis.du.ac.bd ওয়েবসাইট থেকে জানতে পারবে তাছাড়া, যেকোনো অপারেটরের মোবাইল ফোন থেকে DU GHA roll no_ টাইপ করে ১৬৩২১ নম্বরে পাঠিয়ে ফিরতি এসএমএস-এ ফলাফল জানা যাবে। পাসকৃত ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের (বিজ্ঞান মেধাক্রম ৩ হাজার ৫০০ পর্যন্ত, মানবিক মেধাক্রম ৬০০ পর্যন্ত ও বাণিজ্য মেধাক্রম ১ হাজার পর্যন্ত) আগামী ২২ অক্টোবর থেকে ৩১শে অক্টোবর পর্যন্ত ভর্তি পরীক্ষার ওয়েবসাইটে বিস্তারিত ফরম ও বিষয় পছন্দক্রম ফরম পূরণ করতে হবে। এ ছাড়া কোটায় পাসকৃতদের কোটার ফরম ১৭ই অক্টোবর থেকে ২৪শে অক্টোবরের মধ্যে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অফিস থেকে সংগ্রহ করে যথাযথভাবে পূরণ করে জমা দিতে হবে। ফলাফল নিরীক্ষণের জন্য নির্ধারিত ফি প্রদান সাপেক্ষে আগামী ১৭ই অক্টোবর থেকে ২২শে অক্টোবর পর্যন্ত সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অফিসে আবেদন করা যাবে।
পাসের রেকর্ড ও ভিসির বক্তব্যপ্রকাশিত এই ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এবারের ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি ফলাফল নিকট অতীতের সব রেকর্ড ভেঙ্গেছে। ২০১৩-১৪ সেশনে ঘ ইউনিটে পাসের হার ছিল ১১ দশমিক ৪ ভাগ, ২০১৪-১৫ সেশনে ছিল ১৬ দশমিক ৫৫ ভাগ, ২০১৫-১৬ সেশনে ৯ দশমিক ৯১, ২০১৬-১৭ সেশনে ৯ দশমিক ৮৩ এবং ২০১৭-১৮ সেশনে ১৪ দশমিক ৩৫ ভাগ। অথচ এ বছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬ দশমিক ২১ শতাংশে। যা পূর্বের ফলাফলের তুলনায় দ্বিগুণ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারও বেশি। এমনকি চলতি শিক্ষাবর্ষে বিভিন্ন ইউনিটের ফলাফলেও দেখা গেছে এত সংখ্যক শিক্ষার্থী কোনো ইউনিটে পাস করেনি। এর আগে শুক্রবার বেলা ১০টা ঘ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। টানা তৃতীয়বারের ন্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত ‘ঘ’ ইউনিটে সম্মান ১ম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ ওঠে। শুক্রবার বেলা ১০টায় পরীক্ষা শুরুর আগে বেলা ৯টা ১৭ মিনিটে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পাওয়া যায়। বেলা ১১টায় পরীক্ষা শেষ হলে হাতে লেখা ওই উত্তরপত্র যাচাই করে দেখা গেছে, সেখানে বাংলা অংশে ১৯টি, ইংরেজি অংশে ১৭টি, সাধারণ জ্ঞান অংশে ৩৬টিসহ (বাংলাদেশ বিষয়াবলি ১৬ ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি ২০) মোট ৭২টি প্রশ্নের হুবহু মিল পাওয়া গেছে। প্রশ্ন ফাঁসের প্রভাবে অধিক সংখ্যা শিক্ষার্থী পাস করেছেন বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেন ভিসি। তিনি এটিকে ইতিবাচক দিক হিসেবে দেখেন। এ সময় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের বিষয়ে ভিসি বলেন, তদন্ত কমিটি ডিজিটাল জালিয়াতির প্রমাণ পেয়েছে। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ভাষা প্রশ্ন ফাঁস বা ডিজিটাল জালিয়াতি যাই হোক এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার যেকোনো পর্যায়ে তাদের বিরুদ্ধে এমন প্রমাণ পেলে তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নেয়া হবে। এক্ষেত্রে তাদের ভর্তি বাতিল করা হবে এবং আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রশ্ন ফাঁসের পরেও পরীক্ষা কেন বাতিল করা হবে না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অনেক শিক্ষার্থী এর সঙ্গে জড়িত। অল্প কয়েকজনের জন্য হাজার হাজার শিক্ষার্থীর জীবন নিয়ে খেলা করার সুযোগ নেই। অভিযুক্তদের বহিষ্কার করা হলে- যেসকল আসন শূন্য হবে সেখানে নতুন করে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হবে কিনা- এমন প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গেছেন তিনি। পরীক্ষা শুরুর আগে হাতে লেখা ৭২টি প্রশ্ন সাংবাদিকদের হাতে আসে। পরে সেটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জানানো হয়। এটিকে প্রশ্ন ফাঁস বলবেন কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে ভিসি বলেন, কতগুলো কাগজে প্রশ্ন হাতে লেখা ছিল। তদন্তের মাধ্যমে বের হবে যে এটা কারা করেছে এবং কখন করেছে। তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। টানা তৃতীয় বার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনার কারণ কি এবং এক্ষেত্রে যারা দায়িত্ব পালন করছেন তাদের কোনো ব্যর্থতা আছে কিনা- এমন প্রশ্নের উত্তরে ভিসি বলেন, এরকম ঘটনা যখনি ঘটছে তখনি অভিযুক্তদের শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে। তবে খুশির বিষয় হলো- প্রশ্নপত্র ফাঁসে জালিয়াতি চক্রকে ধরে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। এটা প্রশাসনের সবচেয়ে বড় সাফল্য। এদিকে প্রকাশিত ফলাফলে যারা পাস করেছেন- তাদের নতুন করে পরীক্ষা নেয়া যায় কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে ভিসি বলেন, সেটি করার সুযোগ নেই।
পদত্যাগ প্রশ্নে নিশ্চুপ ডিন
এদিকে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ‘ঘ’ ইউনিট ভর্তি পরীক্ষার সমন্বয়কারী অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিমের কাছে প্রশ্ন ছিল- পরীক্ষার আগে যদি একজন শিক্ষার্থীও প্রশ্ন পেয়ে থাকে তাহলে তাকে প্রশ্ন ফাঁস বলা যাবে কিনা এবং উন্নত দেশের মতো ব্যর্থতার দায় নিয়ে পদত্যাগ করবেন কিনা? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে কোনো কথা বলেননি তিনি। পরে তার প্রশ্নের উত্তর দেন প্রো-ভিসি (প্রশাসন) অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ। তিনি বলেন, প্রশ্ন ফাঁস বা ডিজিটাল জালিয়াতি যাই হোক না কেন প্রশাসন বিষয়টি খতিয়ে দেখবে।
ডিনের পদত্যাগসহ ৩ দাবি
এদিকে প্রশ্ন ফাঁসের দায়ে ‘ঘ’ ইউনিট ভর্তি পরীক্ষার সমন্বয়কারী সাদেকা হালিমের পদত্যাগসহ ৩ দফা দাবি জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল বাম ছাত্র সংগঠনসমূহের মোর্চা প্রগতিশীল ছাত্র জোট। মঙ্গলবার বিকালে মধুর ক্যান্টিনে এক সংবাদ সম্মেলন থেকে এ দাবি জানান জোটের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সমন্বয়ক ও ছাত্র ফেডারেশনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি উম্মে হাবিবা বেনজির। অন্য দুটি দাবির মধ্যে রয়েছে- ‘ঘ’ ইউনিট ভর্তি পরীক্ষা ও ঘোষিত ফলাফল বাতিল এবং প্রশ্ন ফাঁসে জড়িতদের গ্রেপ্তার ও বিচার। এ সময় তিনি প্রশ্ন ফাঁসের প্রতিবাদে আজ বুধবার সন্ধ্যা ৬টায় রাজু ভাস্কর্য থেকে মশাল মিছিলের ঘোষণা দেন। এরপরও যদি ফলাফল বাতিল করা না হয়, তাহলে ভিসি কার্যালয় এবং সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন কার্যালয় অবরোধ কর্মসূচি দেয়া হবে বলেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন তিনি।
আমরণ অনশনে ঢাবি শিক্ষার্থী
এদিকে ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা বাতিল করে পুনরায় নেয়ার দাবিতে আমরণ অনশন করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী। আখতার হোসেন নামের ওই ছাত্র ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের জিয়া হলের শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে মঙ্গলবার সাড়ে ১২টা থেকে অনশন শুরু করেন তিনি। এ সময় তার পেছনে বিভিন্ন প্ল্যাকার্ডে লেখা রয়েছে ‘যদি পরীক্ষা শুরুর ১ মিনিট আগেও প্রশ্ন পাওয়া যায়, তবুও সেটা প্রশ্ন ফাঁস’ , ‘প্রশ্নপত্রের নিরাপত্তা চাই’, ‘জালিয়াতদের বহিষ্কার চাই’, ‘হোতাদের বিচার চাই’, ‘অনশন’, ‘প্রশ্ন ফাঁস!!!’, ‘মেধাবীদের গলায় ফাঁস এ দায় নেবে কে?’ অনশনের কারণ জানতে চাইলে আখতার হোসেন বলেন, ‘ঘ’ ইউনিটে যে প্রশ্নে পরীক্ষা নেয়া হয়েছে সেটা ফাঁস হওয়া প্রশ্ন। ফাঁস হওয়া প্রশ্নে বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি হবে, এটা আমি মেনে নিতে পারছি না। কারণ, আমরা অনেক কষ্ট করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছি। সেখানে অযোগ্য এবং মেধাহীনরা টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন ফাঁস করে এখানে ভর্তি হবে- তা মেনে নেয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়।