নারীতেই পরম ঈশ্বরকে দর্শন ও অর্জন হিসেবে বিশ্বাস করে শারদীয় দুর্গোৎসবের অষ্টমী তিথিতে ‘সর্ববিদ্যাস্বরূপিনী’ কুমারী রূপে দেবী দুর্গার বন্দনা করলেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। গতকাল ভোরে সারা দেশে রামকৃষ্ণ মঠের পাশাপাশি ঢাকার গোপীবাগে রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠেও কুমারী পূজার আয়োজন করা হয়। সকাল থেকে বিরামহীন ঢাকের বাদ্যের সঙ্গে থেমে থেমে চলে কাসার ঘণ্টা, শঙ্খনাদ আর উলুধ্বনি। সঙ্গে চলে ভক্তিগীতি। আর তার মাঝেই পূজা মণ্ডপে চণ্ডী পাঠের মাধ্যমে চলতে থাকে দেবীর অর্চনা। সকাল ৭টার দিকে শিশু মিতালী চক্রবর্তীকে কুমারী দেবী রূপে সাজিয়ে দুর্গোৎসবের মহাঅষ্টমীতে ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশনে শুরু হয় কুমারী পূজার আয়োজন। পরবর্তীতে বেলা ১১টার দিকে লোহিতলাল বস্ত্রে ‘পূজার বেদীতে আসেন ‘কুমারী দেবী’। পুষ্পাসনে আসীন হয়ে বসেন বিল্বপত্রে।
তার কপালে লাল সিঁদুর, হাতে ফুল এবং পায়ে গাঢ় লাল আলতা। পূজারীদের মন্ত্রোচ্চারণে এবং স্তুতিতে দেবীর বন্দনা করা হয়। গোপীবাগে রামকৃষ্ণ মিশন মঠে এবার কুমারী পূজা পরিচালনা করেন ভাস্কর মহারাজ, আর তন্ত্র সাধনাকারীর দায়িত্ব পালন করেন কল্যাণ মহারাজ। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, যে ত্রিশক্তির দ্বারা বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি-পালন-ধ্বংসের চক্রে আবর্তন করে, সেই শক্তি বীজ আকারে কুমারীতে নিহিত। সেই বিশ্বাস থেকেই দেবী দুর্গার কুমারীরূপের আরাধনা করেন ভক্তরা।
কুমারী পূজার সূত্রপাত ঘটে সাধক রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের হাত ধরে। তিনিই প্রথম নিজ স্ত্রী সারদা দেবীকে মাতৃজ্ঞানে পূজা করা শুরু করেন। আর তারপর থেকেই উপমহাদেশের বিভিন্ন মিশন ও মঠগুলোতে এই কুমারী পূজার চর্চা চালু হয়। ভক্তরা বিশ্বাস করেন, এই পূজা একাধারে ঈশ্বরের উপাসনা, মানববন্দনা এবং নারীর মর্যাদার প্রতিষ্ঠা। নারীর সম্মান, মানুষের সম্মান আর ঈশ্বরের আরাধনাই কুমারী পূজার মূল শিক্ষা।
রামকৃষ্ণ মিশনের অধ্যক্ষ স্বামী ধ্রুবেশানন্দ বলেন, যোগিনীতন্য, কুলার্বতন্য, দেবীপুরাণ, স্তোত্র, কবচ, সহস্রনাম, তন্যসার, প্রাতোষিণী, পুরোহিত দর্পণ- এ সকল হিন্দু শাস্ত্রের ধর্মীয় গ্রন্থে কুমারী পূজার পদ্ধতি ও মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছে। কিছু নিয়ম মেনে এ পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এসব নিয়ম-কানুন, আচার-ব্যবস্থা সব কিছুই শাস্ত্রে বর্ণিত আছে। যেমন- তন্ত্রসার মতে, “১ বছর থেকে ১৬ বছর পর্যন্ত বয়সের বালিকারা কুমারী পূজার উপযুক্ত হিসেবে গণ্য হবে। তবে তাদের অবশ্যই ঋতুমতি হওয়া চলবে না। এবারের কুমারী দেবী মিতালীর বয়স আট বছর হওয়ায় তার শাস্ত্রীয় নাম ‘কুষ্ঠিকা’।”
মেরুতন্ত্রে স্পষ্ট করে লেখা রয়েছে, “সর্বকামনা সিদ্ধির জন্য ব্রাহ্মণকন্যা, যশ প্রাপ্তির জন্য ক্ষত্রিয় কন্যা, ধনলাভের জন্য বৈশ্য কন্যা ও পুত্র লাভের জন্য শূদ্রকুলজাত কন্যা কুমারী পূজার জন্য যোগ্য।"
স্বামী ধ্রুবেশানন্দ জানান, “নারী জাতির প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা সমাজ ও জীবনকে মহৎ করে তোলাই কুমারী পূজার মূল শিক্ষা। কারণ, কুমারীতে সমগ্র মানবজাতির শ্রেষ্ঠ শক্তি- পবিত্রতা, সৃজনী ও পালনী শক্তি সকল কল্যাণী শক্তি সূক্ষ্মরূপে বিরাজ করে। তাই কুমারী পূজা। কুমারী প্রতীকে জগজ্জনীর পূজাতে পরম সৌভাগ্য লাভ হয়।"
গতকাল কুমারী পূজা শেষে দুপুর ১২টা ৩১ মিনিটে শুরু হয় মহাঅষ্টমীর সন্ধিপূজা।
এর আগে ১৬ই অক্টোবর সকালে নবপত্রিকা প্রবেশ ও স্থাপনের পর শুরু হয় মহাসপ্তমীর পূজা। যার মাধ্যমে দুর্গোৎসবের মূল আনুষ্ঠানিকতার উদ্বোধন ঘটে। আজ সকালে বিহিত পূজার মাধ্যমে শুরু হবে মহানবমী পূজা।