× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, বুধবার , ১১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৫ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

খাসোগি হত্যাকাণ্ড /বিশ্বের কাছে কী বার্তা দিচ্ছে সৌদি আরব

বিশ্বজমিন

মানবজমিন ডেস্ক
(৫ বছর আগে) অক্টোবর ২৩, ২০১৮, মঙ্গলবার, ৮:৪১ পূর্বাহ্ন

সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ডে বিশ্ববাসীর কাছে নিজেদের সম্পর্কে কী বার্তা দিচ্ছে সৌদি আরব! তা নিয়ে এখন নানা মাত্রায় বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে। প্রথমত, দেশটির বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর ভাবমূর্তি পড়েছে প্রশ্নের মুখে। কারণ, প্রথমেই তারা জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ডকে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। সৌদি আরব এ সম্পর্কে জানেই না বলে তারা দাবি করেন। বলা হয়, তাদের ইস্তাম্বুল কনসুলেট থেকে জামাল খাসোগি তার কাজ সেরে বেরিয়ে গেছেন। তাই তাকে হত্যার অভিযোগকে প্রথমে ‘মিথ্যা’ ও বানোয়াট বলে আখ্যায়িত করা হয়। কিন্তু একের পর এক গোপন তথ্য বেরিয়ে আসার পর সৌদি আরব স্বীকার করেছে জামাল খাসোগিকে কনসুলেটের ভেতরে হত্যা করা হয়েছে। তার আত্মীয়স্বজনের কাছে এজন্য ক্ষমা চেয়েছেন সৌদি আরবের বর্তমান শাসকগোষ্ঠী।
কিন্তু তা সত্ত্বেও বর্তমান ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানকে বাঁচানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সৌদি আরব। তবে তুরস্কের একটি পত্রিকা জানিয়েছে, খাসোগিকে হত্যার আগে সরাসরি ফোন করে রিয়াদে ফিরে যাওয়ার প্রস্তাব দেন ক্রাউন প্রিন্স। তার সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন খাসোগি। এখন অসংখ্য প্রশ্ন সামনে। যদি সৌদি আরবের যুবরাজ বা ক্রাউন প্রিন্স হত্যাকাণ্ডে জড়িত না-ই থাকবেন তাহলে ওই রিপোর্ট অনুযায়ী, কেন তিনি জামাল খাসোগিকে ফোন করেছিলেন? কেন খাসোগি তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পর তাকে হত্যা করা হয়েছে? তাহলে কি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান হত্যাকাণ্ডে জড়িত নন?

জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ড নিয়ে বেরিয়ে আসছে বিস্ফোরক তথ্য। একের পর এক এমন তথ্যে তোলপাড় চলছে সারা দুনিয়ায়। ওই হত্যাকাণ্ডে সৌদি আরবের সরাসরি জড়িত থাকার পক্ষে তথ্য মিলছে। এতে সৌদি আরবের ভাবর্মূতিতেও আঘাত লেগেছে। সর্বশেষ তথ্যে বলা হচ্ছে, জামাল খাসোগিকে হত্যার আগে তার সঙ্গে সরাসরি সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান কথা বলেছেন ফোনে। তাই যদি হয় তাহলে পুরনো সবকিছু ছাপিয়ে এ হত্যাকাণ্ডে সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্সের জড়িত থাকার প্রমাণ মেলে। একে বোম্বশেল তথ্য বলে উল্লেখ করেছে নিউজিল্যান্ড হেরাল্ড। মেরিন ও’নেইলের লেখা ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, তুরস্কের সরকারপন্থি পত্রিকা ডেইলি ইয়েনি সাফাক জামাল খাসোগিকে হত্যার আগে তার সঙ্গে মোহাম্মদ বিন সালমানের টেলিফোনে কথা হয়েছিল বলে খবর দিয়েছে। এতে বলা হয়, ২রা অক্টোবর ইস্তাম্বুলে সৌদি আরবের কনসুলেটে প্রবেশের পর  জামাল খাসোগিকে হত্যা করা হয়। তার অল্প আগে ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান তার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। তুরস্কের সরকারি কর্মকর্তারা এখন পর্যন্ত এ বিষয়টি যাচাই-বাছাই বা প্রকাশ না করলেও ওই পত্রিকাটি এ খবর দিয়েছে। তবে এরই মধ্যে সরকারপন্থি অনেক পত্রিকা ও মিডিয়া আগেভাগে এমন সব তথ্য ফাঁস করছে যা তদন্তে সত্য প্রমাণিত হয়েছে।

ইয়েনি সাফাক পত্রিকা লিখেছে, কনসুলেট ভবনের ভেতরে ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে আটক করে সৌদি আরবের বিশেষ টিম। তারপর তার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান। জামাল খাসোগিকে তিনি রিয়াদে ফিরে যাওয়ার জন্য রাজি করানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু ক্রাউন প্রিন্সের সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন জামাল খাসোগি। তার মধ্যে আতঙ্ক ছিল যে, তিনি রিয়াদে ফিরে গেলেই তাকে গ্রেপ্তার করা হবে এবং হত্যা করা হবে। এমনটা বুঝে জামাল খাসোগি ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। ক্রাউন প্রিন্সের সঙ্গে তার কথোপকথন শেষ হলেই তাকে হত্যা করে সৌদি আরবের ওই টিমটি।  

তুরস্ক কর্তৃপক্ষ মনে করে, খাসোগিকে হত্যার আগে সৌদি আরবের ওই ঘাতকের দলটি তাকে উপুড় করে ধরে রাখে। এ সময় তার আঙুলগুলো কেটে বিচ্ছিন্ন করা হয়। তারপর তার শরীরে মারণাস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। তাকে টেনে নেয়া হয় আরেকটি কক্ষে। সেখানে একটি কনফারেন্স টেবিল ছিল। সেই টেবিলের ওপর তাকে রেখে কেটে কেটে টুকরো টুকরো করা হয়। বিচ্ছিন্ন করা দেহাবশেষ নিয়ে সৌদি আরবের কনসুলেটের দুটি গাড়ি বেরিয়ে যায়। তারা শহরের বাইরে গিয়ে দুটি আলাদা স্থানে তা ফেলে আসে। রিপোর্টে বলা হচ্ছে, একটি গাড়ি যায় শহরের কাছেই সবচেয়ে বড় বন বেলগ্রেড ফরেস্টের দিকে। অন্য গাড়িটি যায় ইয়ালোভা শহরের দিকে। কনসুলেটে থেকে এই শহরটির দূরত্বে এক ঘণ্টার ড্রাইভের পথ। এখন তদন্তকারীরা এ দুটি স্থানেই খুঁজে ফিরছেন খাসোগির মৃতদেহ।

সাংবাদিক জামাল খাসোগি ছিলেন ক্রাউন প্রিন্স ও সৌদি আরব কর্তৃপক্ষের কড়া সমালোচক। ধারণা করা হয়, এ কারণে তাকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু সৌদি আরব শুরু থেকেই এ হত্যাকাণ্ডে তাদের জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে আসছে। উল্টো বলা হয়েছে, জামাল খাসোগি তার কাজ শেষ করে কনসুলেট থেকে বেরিয়ে গেছেন।

পরে তারা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে যে, জামাল খাসোগিকে হত্যা করা হয়েছে কনসুলেটের ভেতরে। আস্তে আস্তে এ বিষয়ে লোমহর্ষক তথ্য বেরিয়ে আসছে। তুরস্কের পুলিশ বলছে, সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের ব্যক্তিগত ‘এমপ্লয়ি’সহ মোট ১৫ জনের একটি টিম জামাল খাসোগিকে হত্যার মিশন নিয়ে ইস্তাম্বুলে প্রবেশ করে। এর মধ্যে ছিলেন অস্ট্রেলিয়ায় প্রশিক্ষিত, অপারেশনের সময় হাড় কাটার করাতসহ সৌদি আরবের একজন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ। সবচেয়ে বড় অভিযোগের আঙুল উঠেছে তার দিকে। বলা হচ্ছে, তিনিই হত্যা মিশন পরিচালনা করেছেন।
জামাল খাসোগি নিখোঁজ হওয়া নিয়ে চারদিকে যখন নানা রকম তথ্য, তখন সৌদি আরব কর্তৃপক্ষ এ ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে নানা রকম উদ্ভট ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে থাকে। শুরুতে তারা বলে, অক্ষত অবস্থায় কনসুলেট ছেড়ে গেছেন সাংবাদিক জামাল। কিন্তু তুরস্কের মিডিয়ায় একটি রিপোর্ট প্রকাশ হয়। তাতে বলা হয়, খাসোগির হাতে থাকা অ্যাপল হাতঘড়িতে হত্যাকাণ্ডের আগে পরের অনেক ঘটনার ভয়াবহ বর্ণনা রয়েছে। তাতে বোঝা যায়, ওই সাংবাদিককে নির্যাতন করা হয়েছে। টেনে-হিঁচড়ে নেয়া হয়েছে। হত্যা করা হয়েছে। তারপর কেটে টুকরো টুকরো করা হয়েছে। এমন তথ্য প্রকাশ হওয়ার পর সৌদি সরকার চূড়ান্ত পর্বে এসে সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে হত্যার কথা স্বীকার করে।

অতঃপর নতুন এক তত্ত্ব হাজির করে সৌদি আরব। বলা হয়, জামাল খাসোগির সঙ্গে কর্মকর্তাদের কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে অকস্মাৎ তার গলায় শ্বাসরোধ হয়ে যায়। এতে মারা যান তিনি। একজন কর্মকর্তা তার গলায় হাত দিয়ে তাকে বিরত রাখার চেষ্টা করেন। তখনই তিনি শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যান। এখন প্রশ্ন হলো, যদি তা-ই হয়, তাহলে তার মৃতদেহ কোথায়! কী করা হয়েছে সেই মৃতদেহ! এ প্রশ্নের উত্তর সৌদি আরবকে বিশ্বের কাছে দিতেই হবে। এমন হত্যাকাণ্ডের পর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সৌদি আরবকে নিয়ে মারাত্মক সন্দেহ ও নিন্দার ঝড় দেখা দিয়েছে।

রোববার সৌদি আরব দাবি করে যে, জামাল খাসোগিকে অপহরণের পরিকল্পনা ছিল তাদের। তারপর তাকে সৌদি আরবে ফিরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা ছিল। বলা হয়েছিল, তিনি যদি সৌদি আরবে ফিরতে অস্বীকৃতি জানান, তাহলে তাকে ছেড়ে দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু তুরস্ক সরকারের সূত্রগুলো উদ্ধৃত করে ইয়েনি সাফাক পত্রিকা বলছে, হত্যাকাণ্ডের সামান্য আগে ব্যক্তিগতভাবে জামাল খাসোগিকে ফোন করেছিলেন ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান। যদিও আগে বলা হয়েছে, এ হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে মোহাম্মদ বিন সালমান কিছুই জানেন না। সাংবাদিক জামাল খাসোগি নিখোঁজ হওয়ার তিন দিন পর ক্রাউন প্রিন্স ব্লুম্বার্গ’কে বলেন, খাসোগি কনসুলেটের ভেতরে ছিলেন না। তিনি আরো বলেন, আমাদের কনসুলেটের ভেতরে তুরস্ক সরকারের কর্মকর্তাদের প্রবেশ ও তল্লাশিকে স্বাগত জানাই আমরা।  

হত্যা ঘটনার পর সৌদি আরব শীর্ষ স্থানীয় ৫ জন কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করেছে। গ্রেপ্তার করেছে ১৮ জনকে। একে এই হত্যাকাণ্ড ধামাচাপা দেয়ার বড় একটি উদ্যোগ হিসেবে দেখছে বিশ্ববাসী। ওদিকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতাসীন রিপাবলিকান পার্টির কয়েকজন সিনিয়র সদস্য এই হত্যাকাণ্ডে ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান যুক্ত বলে বিশ্বাস করছেন। এ অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে পশ্চিমাদেরকে সমন্বিতভাবে ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন তারা। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়্যিপ এরদোগান ঘোষণা দিয়েছেন তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত প্রকাশ করবেন। তিনি রোববার প্রশ্ন রেখেছেন, কেন ওই ১৫ সদস্যের টিম ইস্তাম্বুলের কনসুলেটে এসেছিলেন? কেন ১৮ জন মানুষকে গ্রেপ্তার করেছে সৌদি আরব? এসবের সবকিছুই বিস্তারিত ব্যাখ্যা করতে হবে। অন্যদিকে এ হত্যাকাণ্ডে সৌদি আরবকে কঠোর পরিণতি ভোগ করা উচিত বলে উল্লেখ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেশনাল নেতারা। ওদিকে ইস্তাম্বুলে সৌদি আরবের কনসুলেটের আরো ২৮ স্টাফকে তলব করেছেন ইস্তাম্বুলের চিফ প্রসিকিউটর। এর মধ্যে রয়েছেন তুরস্কের নাগরিক ও বিদেশিরা। গতকাল তাদের সাক্ষ্য দেয়ার কথা।  এর আগে প্রসিকিউটররা কনসুলেটের স্টাফ, কয়েকজন তুর্কি নাগরিককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।

তুরস্কের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা আনাডোলু এজেন্সি রোববার রিপোর্ট করেছে যে, খাসোগির প্রণয়ী হাতিস সেঙ্গিসকে ২৪ ঘণ্টা পুলিশি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে।

খাসোগিকে হত্যার নিন্দা জানিয়ে এরই মধ্যে যৌথ বিবৃতি দিয়েছে বৃটেন, জার্মানি ও ফ্রান্স। এতে বলা হয়েছে, আসলে কী ঘটেছে তার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা অত্যন্ত জরুরি। ওদিকে বার্লিনে রোববার সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মারকেল। তিনি বলেছেন, সৌদি আরবের কাছে অস্ত্র রপ্তানি বন্ধ করার আহ্বানের প্রতি সমর্থন করেন তিনি।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর