বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন মিয়ানমারের কমপক্ষে ৭ লাখ রোহিঙ্গা। এ ইস্যুটি এখনও এসোসিয়েশন অব সাউথইস্ট এশিয়ান নেশনসের (আসিয়ান) জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে আছে। সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক সঙ্কটের অন্যতম রোহিঙ্গাদের পরণতি। তাদের এ দুর্ভাগ্য সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। সরকার সমূহ এবং অধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলো সক্রিয় ও গঠনমূলক ভূমিকা নিতে আহ্বান জানিয়ে আসছেম আসিয়ানের প্রতি। কিন্তু জটিলতা হলো আসিয়ানের সাংগঠনিক কাঠামোতে। কারণ, তাদের রয়েছে অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার রীতি। এ জন্যই এ ইস্যুতে কোনো পদক্ষেপ নেয়া কঠিন হয়ে পড়েছে এই গ্রুপটির।
এমন জটিল অবস্থা শুধু কোনো একক সদস রাষ্ট্রের জন্যই নয়। একই সঙ্গে তা পুরো সংগঠনের জন্যই প্রযোজ্য। মিয়ানমার যতক্ষণ তাদেরকে আহ্বান না জানাবে ততক্ষণ পর্যন্ত আসিয়ান এ ইস্যুতে যুক্ত হতে পারে না। তার অর্থ এই নয় যে, আসিয়ানের সদস্য রাষ্ট্রগুলো এ ইস্যু থেকে পুরোপুরি দূরে সরে এসেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দুটি দেশ মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া এ ইস্যুতে মুখ খুলেছে। বিশেষ করে মিয়ানমারের কড়া সমালোচনা করেছে মালয়েশিয়া।
আসিয়ানভুক্ত অঞ্চলের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোর ওপর ছায়া ফেলে রেখেছে রোহিঙ্গা বা মিয়ানমার ইস্যু। আসিয়ানভুক্ত নেতারা তাই এ ইস্যুতে অধিক দৃশ্যমান অবস্থান নিতে শুরু করেছেন। বিশেষ করে তা হচ্ছে সিঙ্গাপুরের চেয়ারম্যানশিপের অধীনে।
এ বছর সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন বসে। সেকানে এক ফাঁকে সিঙ্গাপুরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভিভিয়ান বালাকৃষ্ণান বলেন, বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন শুরু করা উচিত মিয়ানমারের। একই সঙ্গে রোহিঙ্গাদের প্রতিজনের নিরাপত্তা, শান্তি, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতেই হবে মিয়ানমারকে। এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে মিয়ানমারকে সহযোগিতা দিতে কাজ করে যাবে আসিয়ান। আগামী কয়েক সপ্তাহে, কয়েক মাসে আমরা এমনটাই দেখতে যাচ্ছি। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নৃশংসার বিষয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত ও দায়ীদের পূর্ণাঙ্গ বিচারের আওতায় আনার প্রয়োজনীয়তার কথাও উল্লেখ করেন সিঙ্গাপুরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, ঠিক এই মুহূর্তে ১০ লাখ মানুষ দুর্ভোগে। একটি মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে, যা এই সময়ে ও যুগে অগ্রহণযোগ্য।
আসিয়ানের মধ্যে এ নিয়ে যে হতাশা কাজ করছে তা আবার প্রকাশ পেয়েছে গত সপ্তাহে সমাপ্ত সিঙ্গাপুরে ৩৩তম আসিয়ান সম্মেলনে। আগের সম্মেলনের মতো না হয়ে এবার প্রায় প্রতিটি ফোরামে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আলোচনা করেছেন আসিয়ান নেতারা। তাতে অংশ নিয়েছেন তাদের এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অংশীদাররাও। এই সম্মেলনে থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী প্রায়ুত চান-ওচা তার আসিয়ানভুক্ত সহযোগিদের উদ্দেশে বলেছেন, রাখাইনের পরিস্থিতিতে গঠনমুলক, বাস্তবতাভিত্তিক ও টেকসই উপায়ে সমাধানে আঞ্চলিক এই জোট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে। দুর্গত মানুষদেরকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার মানবিক সহায়তা বিষয়ক আসিয়ান সমন্বয় সেন্টার মানবিক সহায়তা দিতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি। একই সঙ্গে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনে সমর্থন দেয়ার আহ্বান জানান প্রায়ুত চান ওচা। তিনি রাখাইনে সব সম্প্রদায়ের জীবনমানের উন্নয়ন নিশ্চিত করারও আহ্বান জানান।
আসিয়ানের সাম্প্রতিক এই পটপরিবর্তন দুটি বিষয় ফুটিয়ে তোলে। তার একটি হলো- হতাশা। অন্যটি হলো- রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে যুক্ত হওয়ার ইচ্ছা। কিন্তু প্রশ্নটা হলো আসিয়ানভুক্ত দেশগুলো থেকে এমন উদ্যোগ বা প্রস্তাবকে কিভাবে নেবে মিয়ানমার। মিয়ানমার এটাকে তাদের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখে থাকতে পারে।
তবে মিয়ানমারকে বুঝতে হবে যে, ২০১৬ সালে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান কমিশন গঠন করার মাধ্যমে রোহিঙ্গা ইস্যুকে আন্তর্জাতিকী রুপ দিয়েছে তারা। তারপর তারা গত বছর দেশের ভিতরকার ও বাইরের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে মিয়ানমার গঠন করেছে এডভাইজরি কমিশন ফর দ্য ইমপ্লিমেন্টেশন কমিটি অব রাখাইন স্টেট। উপরন্তু এ বছর জুনে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর ও উন্নয়ন বিষয়ক কর্মসূচি ইউএনডিপির সঙ্গে একটি সমঝোতা স্বারক স্বাক্ষর করেছে মিয়ানমার। তাতে রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদে, মর্যাদার সঙ্গে এবং টেকসইভাবে দেশে ফেরার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির কথা বলা হয়। বলা হয়, দেশের সঙ্গে তাদের একীভূত করার কথা।
যেহেতু মিয়ানমার জাতিসংঘের এজেন্সিগুলো ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত করেছে, তাই রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে আসিয়ান যে শুভবুদ্ধি প্রদর্শন করেছে তাকে স্বাগত জানানো উচিত মিয়ানমারের। আর যদি তার বিরোধিতা করা হয় তাহলে তাতে সংগঠনের ভিতরে ক্ষত দেখা দিতে পারে, আসিয়ানের শক্তি হ্রাস পেতে পারে। আর তাতে আন্তর্জাতিক মহল থেকে সমালোচনার ঝড় উঠতে পারে।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্ভাব্য সব সহযোগিতার পথবের করতে আসিয়ান ছাড়াও ব্যবহার করা যেতে পারে আসিয়ান প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের বৈঠক (এডিএমএম) ও এডিএমএম-প্লাস’কে। কারণ, মিয়ানমারের নিরাপত্তা ও ক্ষমতার বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করে সেনাবাহিনী।
যদি রোহিঙ্গা সঙ্কটের দিকে দীর্ঘদিন দৃষ্টি দেয়া না হয় তাহলে এই ইস্যুটি হয়ে উঠতে পারে উগ্রপন্থার উর্বর ক্ষেত্র। এই সুযোগটি ব্যবহার করতে পারে ইসলামপন্থি উগ্রবাদীরা। এমন উল্লেখযোগ্য হুমকি মোকাবিলা করতে, নিরাপত্তা শক্তিশালী করতে এবং শান্তি, স্থিতিশীলতা ও আঞ্চলিক উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে এডিএমএম এবং এডিএমএম-প্লাস।
এটা সত্য যে, এর আগে আসিয়ান কোন বড় উদ্যোগ নেয় নি রোহিঙ্গা ইস্যুতে। তবে সম্প্রতি এ সংগঠনের মধ্যে যে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে তাতে আমরা আশা করতে পারি, আসিয়ানের আরো সক্রিয়া ও যুক্ত থাকার ভূমিকা।
এর পুরোটাই নির্ভর করে মিয়ানমারের উদারতা ও কিভাবে তারা তা গ্রহণ করছে তার ওপর।
(নেহগিনপাও কিপজেন পিএইচডি হলেন সেন্টার ফর সাউথইস্ট এশিয়ান স্টাডিজ, জিন্দাল স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স, ও.পি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির নির্বাহী পরিচালক ও এসোসিয়েট প্রফেসর। ‘ডেমোক্রেটাইজেশন অব মিয়ানমার’ সহ মিয়ানমার নিয়ে তিনটি বইয়ের লেখক তিনি। এই লেখাটি গতকাল অনলাইন ব্যাংকক পোস্টে প্রকাশিত তার লেখার অনুবাদ)