বিভিন্ন কেলেঙ্কারিসহ আমানতের সুদ হার কমে যাওয়ায় মানুষের আস্থাহীনতা দেখা দিয়েছে দেশের ব্যাংকিং খাতে। পাশাপাশি পুঁজিবাজারেও দরপতন অব্যাহত থাকায় ভরসা পাচ্ছেন না বিনিয়োগকারীরা। ফলে ব্যাংকের চেয়ে দ্বিগুণ মুনাফা আসায় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগই এখন মানুষ নিরাপদ মনে করছেন। এতে করে ব্যাপকভাবে বাড়ছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি। চলতি অর্থবছরের (২০১৮-১৯) প্রথম চার মাসে সঞ্চয়পত্র থেকে বিক্রি হয়েছে ১৭ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা। যা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৬৮ শতাংশ। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
এদিকে জাতীয় নির্বাচন উপলক্ষে নির্বাচন কমিশনে দেয়া প্রার্থীদের হলফনামায় দেখা গেছে, মন্ত্রী, সংসদ সদস্যসহ তাদের স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, আইনজীবী, অবসরপ্রাপ্ত আমলারাও ব্যাপক হারে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেছেন।
উল্লেখ্য, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রামীণ সঞ্চয় আহরণ, সঞ্চয় কার্যক্রমে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা এবং সঞ্চয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই সঞ্চয়পত্র চালুর উদ্দেশ্য। কিন্তু সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বেশিরভাগ ধনিদের। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, কয়েকটি বন্ডসহ বর্তমানে ১১ ধরনের সঞ্চয় কর্মসূচি চালু রয়েছে। এর মধ্যে ধনী মানুষেরা যেসব সঞ্চয়পত্র কিনে রাখেন, সেগুলোতেই সুদের হার বেশি। সূত্র মতে, সরকার গত ১০ বছরে সঞ্চয়পত্রের বিপরীতে সুদ দিয়েছে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, কিছু সাধারণ মানুষ সঞ্চয়পত্রের উচ্চ সুদের অংশীদার হলেও বেশি সুবিধা নিচ্ছেন ধনিরা। হলফনামায় শুধু রাজনীতিবিদদের একটি চিত্র উঠে এসেছে, এর বাইরের প্রভাবশালীদের চিত্র আসেনি। তাদের মতে, ব্যাংক আমানতের সুদের চেয়ে দ্বিগুণ মুনাফা মিলছে সঞ্চয়পত্রে। অন্যদিকে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শেয়ারবাজারে চলছে মন্দাভাব। তাই সঞ্চয়পত্রে ঝুঁঁকছেন বিনিয়োগকারীরা। এর আগে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ব্যাংকে আমানতের সুদের হারের চেয়ে ১ থেকে ২ শতাংশ বেশি থাকতে পারে। উদ্যোগ নেয়া হলেও আগামী নির্বাচনের পর এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে তিনি সাংবাদিকদের জানান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্যাংকের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ মুনাফা মিলছে সঞ্চয়পত্রে। এ কারণে মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করছে। বিশেষ করে পারিবারিক সঞ্চয়পত্রে সুদ হার বেশি হওয়ায় এতে বিনিয়োগ করছেন তারা। বিক্রির মাত্রা বেড়ে যাওয়া বেশ কয়েকটি ব্যাংকে পারিবারিক সঞ্চয়পত্রের সংকটও দেখা দিয়েছিল।
জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তর প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাস জুলাই থেকে অক্টোবর সময়ে সঞ্চয়পত্রে বড় ধরনের বিনিয়োগ এসেছে। এ চার মাসে সঞ্চয়পত্রে মোট জমা হয়েছে ১৭ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা। যা মোট পুরো বছরের মোট বিক্রির লক্ষ্যমাত্রার ৬৮ শতাংশ। সরকার চলতি অর্থবছরের ১২ মাসে সঞ্চয়পত্র থেকে ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিল। গত অর্থবছরের প্রথম চার মাসে সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ ছিল ১৮ হাজার ৩৪৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৫১৪ কোটি টাকা বেশি বিক্রি হয়েছে।
জানা গেছে, বিদায়ী ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের নিট ঋণ দাঁড়ায় ৪৬ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা। যা ঘাটতি বাজেট অর্থায়নে সরকার নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা (সংশোধিত) থেকেও দুই হাজার ৫৩০ কোটি টাকা বেশি। বিদায়ী অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে জাতীয় সঞ্চয়স্কিমসহ সব ধরনের সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৪ হাজার কোটি টাকা।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত কয়েক বছর ধরেই সরকার ঘাটতি বাজেট অর্থায়নে সঞ্চয়পত্রের ওপর বেশি জোর দিচ্ছে। গত অর্থবছর সঞ্চয়পত্র থেকে মোট ৪৬ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা নেয় সরকার। এর আগের অর্থবছরে এ খাত থেকে সরকার ঋণ নেয় ৫২ হাজার ৪১৭ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে গত অক্টোবর পর্যন্ত সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৫৫ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা। এদিকে সঞ্চয়পত্রে জনসাধারণের বিনিয়োগ বেড়ে যাওয়ার ফলে মুদ্রা বাজারে এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা দেখা দিয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য মতে, বর্তমানে পরিবার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১.৫২ শতাংশ। পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১.২৮ শতাংশ, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১.০৪ শতাংশ, পেনশনার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১.৭৬ শতাংশ। ২০১৫ সালের ২৩ মে’র পর থেকে এ হার কার্যকর আছে। এর আগে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ছিল ১৩ শতাংশেরও বেশি।
উল্লেখ্য, এখন সঞ্চয়পত্র ভাঙানো ও মুনাফা সংগ্রহ করা অনেক সহজ হয়ে গেছে। সঞ্চয়পত্রের টাকার জন্য বই জমা দিয়ে টোকেন নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না। মাস শেষে মুনাফার টাকা ও মেয়াদ শেষে আসল টাকা সরাসরি গ্রাহকের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হয়। আর টাকা জমা হওয়ার সঙ্গে গ্রাহকে মোবাইলে এসএমএস ও ই-মেইল করে জানিয়ে দেয়া হয়।