কক্সবাজারে বাসা ভাড়া নিয়ে চলছে নৈরাজ্য। অস্বাভাবিক বাসা ভাড়া বৃদ্ধির কারণে প্রতিনিয়ত বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়াদের মধ্যে বাদানুবাদের ঘটনা ঘটছে। ভুক্তভোগীরা জানিয়েছে, প্রতিবছরের মতো এবারো ভাড়া বাড়িয়েছেন অধিকাংশ বাড়ির মালিক। বিষয়টি একতরফা হওয়ায় ভাড়াটিয়ারা একধরনের অর্থনৈতিক নিষ্পেষণের মধ্যেই রয়েছে। বিশেষ করে রোহিঙ্গারা আসার পর থেকে বিভিন্ন এনজিওর কারণে কক্সবাজারে বাসা ভাড়া নিয়ে চলছে চরম নৈরাজ্য।
গত এক বছরে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে প্রায় তিন গুণ। বাড়ি ভাড়া দেয়া থেকে শুরু করে ভাড়া বৃদ্ধি, ভাড়াটিয়াদের অধিকার পর্যন্ত সব বিষয়ে বাড়ির মালিকই চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষ। তাদের জমিদারসুলভ ক্ষমতার দাপটে ভাড়াটিয়ারা যেন প্রজা।
কক্সবাজার শহরের শহীদ সরণি সড়কের জেএস ভবনে দু’রুমের একটি বাসায় ভাড়া থাকেন মার্শেল চৌধুরী। তিনি জানান, চার বছর ধরে তিনি এ বিল্ডিংয়ে ভাড়া থাকেন। প্রথম বছরে তিনি ভাড়া দিতেন ৭ হাজার টাকা। প্রতিবছর ১০০০ টাকা করে ভাড়া বাড়িয়েছে বাড়িওয়ালা। কিন্তু এ বছর থেকে ১৫ হাজার টাকা ভাড়া দাবি করে। অনেক বাদানুবাদের পর চলতি বছর ১১ হাজার টাকা ভাড়া নিলেও আগামী বছর থেকে ১৫ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হবে। অন্যথায় বাসা ছাড়তে হবে। এ ভাবেই বাড়ি ভাড়া আইনের তোয়াক্কা না করে নিজেদের ইচ্ছেমতো বাড়ি ভাড়া বাড়াচ্ছে বাড়ির মালিকরা। আইনত দুই বছরের মধ্যে ভাড়া না বাড়ানোর নির্দেশ থাকলেও বাড়ির মালিকরা ভাড়া বাড়াচ্ছে প্রতিবছর। এতে করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর আয়ের বড় অংশটাই চলে যাচ্ছে বাসা ভাড়া বাবদ। তার প্রভাব পড়ছে জীবনমান, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সব ক্ষেত্রেই। সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয় জেলা শহরে বসবাসকারী সংবাদকর্মীদের।
কক্সবাজারের মানবাধিকার নেত্রী ও কক্সবাজার পৌরসভার প্যানেল মেয়র শাহেনা আকতার পাখি বলেন, শহরগুলোতে বাড়িভাড়ার নৈরাজ্য দূর করা নাগরিক অধিকারেরই অংশ। লাখ লাখ ভাড়াটের জ্বলন্ত সমস্যাকে উপেক্ষা করার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। এ অবস্থার দ্রুত অবসান হওয়া উচিত। কক্সবাজারে ৫৭ শতাংশ বাড়ি মালিকের কাছে ৪৩ শতাংশ ভাড়াটিয়া জিম্মি বলেও জানান এই নারী নেত্রী। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পুরো পর্যটন নগরজুড়েই যেন চলছে বাড়ি ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য। বাড়িওয়ালারা যখন ইচ্ছা তখন বাড়ি ভাড়া বাড়াচ্ছে। আর বিদ্যুৎ, গ্যাস ও নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে বাড়ি ভাড়ায় নৈরাজ্য ভাড়াটিয়া জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে।
প্রতিবছর জানুয়ারি এলেই ভাড়া বৃদ্ধির খড়গ নামে ভাড়াটিয়াদের উপর। আর প্রতিবছরের ন্যায় এ বছরের শুরু থেকে অদ্যবধি নানান ঝক্কিঝামেলা পোহাচ্ছে ভাড়াটিয়ারা। মৌখিক নির্দেশে ভাড়া বাড়িয়েছে অস্বাভাবিক ভাবে। এ বৃদ্ধির পরিমাণ সর্বনিম্ন ১০০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫০০০ টাকা পর্যন্ত বলে জানিয়েছেন ভাড়াটিয়ারা।
সূত্র মতে, কক্সবাজার শহরে ৪৩ শতাংশ মানুষ ভাড়া থাকে। অথচ বেশির ভাগ বাড়িওয়ালাই ভাড়ার রশিদ দেন না। চুক্তি করেন না। কোনো বাড়ির মালিক চুক্তি করলেও সব শর্ত থাকে নিজের পক্ষে। জোর করে ভাড়াটিয়া উচ্ছেদ, ইচ্ছামত ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়গুলো সবার চোখের সামনে হচ্ছে। কিন্তু দেখার কেউ নাই। বাড়ি ভাড়া এখন লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। এ অবস্থা নিরসনে সরকার পদক্ষেপ না নিলে বাড়িওয়ালা-ভাড়াটিয়ার বিরোধ বড় ধরনের সংঘাতে রূপ নেবে।
বদরমোকাম এলাকার ভাড়াটিয়া জসিম উদ্দিন বলেন, আমি এখন যে বাসায় আছি সেখানে তিন বছরে ভাড়া বেড়েছে ৮ হাজার টাকা। ১২ হাজার টাকা ভাড়ায় উঠেছি। এখন দিতে হচ্ছে ২০ হাজার টাকা। এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে গেলে বাড়িওয়ালা বাসা ছেড়ে দিতে বলে।
শুধু শহরে নয় উখিয়া, টেকনাফের চিত্র আরো ভয়াবহ। ওখানে সুবিধাবাদী লোকজন ঘর ভাড়াকে বড় বাণিজ্য হিসেবে নিয়েছে। এমনও খবর আছে গরুর গোয়াল ঘর পর্যন্ত একটু পরিচর্যা করে ভাড়া বাসা হিসাবে ভাড়া দিচ্ছে। ওই এলাকার ৫শ’ টাকার ভাড়াবাসা এখন ৫ হাজার টাকা এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে ১০ হাজার টাকা নিচ্ছে। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, উখিয়া, টেকনাফে আশ্রয় নেয়া প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গার সেবা প্রদানে কাজ করছে দেশি-বিদেশি এনজিওসহ আন্তর্জাতিক সংস্থার লোকজন। একদিকে রোহিঙ্গা অন্যদিকে তাদের সেবা প্রদানে নিয়োজিত বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসনের কারণে শহরে বেড়েছে ভাড়া বাসার চাপ। আর এই সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে বাড়ির মালিকরা। তারা ইচ্ছামত বাড়ি ভাড়া বাড়াচ্ছে। সরজমিন দেখা যায়, যতই বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি করা হোক না কেন কোনো বাসা খালি যাচ্ছে না। রীতিমত অগ্রিম বুকিং হয়ে যাচ্ছে। আর এই সুযোগে কিছু অসাধু বাড়িওয়ালা কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে যাচ্ছেতাই বাড়ি ভাড়া বাড়াচ্ছে। এতে ভোগান্তির শেষ থাকছে না সাধারণ ভাড়াটিয়াদের।