অস্ত্র প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া আর চীন। এরই মধ্যে চীন তার সামরিক বাহিনীকে আধুনিকায়ন করেছে। এর মধ্য দিয়ে তারা যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সমান শক্তি অর্জনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এ জন্য অস্ত্র তৈরিতে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছে চীন। এ নিয়ে অনলাইন বিবিসি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, অভ্যন্তরীণ সমস্যা আর সমুদ্রসীমা নিয়ে ভৌগলিক দ্বন্দ্বের কারণে নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকেই দেশটির সামরিক বাহিনী, পিপলস লিবারেশন আর্মিকে আধুনিক করে তৈরির করতে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে চীন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের আমলে প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর সঙ্গে তাদের সামরিক ক্ষমতার পার্থক্য দ্রুত কমে আসছে এবং দেশটি দ্রুত বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশগুলোর একটি হয়ে উঠছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'চীনের দুই সংখ্যার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সম্প্রতি কমে এসেছে। কিন্তু দেশটি সামরিক শক্তিকে আধুনিকায়ন করার পাঁচ বছরের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে যেতে এখনো সক্ষম।
প্রযুক্তির নানা ধরণের ব্যবহার দেশটির সামরিক বাহিনীকে বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক কিছু অস্ত্র সম্ভারের মালিক করে তুলছে। অনেকগুলো ক্ষেত্রে দেশটি এর মধ্যেই বিশ্বের মধ্যে শীর্ষ অবস্থানে পৌঁছে গেছে।
ওই প্রতিবেদনে বিবিসি চীনের সবচেয়ে আধুনিক কিছু অস্ত্রের বিবরণ তুলে ধরেছে। এগুলো বর্তমান অস্ত্র প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে বড় ধরণের ভূমিকা রাখতে চলেছে।
১. নৌবাহিনীর সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র২০১৮ সালে সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত কিছু ছবি থেকে ধারণা করা হচ্ছে, চীন হয়তো যুদ্ধজাহাজে স্থাপন করার উপযোগী এমন অস্ত্র তৈরি করেছে যেটি শব্দের পাঁচগুণ গতিতে (হাইপারসনিক স্পিড) গুলি ছুড়তে পারে। অনেকদিন ধরেই বিশ্বের অনেক দেশ এমন অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে। 'রেলগান' নামের এই অস্ত্রটি সেকেন্ডে আড়াই কিলোমিটার গতিতে গুলি ছুড়তে পারে, যেগুলো দুইশত কিলোমিটার দূরের লক্ষবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম।
গত জুন মাসে সিএনবিসির একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই অস্ত্রটি ২০২৫ সালের মধ্যে যুদ্ধের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে যাবে। যখন এ ধরণের অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র আর রাশিয়া, এমনকি ইরানেরও এই প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহ রয়েছে, তখন হয়তো প্রথম দেশ হিসাবে চীনই তাদের যুদ্ধজাহাজে অস্ত্রটি সংযোজন করবে। চীনের রাষ্ট্রীয় পত্রিকা গ্লোবাল টাইমসের তথ্য মতে, চীনে তৈরি প্রথম ১০ হাজার টন ক্লাস মিসাইল ডেস্ট্রয়ার ০৫৫-এ ওই অস্ত্রটি প্রথম স্থাপন করা হবে।
সামরিক বিশ্লেষক এবং সাবেক পিএলএ সদস্য সঙ জংপিং সাউথ চায়না মনিং পোস্টকে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক প্রযুক্তির সমকক্ষ হয়ে ওঠার জন্য চীন কোন চেষ্টাই বাদ রাখেনি। বরং ওই ছবি দেখে মনে করা যায়, যে, চীন জাহাজে বসানো রেলগানের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে শুধু যে ধরেই ফেলেছে তা নয়, বরং আগামী পাঁচ দশ বছরের মধ্যে হয়তো ছাড়িয়েও যাবে। এর কারণ, বাজেট অনুমোদন পেতেই যুক্তরাষ্ট্রের অনেক সময় চলে যায়, যখন চীনের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এরকম প্রকল্পে সহজেই অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ হয়ে যায়।
২. হাইপারসনিক অস্ত্রসাউথ চায়না মনিং পোস্টের খবর অনুযায়ী, ২০১৮ সালের আগস্টে চীন ঘোষণা দিয়েছে যে, তারা এমন একটি হাইপারসনিক বিমান পরীক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে, যেটি বিশ্বের যেকোনো মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ভেদ করতে সক্ষম। এটি এমন একটি ‘ওয়েভ রাইডার’ বিমান যেটি নিজের তৈরি করা শব্দের ধাক্কা ব্যবহার করে বায়ুমন্ডলে দ্রুত গতিতে ভেসে বেড়াতে পারে। পরীক্ষায় জিংকং-২ (আকাশের আতংক-২) নামের চীনের ওয়েভ রাইডার বিমানটি ৩২০ কিলোমিটার উঁচুতে উঠে ঘণ্টায় ৭.৩৪৪ কিলোমিটার গতিতে ভেসে বেড়ায়। তবে এই বিমানটি চীনের প্রথম হাইপারসনিক বিমান নয়- ২০১৪ সাল থেকেই দেশটি বায়ুমন্ডলে ভেসে থাকা বিমান পরীক্ষা করে যাচ্ছে। কিন্তু এই প্রথমবার তারা এমন একটি বিমান তৈরি করেছে যেটি ওয়েভ রাইডার প্রযুক্তি ব্যবহার করে।
সাউথ চায়না মনিং পোস্টের তথ্য মতে, যখন পুরোপুরি প্রস্তত হয়ে যাবে, তখন এই ওয়েভ রাইডারগুলো বোমা নিয়ে বর্তমান বিশ্বের যেকোনো মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করে যেতে পারবে। তবে বেইজিংয়ের সামরিক বিশ্লেষক যোউ চেনমিং ওই পত্রিকাকে বলেছেন যে, চীনের ওয়েভ রাইডারগুলো সম্ভবত পারমাণবিক অস্ত্রের বদলে প্রচলিত বোমাগুলো বহনে ব্যবহৃত হবে। তিনি বলেছেন, 'আমার মতে, এই প্রযুক্তি বোমা বহনে সক্ষম হয়ে উঠতে এখনো তিন থেকে পাঁচবছর সময় লাগবে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক কমান্ডের প্রধান অ্যাডমিরাল হ্যারি হ্যারিস মার্কিন কংগ্রেসে বলেছেন, হাইপারসনিক অস্ত্র তৈরির ক্ষেত্রে প্রতিযোগীদের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র পিছিয়ে পড়েছে। তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন যে, এমনটাও হতে পারে যে, চীন মিসাইল ছুড়েছে এবং আমেরিকার রাডার সেগুলো সনাক্ত করার আগেই মার্কিন জাহাজ বা ভূখন্ডে তা আঘাত করেছে। তিনি আরো বলেন, আমাদের উচিত নিজস্ব হাইপারসনিক অস্ত্র তৈরিতে উঠেপড়ে কাজ শুরু করা।
২০১৭ সালে হাইপারসনিক মিসাইল- ডিএফ-১৭ তৈরির ঘোষণা দেয় চীন, যেটি ১৮০০ থেকে ২০০০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে সক্ষম।
৩. চীনের ‘সব বোমার মা’গত মাসে নতুন ধরণের একটি বিশাল বোমার প্রদর্শন করেছে চীন, যাকে বলা হচ্ছে চীনের ‘সব বোমার মা’। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসিভ অর্ডিন্যান্স এয়ার ব্লাস্টের মতো যেটিকে বর্ণনা করা হচ্ছে। প্রচারণা ভিডিওতে চীনের অস্ত্র তৈরির প্রধান কোম্পানি নোরিনকো দেখিয়েছে, এইচ-সিকে বোমারু বিমান থেকে বোমাটি ফেলা হচ্ছে এবং বড় ধরণের বিস্ফোরণ ঘটছে।
রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা শিনহুয়া বলছে, ওই বোমাটি হচ্ছে চীনের পারমাণবিক অস্ত্রের বাইরে সবচেয়ে শক্তিশালী বোমা এবং এটি এতো বড় যে, একটি এইচ-৬কে বোমারু বিমান একেকবারে মাত্র একটি বোমাই বহন করতে পারে। বেইজিংয়ের সামরিক বিশ্লেষক ওয়েই ডংজু গ্লোবাল টাইমসকে বলেছেন, তুলনা করা হলেও, চীনের বোমাটি আমেরিকান এ ধরণের বোমার তুলনায় খানিকটা ছোট।
তিনি ধারণা করেন, চীনের বোমাটি প্রায় পাঁচ ছয় মিটার লম্বা- অথচ আমেরিকান বোমাটি প্রায় ১০ মিটার লম্বা এবং হালকা, যার ফলে সেটি বহন করা সহজ। ওয়েই বলছেন, 'এই বিশাল বোমার বিস্ফোরণে বিশাল ভবন, ঘাঁটি বা প্রতিরক্ষা কেন্দ্রগুলো একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। ২০১৭ সালে আফগানিস্তানের ইসলামিক স্টেটের গুহাগুলোর ওপর এ ধরণের একটি বোমা ফেলেছিল যুক্তরাষ্ট্র।
রাশিয়ারও এ ধরণের বোমা রয়েছে- যাকে বলা হয় ‘সব বোমার বাবা’। এটা আমেরিকান বোমাটির চেয়ে আকারে বড় এবং যখন ফেলা হয়, তখন শক ওয়েভের বদলে আগুনের কুন্ড তৈরি করে।