× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার , ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১১ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

সূচিত্রা সেন এবং আমাদের নায়িকারা

মত-মতান্তর

মনিজা রহমান
২৩ জানুয়ারি ২০১৯, বুধবার

পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়াতে যেখানে আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা, তার খুব কাছেই সুচিত্রা সেনের দাদা-শ্বশুরের বাড়ি।  গেন্ডারিয়াকে আবাসিক এলাকায় রূপ দেয়ার পেছনে মানিকগঞ্জের জমিদার দীননাথ সেন নেতৃত্বস্থানীয় ভূমিকা  রেখেছিলেন। ওনার নামে গেন্ডারিয়াতে একটা রাস্তার নাম আছে। সেই রাস্তার পাশেই গেন্ডারিয়া হাইস্কুল ছিল দীননাথ সেনের জমিদার বাড়ি। ওনার নাতি দিবাকর সেনের সঙ্গে বিয়ের পরে সূচিত্রা সেন কিছুদিন সেই জমিদার বাড়িতে ছিলেন। ছোটবেলায় অন্য এলাকা থেকে কেউ গেন্ডারিয়ায় আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এলে সেই গল্প বলতাম। আমরা সুচিত্রা সেনের শ্বশুরবাড়ির এলাকার মানুষ, এটা কি কম গর্বের ব্যাপার! ১৭ জানুয়ারি ছিল সুচিত্রা সেনের চলে যাবার পঞ্চম বর্ষ। ভেতর-বাইরের নানা রকম শূন্যতার মধ্যে কদিন ধরে খুব মনে পড়ছে তাকে।
সেই জন্ম থেকে এখন পর্যন্ত নায়িকা বলতে তো একজনকেই বুঝতাম, তার নাম সুচিত্রা সেন। দিনে দিনে সেটা আরো টের পেলাম।
একালের কথিত নায়িকাদের কাঙালপনা সত্যিই বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ করে। কোন কিছুই তারা ছাড়তে চান না। সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য হওয়ার দৌড়ে তাদের হুড়োহুড়ি নিশ্চয়ই সবার নজর কাড়ছে। তাদের নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইদানিং হাস্যরস এবং বিতর্কের ঝড় বইছে। বিশেষ করে কয়েকজনের খোলস পরিবর্তনে অনেকে হাসাহাসি করছেন। কিন্তু এসব নিয়ে সেইসব অভিনেত্রী বা কথিত নায়িকাদের কোন মাথাব্যাথা নেই। তাদের বক্তব্য, ‘অভিনয় দিয়ে তারা জনগণের কাছাকাছি গিয়েছেন। এবার সংসদ সদস্য হয়ে সেই জনগণের সেবা করতে চান।’ কি সেবা তারা দিতে চান? সংসদ তো আইন ও নীতি তৈরি জায়গা! এ কাজের জন্য কতটা প্রস্তুত একেকজন নায়িকা বা অভিনেত্রী?  আমজনতা তাদের কাছ থেকে আইন প্রণয়ণের সেই সেবা নিতে চান কিনা সেটা কি তারা একবারও ভেবে দেখেছেন? অবশ্য আমজনতার চাওয়া-না চাওয়ার ধার কে ধারে!
সংরক্ষিত নারী আসনের যৌক্তিকতা নিয়ে বিতর্ক আছে অনেকদিনের। কারণ এই পদ্ধতিতে সংসদ সদস্য হওয়া নারীর ক্ষমতায়ণ-প্রক্রিয়ার আদৌ সহায়কা কিনা সেই প্রশ্ন বেশ জোরালোভাবেই আছে। তাছাড়া এভাবে নারীকে
দ্বিতীয় স্তরের নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করা হয় কিনা তা নিয়েও বিতর্ক আছে। দেশের প্রধানমন্ত্রী যেখানে নারী, স্পিকার নারী, মন্ত্রীরা নারী, একাধিক সংসদ সদস্য নারী- সেখানে এই করুণার দান নেবার প্রয়োজন কি! বরং সব আমলেই সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্যদের সংকীর্ণ দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হয় বলে অভিযোগ আছে। যারা নিজেদের শয়নে-স্বপনে-জাগরণে নারীবাদী ভাবেন, বলে বেড়ান, তাদের যখন দেখি সংরক্ষিত আসনে ফর্ম কেনার লম্বা লাইন দিয়ে আছে, তখন তাদের বিশ্বাসবোধ সম্পর্কে বিস্ময় জাগে। নাটক সিনেমার কথিত নায়িকাদের বিরাট একটি অংশ এখন যেন দুধের মাছি! সবাই হতে চান সংসদ সদস্য। এজন্য তদবির করতে চাঁদে যেতে হলেও যাবেন। এক রিপোর্টে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের ৪৩ জন নারী সংসদ সদস্যের বিপরীতে প্রায় দেড় হাজার মনোনয়ন ফর্ম জমা পড়েছে। মনোনয়ন ফরম বিক্রি বাবদ আওয়ামী লীগের কোষাগারে জমা পড়েছে ৪ কোটি ৫৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
জ্ঞানীজনেরা বলেন, খ্যাতির মধ্যগগনে থেকে যিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে যান, তাকে মনে রাখে জগত, ভুলে যায় না মানুষ। পৃথিবীতে কারো অকাল মৃত্যু কাম্য নয়। সুচিত্রা সেন অকালে মারা যাননি। তিনি ৮২ বছর বেঁচে ছিলেন। তার বার্ধক্যের নয়, সবার মানসপটে চির জাগরুক যৌবনের মোহনীয়, শ্বাশত বাঙালি রূপ। কারণ তিনি জানতেন, কখন থামতে হয়। কতটুকুতে সন্তুষ্ট হতে পারে একজন মানুষ। পশ্চিম বাংলার আরেকজন নামকরা অভিনেত্রী মাধবী চট্টোপাধ্যায় আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘উনি (সুচিত্রা) জানতেন, কখন থামতে হয়। আমরা অনেকে তা পারিনি। আসলে এই থেমে যাওয়াটাও জীবন ও শিল্পের অনুষঙ্গ। থামতে না জানলে পঁচে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।’

মোট ৬১ সিনেমায় অভিনয় করলেও সুচিত্রা সেন বেশি বিখ্যাত হয়েছেন উত্তম কুমারের সঙ্গে জুটিবদ্ধ সিনেমাগুলিতে। ২৫ বছর সিনেমাতে অভিনয়ের পরে ১৯৭৮ সালে চলচ্চিত্র থেকে দূরে সরে যান তিনি। এরপর আর তাকে জনসমক্ষে দেখা যায়নি। এ সময় তিনি রামকৃষ্ণ মিশনের সেবায় ব্রতী হয়েছিলেন বলে শোনা যায়। ২০০৫ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারের জন্য সুচিত্রা সেন মনোনীত হয়েছিলেন, কিন্তু ভারতের রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে সশরীরে পুরস্কার নিতে দিল্লি যেতে আপত্তি জানানোর কারণে, তাকে পুরস্কার দেয়া হয়নি।
দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার পাওয়া যে কোন ভারতীয়ের জন্য আজীবনের স্বপ্ন। কেবল সশরীরে যাবেন না বলে সুচিত্রা সেন পুরস্কারটি প্রত্যাখান করেছেন। এটা সবাই পারেন না। পুরস্কার প্রত্যাখান দূরের কথা, এলেবেলে একটা পুরস্কার জেতার জন্য কত রকম তৎপরতা চলে। আর একটা না হলে, অন্য আরেকটা পুরস্কার তো চাই-ই চাই! কারণ একজন শুধু সিনেমার নায়িকা হলে কথা ছিল। সে টেলিভিশনেরও নায়িকা। আবার উপস্থাপনা, গান করা, নৃত্য পরিবেশন, কবিতার বই বের করা সবই করে। নতুন আগতদের তার জায়গা করে দিতে চান না। সবকিছু এক হাতের মুঠোয় রাখতে পারাটাই যেন সাফল্য! সার্থকতার কথা তো বলাই বাহুল্য। অভিনেত্রী, উপস্থাপিকা, নৃত্যশিল্পী, সঙ্গীতশিল্পী, আবৃত্তিকার- সর্বগুনে গুনান্বিতা তারা। এই যে কদিন পরে বইমেলা আসছে, সেখানে দেখা যাবে তাদের কবিতার বইও প্রকাশিত হচ্ছে।
সুচিত্রা সেন সিনেমা ছাড়ার পরে প্রায় ৩৫ বছর লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিলেন। এমনকি মৃত্যুকালে কফিনেও ছবি তোলার সুযোগ পাননি কেউ। এই যে রহস্যময়তা, এই যে আড়াল- এটাই তাঁকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে করে তুলেছে দুর্লভ-আকর্ষণীয়। সুচিত্রার ছিল সুকঠিন ব্যাক্তিত্ব। সবার সঙ্গে তিনি মিশতেন না। সত্যজিৎ রায়, গুলজার, রাজকাপুরের মতো মানুষের ছবিও তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন। উত্তম কুমারের সঙ্গে তাঁর রোমান্টিক সম্পর্ক নিয়ে চলেছে নানা জল্পনা-কল্পনা, সুচিত্রা সেসব নিয়ে কখনও কোন প্রতিক্রিয়া দেখাননি।

পুরনো দিনের এক সিনেমা তারকার সাক্ষাৎকারে পড়েছিলাম, তিনি কখনও স্টেশনে তেল নেবার সময় গাড়ি থেকে বের হতেন না। কারণ ওখানে সবাই তাহলে তাকে দেখে ফেলবে। উনি বলতেন, ‘সবাই যদি আমাকে বিনা খরচেই দেখে ফেলে, তাহলে আর টাকা খরচ করে টিকেট কেটে হলে কেন দেখতে যাবে? হ্যাঁ এটাকে কারো কাছে স্ট্যান্টবাজি মনে হতেই পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তারকারা যত তাদের চারপাশে রহস্যের মেদুরতা সৃষ্টি করে রাখতে পারবেন, ততই তাদের প্রতি ভক্তকুলের আকর্ষণ বাড়বে। সুচিত্রা সেন সেটা পেরেছেন। উনি লোভকে জয় করতে পেরেছেন। উনি জানতেন কোথায় থামতে হয়। আর সে কারণেই সবাই সুচিত্রা সেন হয় না, হতে পারে না।
(মনিজা রহমান, সাংবাদিক, লেখক)
[email protected]
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর