× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, মঙ্গলবার , ১০ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৪ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

ওরা হাওর পাড়ের পুঁজিহীন মৎস্যজীবী

বাংলারজমিন

ইমাদ উদ দীন, মৌলভীবাজার থেকে
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, শনিবার

ওরা ‘টেফিউল’। বড় জালের পড়ে যাওয়া মাছ ধরাই যাদের জীবিকার অবলম্বন। এ পেশা বছর জুড়ে নয়। শুধু মৌসুমেই থাকে জমজমাট। তারপরও এমন অদ্ভুত পেশার আয় রোজগার দিয়েই চালাতে হয় তাদের জীবন সংসার। ব্যতিক্রমী এ পেশা হাওরের দরিদ্র জেলেদের। যাদের জাল নেই। পুঁজিও নেই।
মূলত তারাই ‘টেফিউল’ হিসেবে পরিচিত। সকাল থেকেই স্বীয় পেশায় ছুটে চলা। যে বিলে ধরা হচ্ছে মাছ এমন বিলে ছোট্ট (প্লেইন) জাল আর মাছ রাখার খারা নিয়ে ওই বিলের উদ্দেশ্যেই বেরিয়ে পড়েন তারা। সকাল থেকে বিকাল। মাছ ধরায় নানা ফন্দি ফিকির। এমন প্রচেষ্টার পরও কোনো দিন ফিরেন হাসি মুখে খারা ভর্তি মাছ নিয়ে। আর কোনো কোনো দিন তার উল্টো দৃশ্য। প্রতিদিনই জালুয়া (ইজারাদারদের নির্দিষ্ট জেলে) আর ইজারাদের নানা ঘাত প্রতিঘাত সহ্য করেই চলে তাদের এমন জীবন যুদ্ধ। বিলের মাঝখান থেকে তীরে ভেড়া জালে জেলেদের অগোচরে ফেলে যাওয়া মাছ কুড়ানোই তাদের পেশা। এমন করে সারা দিনের সংগৃহীত মাছ বিক্রির আয় রোজগার দিয়েই চলে সংসার। এ যেন ভিন্নরকম এক জীবন সংগ্রাম। টান দে ভাই হেইয়া। গায়ের বল। জোয়ান দল। আগে চল মনবল। জোরে জোরে আরো জোরে। হেইয়া হেইয়া। শুষ্ক মৌসুমে প্রতিদিনই সকাল দুপুর হাকালুকি হাওরের ফিশিং হওয়া বিলের মধ্যখান থেকেই এমন আওয়াজ আসে কানে। এমন আওয়াজ নতুন আগন্তুক বা দর্শনার্থীদের কৌতূহলী করলেও মাছ ধরার মৌসুমে তা হাওর এলাকায় খুবই পরিচিত। জালে ধরা পড়েছে ছোট বড় মাছ। তাই জাল টানতে জেলেদের এমন শক্ত খাটুনি। জাল ভর্তি মাছ জেলেদের টেনে আনছেন তীরে। এমন দৃশ্য ওদের জন্য আনন্দের। এ দৃশ্যেরই জন্য তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করেন টেফিউলরা। কারণ একটাই। মাছ ধরার বড় জাল তীরে ভিড়ছে। অনেকটা দূর থেকেই আঁচ করা যাচ্ছে জালের ভেতরে আটকা পড়া মাছের লাফ ঝাঁপ। জাল যত কাছে আসে টেফিউলদের চাহুনি ততই তীক্ষ্ণ হয়। তীরের কাছাকাছি দূরত্বে বড় জাল থেকে পড়ে যাওয়া ছোট বড় মাছই তাদের মূল লক্ষ্য। কারণ এ মাছগুলোই তারা ধরবে। এ এক ভিন্ন রকম জীবন যুদ্ধ। সম্প্রতি হাকালুকি হাওরের চকিয়া বিলে দেখা মিলে টেফিউলদের। কথা হয় মাছ ধরার অপেক্ষায় বিলের পাড়ে থাকা ভূকশিমইল ইউনিয়নের টেফিউল আকবর, জসিম, কলিম, সফাই, জাবেদ ও মইদ মিয়াসহ অনেকেরই সঙ্গে। তারা জানালেন এই পেশায় তাদের সুখ দুঃখের কথা। তারা বললেন, এখন এ পেশায় আনন্দ নেই। কারণ এখন দিন যত যাচ্ছে হাকালুকি ভরাট হয়ে তত দুর্দশায় পড়ছে। এখন শুধু নেই নেই। মাছ নেই। পাখি নেই। জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীও নেই। আগের দেখা সে হাওর, সম্পদ আর ঐতিহ্য এখন বিলীনের পথে। টেফিউলরা জানালেন আগে শুষ্ক মৌসুমে জাল নিয়ে এরকম বিলের পাড়ে অপেক্ষা করতে হতো না। তখন পানি কমে যাওয়াতে জাল নিয়ে বের হলেই বাড়ি কিংবা বিলের আশপাশেই প্রচুর মাছ ধরা যেত। এখন নানা কারণে বর্ষা কিংবা শুষ্ক মৌসুমেই জাল থাকলেও মাছ ধরা যায় না। তাছাড়া যাদের জাল নেই তাদের তো আর কিছুই নেই। আগে অবাধে সব জায়গায় মাছ ধরা যেত। মাছও মিলতো। এখন পুরো বিপরীত চিত্র। নানা সমস্যায় জর্জরিত হাওর মৃত্যুপথ যাত্রী। তারপরও এই হাওরকে কেন্দ্র করেই জীবন বাঁচান হাওর পাড়ের মানুষ। এই হাওরই তাদের জীবন জীবিকার একমাত্র অবলম্বন। তারা জানালেন রেওয়াজী ঐতিহ্যের কারণে আর অভাব অনটনের কারণে তারা টেফিউল পেশায় নেমেছেন। টেফি ধরা আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। কোনো রকম পুঁজি ছাড়া শুধু কায়িক পরিশ্রমেই মাছ ধরে ভালো আয় রোজগার হতো। কিন্তু এখন এই ঐতিহ্য নেই বললেই চলে। এখন কোনো বিল, ডোবা বা জলাশয়ে মাছ টেফি ধরতে গেলে ইজারাদার আর তাদের জালুয়াদের নানা অত্যাচার সহ্য করতে হয়। জালটেনে পাড়ে তোলার সময় ইজারাদারের লোকজন ও জেলেরা তাদের উপর কাঁদা ও পানি ছুড়ে দেয় যাতে মাছ ধরতে জাল পর্যন্ত টেফিউলরা ভিড়তে না পারে। শীতের সময় এটা অনেক কষ্টকর। আগে শুধু শুষ্ক মৌসুমের টেফি ধরার আয় দিয়ে সারা বছর সংসার চালানো যেত। এখন মাছ পর্যাপ্ত না থাকায় ইজারাদারও খুব সতর্ক দৃষ্টি রাখেন বিলের প্রতি। তাই কোনো দিন অপেক্ষা করেও খালি হাতে ফিরতে হয় তাদের। তখন পরিবার পরিজন নিয়ে থাকতে হয় উপোষ। মাছ ধরার পেশায় অভ্যস্ত থাকায় অন্য পেশায়ও তাদের স্বাছন্দ্য নেই। আর পুঁজি না থাকায় নিজের বড় জাল নেই তাই জীবিকার জন্য কায়িক পরিশ্রমই তাদের একমাত্র ভরসা। কারণ বড় জেলে দলে অনেক সময় তাদের নেয়া হয় না। আর নিলেও তাদের পারিশ্রমিক দেয়া হয় খুবই কম। রাত দিন শক্ত খাটুনির পরও পরিবারের দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের নিশ্চয়তাও মেলে না। টেফিউলদের জোর দাবি হাওর পাড়ের কয়েক লাখ মানুষের জীবন জীবিকা বাঁচাতে আর মাছে উৎপাদন বাড়াতে ভরাট হয়ে যাওয়া হাওর হাকালুকির বিল, সংযোগ খাল, গাঙ্গ ও ছড়াগুলো খননের। খনন আর পরিকল্পিত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমেই ফেরানো যাবে হাকালুকির প্রাণ। আর হাকালুকির প্রাণ ফিরলেই রক্ষা পাবে এ অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা ও পরিবেশ। নাগুয়া ও গৌড়কুড়ি বিলের ইজারাদার ছায়েদ আলী বললেন, আগে টেফিউলদের কখনই তাড়ানো হতো না। কারণ তখন ছিল মাছ আর মাছ। তিনি জানালেন উজানের পলিতে বিল ভরাট হওয়াতে বিলগুলোতে পর্যাপ্ত মাছ নেই। এবছর তিনি দু’টি বিলেই লোকসান গুনছেন। ইজারাদারদের পক্ষ থেকে তার জোর দাবি বিলগুলো খননের মাধ্যমে দেশীয় প্রজাতির মাছ রক্ষার। তাহলে সরকার যেমন বড় অঙ্কের রাজস্ব পাবেন। তেমনি হাওরকে কেন্দ্র করে জীবন জীবিকা রক্ষাকারী কয়েক লাখ মানুষও প্রাণে বাঁচবে।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর