ব্লাস্ট রোগ গম চাষের জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে মেহেরপুরসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে। এর কারণে মেহেরপুরে তিন বছর ধরে নিষেধাজ্ঞার কবলে গম চাষ। চাষিরা ব্যক্তিগতভাবে কিছু চাষ করলেও সরকারি নিষেধাজ্ঞা এখনো বলবৎ রয়েছে। এর মধ্যে বিষেষজ্ঞ পর্যায়ে ব্লাস্টের কারণ উদ্ভাবন, প্রতিরোধ পদ্ধতি ও প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবনের গবেষণা চলছে। গবেষণা সফল হলে এক যুগান্তকারী উদ্ভাবনী দুয়ার খুলে যাবে। প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে ব্লাষ্ট ছত্রাককে। জানা গেছে, কৃষি গবেষণা ফাউণ্ডেশনের (কেজিএফ) এর অর্থায়নে গমের ব্লাস্ট রোগ দমনে ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি), ময়মনসিংহস্থ বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) ও মেহেরপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) যৌথভাবে মেহেরপুরে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালযের উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব (প্ল্যান্ট প্যাথলজি) বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. বাহাদুর মিয়ার তত্ত্বাবধানে ১২ জন এমএস শিক্ষার্থী এ বিষয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
মেহেরপুর সদর উপজেলার নতুন মদনাডাঙ্গা রেজাউল হকের ২ বিঘা জমি লিজ নিয়ে সেখানে এ গবেষণা কার্যক্রম চালাচ্ছেন তারা। মেহেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. আখতারুজ্জামান জানান, গমের ব্লাস্ট একটি ক্ষতিকর ছত্রাকজনিত রোগ। ছত্রাকটির বৈজ্ঞানিক নাম ম্যাগনাপরথি অরাইজি (পাইরিকুলারিয়া অরাইজি) প্যাথোটাইপ ট্রিটিকাম। গমের শীষ বের হওয়া থেকে ফুল ফোটার সময়ে তুলনামূলক উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়া থাকলে এ রোগের সংক্রমণ ঘটতে পারে। রোগটি ১৯৮৫ সালে সর্বপ্রথম ব্রাজিলে দেখা যায় এবং পরে বিভিন্ন দেশে এর বিস্তার হয়। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, বরিশাল ও ভোলা জেলার প্রায় ১৫ হাজার হেক্টর জমিতে এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়, যা মোট গম আবাদি জমির প্রায় ৩ শতাংশ। তবে রোগটি প্রথম শনাক্ত করা হয় মেহেরপুর জেলায়। এ রোগের কারণে আক্রান্ত গমের ফলন শতকরা ২৫ থেকে ৩০ ভাগ কমে যায় এবং ক্ষেত্র বিশেষে কোনো কোনো ক্ষেতের ফসল প্রায় সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়ে যায়। ড. আখতারুজ্জামান আরো জানান, প্রাথমিক পর্যায়ে ব্লাস্ট আক্রান্ত গম ক্ষেতের কোনো কোনো স্থানে শীষ সাদা হয়ে যায় এবং অনুকূল আবহাওয়ায় তা অতি দ্রুত সারা ক্ষেতে ছড়িয়ে পড়ে। আক্রান্ত শীষের দানা অপুষ্ট হয় ও কুঁচকে যায় এবং দানা ধূসর বর্ণের হয়ে যায়। পাতায়ও ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ হতে পারে এবং এ ক্ষেত্রে পাতায় চোখের মতো ধূসর বর্ণের ছোট ছোট নেক্রোটিক দাগ পড়ে। আক্রান্ত বীজ এবং বাতাসের মাধ্যমে গমের ব্লাস্ট রোগ ছড়ায়। বৃষ্টির কারণে গমের শীষ ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টা ভেজা থাকলে এবং তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস অথবা এর বেশি হলে এ রোগের সংক্রমণ হয় এবং রোগের জীবাণু দ্রুত বাতাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। মেহেরপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও গবেষণা টিমের সদস্যদের কাছে থেকে জানা গেছে, গমের ব্লাস্ট আক্রমণের পর থেকে বিগত চার বছরে এটা নিয়ে দেশে বিদেশের গম বিজ্ঞানীরা ব্লাস্ট আক্রান্ত এলাকাসমূহ পরিদর্শন করে এটাকে নির্মূল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
ওদিকে বাংলাদেশে গমের ব্লাস্ট রোগ দমনের জন্য মেক্সিকোতে অবস্থিত আন্তর্জাতিক গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটও (সিমিট: ঈওগগণঞ:ঞযব ওহঃবৎহধঃরড়হধষ গধরুব ধহফ ডযবধঃ ওসঢ়ৎড়াবসবহঃ ঈবহঃবৎ) বাংলাদেশের গম বিজ্ঞানীদের সাথে একসাথে কাজ করে যাচ্ছেন। ছোট বড় মিলিয়ে এখানে প্রায় ১১ টি পরিক্ষা পরিচালনা করা হচ্ছে। তবে গবেষনায় ৭টি কার্যকরী পদ্ধতি প্রয়োগ করা হচ্ছে। এর মধ্যে যে পদ্ধতিটি ব্লাষ্ট প্রতিরোধ ভুমিকা রাখবে সেটিও গবেষনার চুড়ান্ত ফলাফল হিসেবে ধরা হবে। আগামি দুই মাসের মধ্যে এর চুড়ান্ত প্রতিবেদন পাওয়া যাবে বলে আশা করছেন গবেষক দল। কার্যকরী পদ্ধতিগুলো হচ্ছে- ছত্রাকনাশকের কার্যকারিতার পরিক্ষা, মাটিতে সার প্রয়োগ, পাতায় সার প্রয়োগ, বীজবাহিতের পরিক্ষা, বিভিন্ন জাতের গমে ব্লাস্ট প্রতিরোধী পরিক্ষা, মিউটেশন পরিক্ষা , মসুরের সাথে শস্য পর্যায় অবলম্বন। এছাড়ার আরো চার ধরণের পদ্ধতি গবেষণা পরিক্ষণ হিসেবে চালানো হচ্ছে।
মেহেরপুর সদর উপজেলার গোভীপুর গ্রামের গম চাষী মিরাজুল ইসলাম জানান, তিনি এ বছর তিন বিঘা জমিতে গমের চাষ করেছেন। এর মধ্যে দেড় দেড় বিঘা আগাম গম চাষ করেছেন। গমে আর কিছুদিন পর শীষ আসবে। তখন বোঝা যাবে ব্লাষ্ট রোগ হবে কিনা। তবে এই রোগটি নিয়ে আমরা খুব দুশিন্তায় আছি। এই রোগটি একটি শীষে হলেও পুরো জমিতে ছড়িয়ে পড়ে। গমের দানা হয় না। কুষি অফিস থেকে ওষুধ (বালাইনাশক) স্প্রে করতে বলেছে। আমরা সেভাইে ওষুধ স্প্রে করছি।
শামিমুল ইসলাম নামের মেহেরপুর শহরের এক গম চাষী জানান, গত বছর দুই বিঘা জমিতে গম চাষ করেছিলেন। ব্লাষ্ট রোগে আক্রান্ত হওয়ায় দুই বিঘা জমি থেকে মাত্র ৭ মন গম পেয়েছিলেন। তবে সেই গম খাওয়ার উপযোগী ছিলনা বলে তিনি জানান। এ কারণে এ বছরে তিনি গমের চাষ করেননি।
গবেষনা দলের অন্যতম সদস্য নাবেদ মাহমুদ জানান, আশা করছি গমের ছত্রাকজনিত রোগ ব্লাষ্ট রোগের কারণ উৎঘাটনসহ প্রতিরোধ ব্যবস্থা উদ্ভাবন করা সম্ভব হবে। এর জন্য আরো দুই মাস সময় লাগবে। প্রফেসর ড. বাহাদুর মিয়া উদ্ভিদের রোগতত্ত্ব নিয়ে অনেক অভিজ্ঞ। তার নেতৃত্বে আমরা এই গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করছি। আশা করছি আমরা একটি যুগান্তকারী উদ্ভাবন করতে সক্ষম হবো।
ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. বাহাদুর মিয়া বলেন, ব্লাস্ট গমের চাষের জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে দাড়িয়েছে। আমরা এক বছর ধরে ব্লাস্টতরোধী গমের জাত উদ্ভাবনের গবেষণা চালাচ্ছি। আরো দুই বছর সময় লাগতে পারে। এই গবেষণাটি বাংলাদেশেই প্রথম হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, তবে বালাইনাশক ব্লাস্ট আক্রান্ত হওয়ার আগে স্প্রে করলে প্রতিরোধ হতে পারে। এছাড়া প্রোভেক্স নামক এক ধরণের ওষুধ বীজে মিশিয়ে (প্রতি কেজি বীজে ৩ গ্রাম) বপন করলে প্রতিকার পাওয়া যেতে পারে। প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবন না হওয়া পর্যন্ত স্থায়ী সমাধান হবে না।