× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২ মে ২০২৪, বৃহস্পতিবার , ১৯ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৩ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

এক ধর্ষিতার বাঁচার লড়াই

শেষের পাতা

পিয়াস সরকার
১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, রবিবার

কপালে কলঙ্কের তিলক নিয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। সমাজে ঘৃণিত হয়ে বাস করছেন। প্রতিবেশী এমনকি স্বজনরাও তার দিকে তাকায় আড় চোখে। এ কলঙ্ক তার সংসার খেয়েছে। এখন কুরে কুরে খাচ্ছে জীবন। ভয়াল দুঃখভরা স্মৃতি নিয়ে তিনি বেঁচে আছেন। বলেন, আত্মহত্যা মহাপাপ। নয় তো মরণকেই বেছে নিতাম।
এ এক ধর্ষিতার কাহিনী। জীবনের মূল্যবান সম্পদ ইজ্জত হারিয়ে এখন বেঁচে আছেন জীবন্ত লাশ হয়ে। তার চেহারায় বয়সের ছাপ স্পষ্ট। হাঁটতে পারেন না ঠিকমতো। কথা বলতেও জড়িয়ে যায় গলা। রাজধানীর ধানমণ্ডি লেকপাড়ে তার বর্তমান আবাস। ভিক্ষা করে জীবন চালান। বয়স সত্তরের কাছাকাছি। সেই ভয়াল কালরাতের কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন তিনি। জীবনকে তছনছ করে দেয়া সে রাতে কি ঘটেছিল? তিনি বলেন, আজ থেকে ত্রিশ বছর আগের কথা। স্বামীর বাড়ি থেকে বেড়াতে এসেছিলাম বাবার বাড়িতে। এক রাতে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে ঘরের বাইরে যাই।

সেখানেই ঘটে তার জীবনের ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন। ৪ বখাটে ওত পেতে ছিল। বাইরে বেরুতেই ওরা আমাকে জাপটে ধরে। ধর্ষণ করতে থাকে। সারা রাত চারজনে মিলে ধর্ষণ করে। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। একপর্যায়ে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলি। পরদিন ভোরবেলা সংজ্ঞাহীন অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এই ধর্ষণ ঘটনার কারণে স্বামীর ঘর আর করা হয়নি। কারণ স্বামী আমাকে আর ঘরে তুলে নেয়নি।  

বছরখানেক সময় লাগে তার সুস্থ হতে। শারীরিকভাবে সুস্থ হলেও মানসিক অসুস্থতা বয়ে বেড়াচ্ছেন দীর্ঘ ত্রিশ বছর ধরে। তিনি বলেন, স্বামী যখন আমাকে বলে তোমার দোষেই এ ঘটনা ঘটেছে তখন চোখ অন্ধকার হয়ে আসে। পৃথিবীতে নিজেকে একা মনে হয়। কথা বলতে বলতে কিছু সময় চুপ করে থাকেন তিনি। পানি পান করে কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, এরপর ভাইয়ের বাড়িতে থাকা শুরু করেন। অনেকে বিরক্ত করা শুরু করে। কু-প্রস্তাব, কটুকথা, রাতে বাড়ির ছাদে ঢিল মারতে থাকে। ভয়াল সেই রাতের স্মৃতি আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। রাতে ঘুমের মধ্যে হঠাৎ চমকে ওঠেন। এরপর থেকে অনিদ্রা সঙ্গে বিশ্বাসহীনতায় ভুগতে শুরু করেন। বলেন, রাতে ঘুমাইতে পারতাম না। চোখ লাগলেই দম বন্ধ হয়ে যায়। কাউকে বিশ্বাস হয় না। যাকে দেখি তাকে ভয় লাগে।

তার বাড়ি লালমনিরহাট জেলার হাতিবান্দা উপজেলায়। জন্ম এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে। বিয়ে হয় ১৫ বছর বয়সে, পাশের জেলা কুড়িগ্রামে। তার স্বামী ইলিয়াস উদ্দিন ছিলেন স্বাবলম্বী। ১৮ বছর বয়সে গর্ভবতী হন। কিন্তু সেই সন্তান আলোর মুখ দেখেনি। মৃত সন্তান প্রসব করেন। কিছুদিন পর কালাজ্বরে মৃত্যু হয় তার স্বামীর।

৮ ভাইবোনের বড় সে। মিনারার ফের বিয়ে হয় পাশের গ্রামের মিজানুর রহমানের সঙ্গে। তার দ্বিতীয় স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে পা রাখেন সে বাড়িতে। তবে আগের সন্তান নষ্ট হওয়ার কারণে শারীরিক জটিলতায় হারিয়ে যায় সন্তান জন্ম দেয়ার ক্ষমতা। দ্বিতীয় শ্বশুরবাড়িতে কাটে আরো চার বছর। সন্তান জন্মদানে অক্ষম হওয়ায় পরেও শ্বশুরবাড়িতে শান্তিতেই ছিলেন তিনি। ততোদিনে বাবা-মা মৃত্যুবরণ করেন। পরিবারের দায়িত্ব চলে যায় ভাইদের হাতে।

বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর পৃথক হয়ে যায় ৩ ভাই। ওই সময়ই স্বামীর বাড়ি থেকে বেড়াতে আসেন বাপের বাড়ি। ঘটে জীবনের ভয়াবহ ঘটনা। এ ঘটনা তাকে দুমড়ে মুচড়ে দেয়। স্বামী তাকে আর ঘরে তুলেনি। এরই মাঝে তাকে নিয়ে গ্রামে চলতে থাকে নানা কথা। লোকের কথার হাত থেকে বাঁচতে ভাইদের সহযোগিতায় আসেন ঢাকায়। উঠেন এক পরিচিতের বাড়িতে। নতুন ভাবে নিজেকে আবিষ্কার করেন। সেই বাড়িতে তার কাজ ছিল বাচ্চাদের দেখভাল করা। বাড়ির সেই লোককে চাচা ডাকতেন তিনি। চাচা-চাচী দুজনই চাকরি করতেন। সে বাড়িতে ছিল এক মেয়ে ও এক ছেলে। ধীরে ধীরে ছেলেমেয়েগুলো বড় হতে থাকে। তারা তাকে আপা বলে ডাকতো।

ভাইয়েরা প্রথম প্রথম যোগাযোগ রাখতেন। কয়েকবার বোনকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য এসেছিলেন। কিন্তু তিনি যাননি। এরপর ধীরে ধীরে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায় ভাইদের সঙ্গে।

বলেন, আমি ছিলাম সেই বাড়ির কাজের মেয়ে। কিন্তু বিয়ের দিন আপা তার জামাই নিয়ে আমাকে সালাম করেছে। তবে বাড়ির ছোট ছেলেটি তাকে সহ্য করতে পারতেন না। কথায় কথায় অভিযোগ করতেন। গায়ে হাত তুলতেন। সেসব মুখ বুজেই সহ্য করে যান। এরপর ভাইয়ের বিয়ে হওয়ার পর ভাবিও আমাকে দেখতে পারতো না। চাচা মারা যান ২০১২ সালে। সেই বছরেই তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়।

অকূল পাথারে পড়েন। ভাবতে থাকেন বৃদ্ধ বয়সে কী করবেন? এরপর থেকে ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়েন। প্রথমে থাকা শুরু করেন গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে। সেখান থেকে চলে আসেন ধানমণ্ডি লেকের পাড়ে।

তিনি বলেন, আমার জীবন এমন হওয়ার কথা ছিল না। কতগুলো কুত্তার জন্য এমন হইছে। আমার বাপের ভিটাত থাকতে পারলাম না লজ্জায়। মানুষের বাড়িতে কাম করা লাগলো। কেন? আমি কী দোষ করেছিলাম? দোষ তো আমার নাই। তারপরও আমার স্বামী ছেড়ে দিলো। বুড়া বয়সেও বাড়ি যাইতে পারি না। আজও ঠিকমতো ঘুমাতে পারি না। এখন আছি শুধু মৃত্যুর অপেক্ষায়।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর