মানবতার শান্তি ও কল্যাণ কামনা করে আখেরি মোনাজাতের মধ্যদিয়ে প্রথম পর্বের বিশ্ব ইজতেমা গতকাল শনিবার শেষ হয়েছে। মোনাজাত চলাকালে সমগ্র ইজতেমা ময়দান ও আশপাশের এলাকায় পিনপতন নীরবতা নেমে আসে। আমিন আমিন আলাহুমা আমিন, ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে টঙ্গীর তুরাগ তীর। ধনী-গরিব, নেতা-কর্মী নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশা-গোষ্ঠীর মানুষ আল্লাহর দরবারে দুই হাত তুলে নিজ নিজ কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান সবাই মহান আল্লাহর দরবারে নিজেকে সমর্পণ করে নিজ নিজ গুণাহ মাফের জন্য আখেরি মোনাজাতে শরিক হন। আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করেন তাবলিগ জামাতের বাংলাদেশের মুরব্বি কাকরাইল মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা মো. যোবায়ের। বেলা ১০টা ৪৩ মিনিট থেকে মোনাজাত শুরু হয়ে ১১টা ৬ মিনিট পর্যন্ত চলে।
২৩ মিনিটের মোনাজাতে আরবি ভাষায় ‘রাব্বানা যলামনা আনফুসানা’ দিয়ে শুরু করা হয়।
এ মোনাজাতে দেশি-বিদেশি প্রায় ২৫-৩০ লাখ ধর্মপ্রাণ মানুষ অংশ নেন। মোনাজাতের সময় লাখো মুসল্লি দুই হাত তুলে আমিন আমিন করে মহান আল্লাহর কাছে মাগফিরাত কামনা করেন। মোনাজাতে অংশ নিতে বাদ ফজর থেকে লাখ লাখ মুসল্লি চারদিক থেকে ইজতেমার ময়দানের দিকে আসতে থাকে। এসময় টঙ্গী হয়ে ওঠে সব পথের মোহনা। দোয়ায় হে আল্লাহ, হক্ক ওয়ালাদের রহমত করেন। হে আল্লাহ, যারা রোগে আক্রান্ত তাদের শেফা দান করেন। হে আল্লাহ, বিশ্ব ইজতেমাকে কবুল করেন। হে আল্লাহ, আমাদের দোয়া কবুল করেন ইত্যাদি গভীর আকুতি-মিনতিপূর্ণ ভাষায় মোনাজাত করা হয়। আজ রোববার থেকে বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব শুরু। দ্বিতীয় পর্বের সমাপনী দোয়া অনুষ্ঠিত হবে ১৮ই ফেব্রুয়ারি সোমবার।
আবেগঘন আখেরি মোনাজাতে পরিচালনা করতে গিয়ে মাওলানা মো. যোবায়ের কান্নায় ভেঙে পড়েন। এসময় উপস্থিত লাখ লাখ মুসল্লির মধ্যে কান্নার রোল পড়ে যায়। কান্নার শব্দে পুরো ইজতেমা এলাকাসহ আশপাশের বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। মোনাজাত চলাকালে দক্ষিণে বিমানবন্দর, উত্তরে গাজীপুর বোর্ডবাজার পূর্বে পূবাইলের মাঝু খান এবং পশ্চিমে আশুলিয়া পর্যন্ত অন্তত প্রায় ১০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা বিশাল জনসমুদ্রে পরিণত হয়। মুঠোফোন, রেডিও এবং স্যাটেলাইট টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারের সুবাধে দেশ-বিদেশের লাখ লাখ মুসলিম মোনাজাতে অংশ নেন। স্বাগতিক বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের ৯৭টি দেশের প্রায় ১০ হাজার তাবলীগ অনুসারী বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাতে অংশ নিয়েছেন। এটি ছিল ৫৪তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব। আখেরি মোনাজাতকে ঘিরে গোটা বাংলাদেশর নজর ছিল টঙ্গীতে। রাজধানী ঢাকাও ছিল ফাঁকা।
মোনাজাতে শরিক হওয়ার জন্য দিনটি সরকারের ঐচ্ছিক ছুটি ছিল এ এলাকায়। ২৩ মিনিটের মোনাজাতে মাওলানা মো. যোবায়ের প্রথম ৫ মিনিট মূলত পবিত্র কোরআনে বর্ণিত দোয়ার আয়াতগুলো উচ্চারণ করেন। শেষ ১৮ মিনিটে বাংলা ভাষায় দোয়া পরিচালনা করেন। গতকাল বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের সমাপনী দিনে স্বাগতিক বাংলাদেশ ও বিদেশি তাবলিগ মুরুব্বিগণ গুরুত্বপূর্ণ হেদায়েতি বয়ান করেন।
সমাপনী বয়ান: মোনাজাতের আগে হেদায়েতি বয়ান করেন পাকিস্তানের মাওলানা ওবায়দুল্লাহ খোরশেদ। তার বয়ান বাংলায় ভাষান্তর করেন মাওলানা আবদুল মতিন। মাওলানা ওবায়দুল্লাহ খোরশেদ সমবেত মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে বলেন, আমাদেরকে সবসময় ইমান, আমল ও দ্বীনের দাওয়াতের কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, নবী-রাসুলগণ দুনিয়াতে এসেছেন, দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছেন। কিন্তু কারো কাছে কিছু চান নি। তেমনিভাবে আমরা দ্বীনের দাওয়াতের কাজ করতে বের হবো এবং দাওয়াতে মেহনতের কাজ করবো। সে মেহনতের পুরস্কার মানুষের কাছে চাইব না। দাওয়াতে মেহনতের পুরস্কার স্বয়ং আল্লাহ পাক দেবেন। তিনি আরও বলেন, আমরা যখন দাওয়াতের কাজে বের হবো তখন দোয়া করে বের হবো। প্রতিটি কাজ করার আগে দোয়া করতে হবে। তিনি বলেন, দাওয়াতের কাজে বের হলে মসজিদে ঢুকে মাসোহারা করতে হবে। তারপর হেকমতের সঙ্গে দাওয়াতের কাজ চালাতে হবে। তিনি আরও বলেন, মানুষ হেদায়েত পেতে হলে মেহনত করতে হবে। মেহনত অনেক ধরনের রয়েছে যেমন: ব্যবসার মেহনত, ক্ষেতখামারের মেহনত, মাল-সামানার মেহনত দ্বারা হেদায়েত পাওয়া যাবে না। তিনি বলেন, নবী করিম (সা.) ও সাহাবায়ে আজমাঈনগণ যে তরিকায় মেহনত করেছেন ওই তরিকায় যখন মেহনত হবে তখন আল্লাহ তা’য়ালা আমাদেরকে হেদায়েত দান করবেন। তিনি আরও বলেন, মেহনত হবে সুন্নতি তরিকায়। তিনি বলেন, আমাদের ইমানকে নতুন করতে হবে, তাজা করতে হবে। নবী করিম (স.) সাহাবায়ে কেরামের ইমান তাজা করার জন্য তাগিদ দিয়েছেন।
২০২০ সালে জোবায়েরপন্থিদের দুই পর্বে বিশ্ব ইজতেমার ঘোষণা: আগামী ২০২০ সালে টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে বিশ্ব ইজতেমা বাংলাদেশের শীর্ষ মুরুব্বি হাফেজ মাওলানা জোবায়ের আহমদপন্থিদের বিশ্ব ইজতেমার তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। আখেরি মোনাজাতের পরপরই বয়ান মঞ্চের মাইকে তা ঘোষণা করা হয়। আগামী ১০-১২ই জানুয়ারি প্রথম পর্ব মাঝে চার দিন বিরতি দিয়ে ১৭-১৯শে জানুয়ারি-২০২০ইং দুইপর্বে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হবে।
মুসল্লিদের বাঁধ ভাঙা জোয়ার: গতকাল শনিবার টঙ্গী হয়ে উঠে ছিল সব পথের মোহনা। আখেরি মোনাজাতে শরিক হতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিগণ টঙ্গী অভিমুখে ছুটতে আসেন শুক্রবার থেকে। বিশ্ব ইজতেমায় অংশগ্রহণকারীরা ছাড়াও কেবল আখেরি মোনাজাতে শরিক হতে দূর-দূরান্ত থেকে মুসল্লিগণ বাস, ট্রাক, মিনিবাস, মাইক্রোবাস, ট্রেন, লঞ্চ ও ট্রলারে করে টঙ্গীতে পৌঁছে অবস্থান নিতে শুরু করে। রাজধানীসহ আশপাশের এলাকার লোকজন ভিড় এড়াতে আগের দিন রাতেই টঙ্গীমুখী হয়। টঙ্গী ও রাজধানী ঢাকার সরকারি বেসরকারি অফিস, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সর্বত্রই ছিল পূর্ণ ছুটির আমেজ। শনিবার সকাল থেকে টঙ্গীমুখী সব রকম যান চলাচল বন্ধ করে দেয়ায় দীর্ঘ পথ হেঁটে টঙ্গী পৌঁছতে হয়েছে লাখ লাখ মানুষকে। কয়েক লাখ মানুষ রাতেই ইজতেমার মাঠ কিংবা আশপাশের বাসা-বাড়ি, ভবন, ভবনের ছাদে এমনকি গাছতলায় অবস্থান নেয়। শনিবার ভোররাত থেকে যানবাহন শূন্য সড়ক-মহাসড়ক ও নদী পথে টুপি পাঞ্জাবি পরা মানুষের বাঁধ ভাঙা জোয়ার শুরু হয়। চারদিকে যত দূর চোখ যায় মানুষ আর মানুষ । সকাল সাতটার মধ্যে গোটা এলাকা জনতার মহাসমুদ্রে পরিণত হয়। কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। এদিকে বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মুনাজাতে আগের তুলনায় মহিলাদের অংশগ্রহণ বেড়েছে।
পুরুষদের পাশাপাশি বিভিন্ন বয়সী মহিলাকে মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে টঙ্গী পৌঁছে মোনাজাতে অংশ গ্রহণ করতে দেখা গেছে। মোনাজাতে অংশগ্রহণের সুবিধার্থে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ইজতেমার চারপাশে প্রায় ৩ কি.মি. এলাকা পর্যন্ত মহাসড়ক ও শাখা সড়কগুলোতে মাইক টানিয়ে দেয়। আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে দেশের দূর-দূরান্ত ও প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে লাখ লাখ মানুষ এসে যোগ দেয়ায় ইজতেমা ময়দান ছাড়িয়ে টঙ্গী, উত্তরা ও তুরাগ থানার প্রতিটি রাস্তাঘাট, বাড়ির আঙিনা, ছাদ, খেলার মাঠ এমনকি গাছে চড়েও আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে দেখা গেছে।
ফিরতি যাত্রায় বিড়ম্বনা: আখেরি মোনাজাত শেষ হওয়ার পর এক সঙ্গে লাখ লাখ মানুষ ফিরতে শুরু করলে সর্বত্র মহাজটের সৃষ্টি হয়। টঙ্গী স্টেশনে ফিরতি যাত্রীদের জন্য অপেক্ষমাণ ট্রেনগুলোতে উঠতে মানুষের জীবনবাজির লড়াই ছিল উদ্বেগজনক। ট্রেনের ভেতরে জায়গা না পেয়ে ছাদে ও দরজা-জানালায় ঝুলে শত শত মানুষকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফিরতে দেখা যায়। একপর্যায়ে মানুষের জন্য ট্রেন দেখা যাচ্ছিল না। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, কালিগঞ্জ ও আশুলিয়া সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় ফিরতি মুসল্লিদের বিড়ম্বনা ও কষ্টের সীমা ছিল না। তিন-চার দিন ধরে টঙ্গীতে জমায়েত হওয়া মুসল্লিরা মোনাজাতের পর এক যোগে নিজ নিজ গন্তব্যে ফিরতে চাইলে অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হন। বিকালে সীমিত আকারে যানবাহন চলাচল শুরু হলেও পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হয়নি।
১ হাজার ৬০০ জামাত: ইজতেমা আয়োজক কমিটির শীর্ষ মুরুব্বি ইঞ্জিনিয়ার মেজবাহ উদ্দিন বলেন, তাবলিগের শীর্ষ মুরুব্বিদের দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী প্রথম পর্বের আখেরি মোনাজাত শেষে ১ হাজার ৬০০ জামাত দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছেন। এসব জামাতবন্দিদের মধ্যে ৪০ দিন, ৩ মাস, ৬ মাস, ১ বছর ও আজীবন চিল্লাধারী মুসল্লিরা রয়েছেন। তারা বহির্বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা শহর এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে দাওয়াতি কাজ করবেন।
মুসল্লিদের মধ্যে সরবত বিতরণ: ইজতেমা ময়দানে আসা-যাওয়ার পথে মুসল্লিদের পানি পিপাসা নিবারণের জন্য বিভিন্ন সংগঠন ও এলাকার ব্যবসায়ীরা পানি ও সরবতের আয়োজন করে থাকেন। গতকাল সকাল থেকে মোনাজাতে অংশগ্রহণ করতে আসা মুসল্লিদের চেরাগআলী এলাকার সফিইদ্দীন মার্কেটের ব্যবসায়ীরা প্রতি বছরের ন্যায় এবারও মার্কেটের সামনে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত লেবু চিনি মিশ্রিত সরবত ইজতেমার মোনাজাতে অংশ নেয়া মুসল্লিদের পান করানো হয়।
ইজতেমার প্রথম পর্বে ৫ মুসল্লির মৃত্যু: টঙ্গী বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে শুক্রবার দিনগত রাতে সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি থানার ক্ষিদ্র মাটিয়া গ্রামের মৃত হাতেম আলীর ছেলে আব্দুর রহমান (৫৫) মারা গেছেন। তিনি খিত্তা নং-২৩, খুঁটি নং-৩৩০৫-এ অবস্থান করছিলেন। এর আগে কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর থানার ঝাউদিয়া গ্রামের মৃত-আফছার আলীর ছেলে সিরাজুল ইসলাম নারু (৬৫), ফেনী জেলা সদরের একাডেমি গ্রামের নজীর আহমেদের ছেলে মো. শফিকুর রহমান (৬৮), ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার জব্বার আলী (৪৪) ও নাটোর জেলাল মোহাম্মদ আলী (৫৬) নামে আরও ৪ মুসল্লির মৃত্যু হয়। এ নিয়ে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বে মোট ৫ জন মুসল্লির মৃত্যু হলো।
আয়োজক কমিটির সন্তোষ প্রকাশ: দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মুসল্লিদের আসতে এবং ময়দানের সার্বিক নিরাপত্তা বিধানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ভূমিকায় প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও সরকারের প্রতি ইজতেমা আয়োজক কমিটি সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। এছাড়া ময়দান ও এর আশপাশে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটায় তারা সন্তুষ্ট।
ভিআইপিদের মোনাজাতে অংশগ্রহণ: মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, ধর্মপ্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শেখ মো. আব্দুল্লাহ, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আলহাজ মো. জাহিদ আহসান রাসেল, গাজীপুর সিটি মেয়র অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলম, গাজীপুরের জেলা প্রশাসক ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ুন কবীর, গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার ওয়াইএম বেলালুর রহমান, মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খান আখেরি মোনাজাতে অংশগ্রহণ করেন।