× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার , ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের কব্জা থেকে একাধিক বিলাসবহুল গাড়ি উদ্ধার /সরকারি কর্মচারীদের পাজেরো বিলাস

প্রথম পাতা

মারুফ কিবরিয়া
২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, বুধবার

সরকার থেকে দেয়া প্রাডো, পাজেরো গাড়িগুলো সাধারণত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ব্যবহারের জন্য পেয়ে থাকেন। তাদের অফিস থেকে বাসায় আনা নেয়া এমনকি দাপ্তরিক কাজেই গাড়ি দেয়া হয়। কিন্তু এসব গাড়ি এখন অবৈধভাবে ব্যবহার করছেন বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা। নিয়ম অনুযায়ী এ ধরনের গাড়ি ব্যবহার করতে পারেন না তারা। এদের মধ্যে কেউ কেউ চাকরি থেকে অবসরও নিয়েছেন। সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অভিযানে এমন কর্মচারীদের অবৈধভাবে হাঁকানো গাড়ির তথ্য ফাঁস হয়ে যায়। সংস্থাটির সূত্র জানাচ্ছে, সরকারি গাড়ি অবৈধভাবে ব্যবহার করছেন এমন কর্মচারীর সংখ্যা অনেক। দুদক এই দখলমুক্ত করার অভিযানে নামলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ একেবারেই উদাসীন।


সম্প্রতি, দুদকের অভিযানে তিনটি সরকারি পাজেরো ও প্রাডো ব্র্যান্ডের গাড়ি উদ্ধার হয়েছে। যেগুলো বছরের পর বছর বিভিন্ন দপ্তরের কর্মচারীরা ক্ষমতার জোরে ব্যবহার করতেন। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে এত ক্ষমতা তারা কোথায় পেয়েছেন। কিসের বলে সচিব পর্যায়ের কর্তাদের জন্য দেয়া গাড়ি নিজেরা দখল করে চালাতেন। সূত্র জানিয়েছে, এদের একেকজন বিভিন্ন দপ্তরের সিবিএ (কালেকটিভ বার্গেনিং এজেন্ট) নেতা হওয়ায় কাউকে তোয়াক্কা না করেই সরকারি গাড়ি নিজের করে নিয়েছেন। শুধু তাই নয়, চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পরও তারা গাড়িগুলো নিজের দখলে রেখেছেন। দুদক সূত্রে জানা গেছে, তিন-চারটি নয়, সরকারি গাড়ি অবৈধভাবে ব্যবহার করছেন এমন কর্মচারীর তালিকা দুদকের হাতে রয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে শিগগিরই অভিযানে নামা হবে। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কাছে সেসব গাড়ি হস্তান্তর করবে দুদক।   

গত ১১ই ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তৃতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা আলাউদ্দিন মিয়ার কাছ থেকে অবৈধভাবে দখলে থাকা পাজেরো গাড়ি মতিঝিল এলাকা থেকে জব্দ করে দুদক। দশ বছর ধরে গাড়িটি ব্যবহার করছিলেন তিনি। চাকরিতে কর্মরত থাকা অবস্থায় তিনি সিবিএ’র সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। আর সেই ক্ষমতা ব্যবহার করেই আলাউদ্দিন মিয়া তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হওয়া সত্ত্বেও যুগ্ম সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তার গাড়িটি দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করতেন। সূত্র জানায়, এসব বিষয় পিডিবির চেয়ারম্যানের অবগত থাকার পরও তিনি নীরব ভূমিকা পালন করেছেন। দুদকের অভিযানকালে জানা গেছে, দীর্ঘ সময়ে গাড়িটি ব্যবহার  বাবদ সরকার থেকে প্রতিমাসে ডিজেল বরাদ্দ হয় ৪৫০ লিটার, যার আর্থিক মূল্য ২৯ হাজার ২৫০ টাকা। এ হারে প্রতি বছরে জ্বালানি বাবদ ৩ লাখ ৫১ হাজার টাকা খরচ হয়। এভাবে সিবিএ নেতা আলাউদ্দিন ২০০৯ সাল থেকে গত ১০ বছরে গাড়িটির জন্য পিডিবি থেকে ডিজেল খরচ তুলেছেন ৩৫ লাখ ১০ হাজার টাকা।

প্রতি মাসের ড্রাইভারের বেতন বাবদ ৪১ হাজার টাকা খরচ হয়। এ পর্যন্ত এ গাড়ির ড্রাইভারকে ৩৭ লক্ষাধিক টাকা বেতন-ভাতা দেয়া হয়েছে। এছাড়া প্রতিমাসে গাড়িটির পেছনে ১০ লিটার মবিল এবং মেরামত ব্যয় হয়েছে। ক্ষমতার দাপটে দীর্ঘদিন সরকারি গাড়ি ব্যবহারের পর অপরাধযোগ্য কাজ করলেও দুদকের অভিযানে নিজের সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে দাবি করেছেন আলাউদ্দিন মিয়া। তিনি পরদিন এক বিবৃতিতে জানান, পিডিবির কর্মচারী হিসেবে গাড়ি ব্যবহার করেননি। আলাউদ্দিন মিয়া সিবিএ নেতা হিসেবে পিডিবির দাপ্তরিক কাজে গাড়িটি ব্যবহার করেছেন। তিনি দাবি করেন, এই গাড়ির ব্যাপারে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড বা দুদকের পক্ষ থেকে কখনোই মৌখিক বা কোনো পত্র না দিয়ে আমি গাড়িতে না থাকা সত্ত্বেও আমার কাছ থেকে গাড়ি জব্দ করার সংবাদ বিভিন্ন মিডিয়ায় ফলাও করে যেভাবে প্রচার করা হয়েছে, তাতে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার মর্যাদা ক্ষুণ্ন করা হয়েছে এবং আমার প্রতি অবিচার করা হয়েছে।

আলাউদ্দিন মিয়ার কাছ থেকে গাড়ি উদ্ধার অভিযানের পরদিনই ১২ই ফেব্রুয়ারি পিডিবির কর্মকর্তারা স্বেচ্ছায় সিবিএ’র সভাপতি জহিরুল ইসলাম চৌধুরীর দখলে থাকা গাড়িটিও দুদকের হেফাজতে দিয়ে যান। জহিরুল ইসলাম পিডিবির অডিট পরিদপ্তরের হিসাবরক্ষণ পদে কর্মরত ছিলেন। তিনিও সিবিএ নেতা হওয়ায় ক্ষমতার জোরে ১০ বছর ধরে গাড়িটি ব্যবহার করেছেন। দুদক জানায়, জহিরুল ইসলাম চৌধুরীর কাছে থাকা গাড়িটি বাবদ দৈনিক ১৫ লিটার জ্বালানি তেল হিসেবে মাসিক ২৯ হাজার ২৫০ টাকা গাড়িটির পেছনে খরচ হয়েছিল। অর্থাৎ গত ১০ বছরে জ্বালানি বাবদ গাড়িটিতে খরচ হয়েছে ৩৫ লাখ ১০ হাজার টাকা। এছাড়া গাড়িচালকের বেতন ও ওভারটাইম বাবদ প্রায় ৪০ লাখ টাকা এবং মেরামত ও আনুষঙ্গিক খরচ মিলিয়ে গত ১০ বছরে সর্বমোট প্রায় এক কোটি টাকা গাড়িটির জন্য ব্যয় করা হয়েছে। জানা গেছে গেল সপ্তাহে দুই সিবিএ নেতার কাছ থেকে সরকারি গাড়ি দখলমুক্ত করার পর এবার তাদের সম্পদের অনুসন্ধানেও নামছে দুদক। এ বিষয়ে এরই মধ্যে  কমিশনের পক্ষ থেকে অনুমোদনও দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে সূত্র।

এদিকে গতকাল প্রাণিসমপদ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ডা. মাহবুবুল হক একটি প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়া সত্ত্বেও গত ৮ মাস যাবৎ প্রকল্প পরিচালকের জন্য বরাদ্দ সরকারি গাড়ি ব্যবহার করার অভিযোগে সেটি জব্দ করে দুদক। সংস্থাটির কাছে আসা এক অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে সেটি উদ্ধার করা হয়েছে। দুদক জানায়, ২০১৮ সালের জুন মাসে ‘হাঁস প্রজনন প্রকল্প’ নামের প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও পরিচালক ডা. মাহবুবুল হক গত ৮ মাস যাবৎ অবৈধভাবে গাড়িটি ব্যবহার করে আসছিলেন। গাড়িচালকের বেতন ও ওভারটাইম বাবদ মাসে প্রায় ৫০ হাজার টাকা ব্যয় করা হয়েছে।

দুদকের এই চলমান অভিযানে অবশ্য কিছু ক্ষেত্রে অবৈধভাবে গাড়ি ব্যবহার বন্ধও হচ্ছে। সম্প্রতি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অগ্রণী ব্যাংকের সিবিএ’র দুই নেতা দীর্ঘদিন গাড়ি ব্যবহার করে আসলেও দুদকের ভয়ে ফেরত দিয়েছেন সেটি। জানা গেছে, পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে দুটি গাড়ি ব্যবহার করছেন ব্যাংকটির সিবিএ সভাপতি খোন্দকার নজরুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদিন। যদিও ব্যাংকের নিয়মে তারা নিয়মিত গাড়ি ব্যবহার করতে পারেন না। আবার ব্যাংকের নথিপত্রে তাদের নামে কোনো গাড়ি বরাদ্দও নেই। এসব জানার পরও সিবিএ নেতাদের গাড়ি ব্যবহার বন্ধে ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কেউই উদ্যোগ নেননি। অগ্রণী ব্যাংকের পরিবহন অফিস সূত্রে জানা যায়, অগ্রণী ব্যাংকের সিবিএ সভাপতি ব্যবহার করেন পাজেরো স্পোর্টস কার, যার নম্বর ঢাকা মেট্রো-ঘ ১৩-৭২৫৩। আর সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদিন ব্যবহার করেন পাজেরো জিপ, যার নম্বর ঢাকা মেট্রো-ঘ ১৩-৭২৫২। এসব গাড়ি তারা সার্বক্ষণিক ব্যবহার করেন, যার সব খরচ বহন করে ব্যাংক।

অন্যদিকে গাড়ি মেরামতের নামেও তারা ব্যাংক থেকে বের করেন মোটা অঙ্কের টাকা। চলতি বছরে একটি গাড়ি মেরামতে ব্যাংকের খরচ হয় ৮ লাখ টাকা, যা ব্যাংকের যেকোনো গাড়ির মেরামত খরচের চেয়ে বেশি।  অভিযানের ভয়ে গাড়ি ফেরত দিলেও এখনো অনেক সরকারি দপ্তরের সিবিএ নেতারা দাপটের সঙ্গে সরকারি গাড়ি অবৈধভাবে ব্যবহার করছেন বলে তথ্য রয়েছে দুদকের কাছে। তবে এ বিষয়ে এখনো সংশ্লিষ্ট দপ্তরের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা অনেকটা নীরব ভূমিকাই পালন করছেন। তবে কেউ কেউ বলছেন তাদের উদাসীনতার নেপথ্যে রয়েছে ‘ভয়’। একাধিক দপ্তরের কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিবিএ’র এসব নেতা ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় থাকেন বলে উল্টো তাদেরই তাঁবেদারি করতে হয় দপ্তরের উচ্চ পর্যায়ের কর্তাদের। তৃতীয় চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হলেও তারা যেকোনো দপ্তরে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করেন। মূলত এসব কারণেই উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা অনেক অনিয়মের কথা জানলেও তা নিয়ে কথা বলতে সাহস করেন না।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর