× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার , ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১১ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

হঠাৎ বিস্ফোরণ সব শেষ

এক্সক্লুসিভ

স্টাফ রিপোর্টার
২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, শুক্রবার

বুধবার রাত সাড়ে ১০টা। রাজধানীর চকবাজার থানার চুড়িহাট্টা শাহী মসজিদ মোড়। পাঁচটি সরু রাস্তার মিলনস্থল এই মোড়। পূর্বদিকে চকবাজার থানা সড়ক, দক্ষিণে হাজী বাল্লু সড়ক, পশ্চিমে চাঁদনীঘাট ও উত্তরে উর্দু রোড। প্রতিটা সড়ক থেকে আসা যানবাহন ও মানুষের চাপে চুড়িহাট্টা মসজিদ মোড়ে পা ফেলার জায়গা ছিল না। মোড়ের আশপাশে খাবার হোটেল, কেমিক্যালের দোকান, মুদির দোকান, মোবাইল-কম্পিউটার ও ফার্মেসির দোকানের ব্যবসায়ীরা তখন ক্রেতা সামাল দিতে ব্যস্ত। আবার অনেকে সারা দিনের ব্যবসার হিসাব-নিকাশ কষছিলেন। ঠিক তথনই হঠাৎ করে এক বিকট শব্দ হয়।
গাড়ির চাকা বা অন্য কিছুর শব্দ ভেবে দোকানের ভেতরে থাকা অনেকেই প্রথমে গুরুত্ব দেননি। কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে পর পর বিকট আরো কয়েকটি শব্দে ঘুম ভাঙে অনেকের। মুহূর্তের মধ্যে আশপাশের ভবনের দোকানে ছড়িয়ে পড়ে আগুনের লেলিহান শিখা। নিমিষেই  অগ্নিশিখা গ্রাস করে ফেলে সবকিছু। আগুনের কেন্দ্রের কাছে থাকা লোকজন আর পালিয়ে বাঁচারও সময় পাননি।

মুহূর্তে আগুন ঘিরে ফেলে চারপাশ থেকে। কেউ কেউ আগুন থেকে রক্ষা পেতে দোকানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাদের অনেকে আর বের হতে পারেননি। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী খোরশেদ আলম বলেন, রাতে কাজ থেকে বাসার দিকে যাচ্ছিলাম। সড়কে প্রচণ্ড যানজট থাকায় ফুটপাথের ওপর দিয়ে চাপাচাপি করে হাঁটছিলাম। চুড়িহাট্টা মসজিদ পার হয়ে একটু সামনে যাওয়ার পর হঠাৎ বিকট শব্দ শুনতে পাই। পেছনে তাকিয়ে দেখি একটি পিকআপ ভ্যানে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। আর সেখানে থাকা মানুষেরা চিৎকার করে দৌড়াদৌড়ি করছেন। কয়েক সেকেন্ডের ভেতরে একের পর এক বিকট শব্দ আর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে আগুন। খোরশেদ বলেন, আমি নিজেকে অক্ষত রাখতে পারলেও আমার চোখের সামনে অনেককে মরতে দেখেছি। সবাই বাঁচার জন্য চিৎকার করছিল। কিন্তু তারা পালিয়ে যাওয়ার রাস্তা খুঁজে পায়নি। আমার চোখের সামনে আনুমানিক ৭/৮ বছরের একটি বাচ্চা আগুন থেকে বাঁচার জন্য রাজমহল হোটেলের সামনে থেকে মসজিদের দিকে দৌড় দিয়েছিল। বাঁচতে পারেনি। আগুনের উত্তাপে কয়েক সেকেন্ডের ভেতরে কয়লা হয়ে যায় ওই শিশুটি। আজগর আলী লেনের বাসিন্দা আব্দুল আলীম বলেন, হোটেল থেকে রুটি কিনে বাসায় ফিরছিলাম। যানজটের চাপে সড়কে হাঁটার উপায় ছিল না।

কষ্ট করে বাসার গেট পর্যন্ত পৌঁছালে বিকট শব্দ শুনতে পাই। আমার স্ত্রী তখন বলছিল কিসের শব্দ হলো। আমি বিষয়টিকে এতটা গুরুত্ব দেইনি। কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের ভেতরে দেখি শুধু আগুন আর আগুন। আর সঙ্গে শত শত বিকট শব্দ। আগুনের লাল শিখা খুব দ্রুত আঘাত আনে সব কটি ভবনে। তিনি বলেন, আশপাশের সবকটি দোকানে কেমিক্যাল রয়েছে। এজন্য আগুনের উত্তাপ বেশি ছিল। এছাড়া পারফিউমের কারখানা থাকায় আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আব্দুর রহিম নামের আরেক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ওই সময়টাতে অনেকে কাজ শেষ করে বাসায় ফিরছিলেন। আবার কেউ কেউ খাবার কিনতে হোটেলে এসেছিলেন। পাশের কয়েকটি সড়ক বন্ধ করে দেয়াতে এই সড়কে চাপ ছিল। এরকম একটি অবস্থায় এমন ঘটনা ঘটায় কেউ আর পালিয়ে বাঁচতে পারেনি। সালাউদ্দিন নামের আরেক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ঘটনাস্থল থেকে একটু দূরে ছিলাম। একটি বিকট শব্দ শুনে স্বাভাবিক কিছু ধরে নিই। তারপর যখন একের পর এক বিকট শব্দ হচ্ছিলো তখন তাকিয়ে দেখি আগুন আর আগুন। প্রথমে একটি পিকআপ ভ্যান থেকে আগুন লাগে। তারপর ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের দোকান ও সড়কে থাকা গাড়িতে। একটি গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে মানুষসহ অনেক উচুতে উঠেছিল।

সালাউদ্দিন বলেন, যানজট থাকার কারণে কেউ নড়তে পারেনি। যে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানেই পুড়ে মারা যায়।  প্রত্যক্ষদর্শী আব্দুল মতিন বলেন, হাজী ওয়াহেদ মঞ্জিলের ভবনের সামনে একটি ভ্যানে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে আগুন লেগে যায়। তারপর এক এক করে বিস্ফোরিত হয় সড়কে থাকা যানবাহনের সিলিন্ডার, বিদ্যুতের লাইন। তারপর নিমিষেই ছড়িয়ে যায় আশপাশের ভবন, রিকশা, গাড়ি, মোটরসাইকেল ও পথচারীদের শরীরে। পুড়ে ছাই হয়ে যায় সবকিছু। মতিন বলেন, কেমিক্যালের দোকান থাকায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সময় লাগে। আর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাত ১২টা এক মিনিট থেকে শ্রদ্ধা নিবেদনের কর্মসূচি থাকায় কয়েকটি সড়ক বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল।

সড়কে যদি যানজট না থাকত তবে অনেক মানুষ বেঁচে যেত। চুড়িহাট্টা মসজিদের ক্যাশিয়ার মাজারুল ইসলাম বলেন, ঘটনাস্থলের পাশেই মসজিদের ভবনের দ্বিতীয় তলায় আমার অবস্থান ছিল। সেখানে বসে কিছু কাজের তদারকি করছিলাম। ঠিক তখনই বিকট আওয়াজ হয়। তারপর আর নিচে নামার সুযোগ হয়নি। ভবনের ভেতরে আমরা ৭০ জন অবস্থান করছিলাম। আমরা প্রত্যেকেই ভবনের ছয় তলায় উঠে যাই। পরে একটি পাইপ ধরে ধরে আমরা সবাই নিচে নামি। নিচে নেমে দেখি দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। আর পুড়ে যাচ্ছে একের পর এক মানুষ।

মো. বশির উদ্দিন নামের আরেক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার পর মসজিদের পাশের একটা ডেন্টাল ফার্মেসিতে আশ্রয় নেন চারজন। তারা হয়তো ভেবেছিল আগুন ফার্মেসির ভেতরে যাবে না। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আগুনের উত্তাপ ছেড়ে যায়নি তাদের। ফার্মেসির ভেতরে থাকা ওই চারজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। তিনি বলেন, পালাতে না পেরে  বাঁচার জন্য তারা দোকানের সাটার আটকিয়ে দেয়। তবুও তাদের আর বাঁচা হলো না। স্থানীয় হাশেম বলেন, দুই পাশে দুই হোটেল। হোটেলগুলোতে গ্যাস সিলিন্ডার ছিল। বিকট শব্দে গাড়ির সিলিন্ডার বিস্ফোরণের পর বুলেট গতিতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে হোটেলের সিলিন্ডারে, গ্যাস চালিত যানবাহনে। তাই খুব অল্প সময়ের ভেতরে সবকিছু পড়ে ছাই হয়ে গেছে। তিনি বলেন, পরিচিত অনেক ব্যবসায়ী, প্রতিবেশীরা আগুনে পুড়ে মারা গেছে।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর