× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার , ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

এভাবেই চলে চরের মানুষের জীবন

বাংলারজমিন

প্রতীক ওমর, বগুড়া থেকে
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, শনিবার

নব্বই বছর বয়স বৃদ্ধ বাবু শাহের। জীবন ও জীবিকার তাগিদেই বসত বাঁধেন নদী পাড়ে। কখনো ঘরবাড়ি নদীর গর্ভে চলে যায় আবার কখনো আবাদি জমি খেয়ে ফেল ক্ষুধার্ত নদী। প্রকৃতির সঙ্গেই যুদ্ধ করে জীবনের শেষ কিনারায় উপনীত হয়েছেন। শরীর ভালো না। মাঝে মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। দুই দিন আগে গুরুত্ব অসুস্থ হয়ে পড়লে তার সন্তানরা কাঠের চৌকিতে করে ঘারে নিয়ে হাসপাতালে যান। শুধু বাবু শাহের এরকম দশা হয়েছে তেমনটি নয়।
চরের প্রত্যেক মানুষের বাস্তবচিত্র এটি। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে ৫-১০ কিলোমিটার বালির পথ এভাবেই কাঁধে করে রোগীকে নিতে হয় হাসপাতাল।

বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলার যমুনা নদীর চর এলাকার সাতটি ইউনিয়নের কয়েক লাখ মানুষের জরুরি চিকিৎসা সেবায় এ রকম দুর্ভোগ কষ্ট পোহাতে হয় প্রতিদিন। বিশেষ করে শিমুলতাইড়, কাকালিহাতা, হাটবাড়ী, নয়াপাড়া, চকরতিনাথ, টেকামাগুড়া, চরদলিকা, বেনীপুর, কাজলা, ময়ুরেরচর, নান্দীনারচর, ধরাবর্ষারচর, মাজিরাচরসহ প্রায় ৮০টি চরের মানুষ  জরুরী চিকিৎসা সেবা না পেয়ে অবর্ননীয় কষ্টে আছেন। চর গুলোতে মা ও শিশু মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে হরহামেশায়।

বগুড়ার সারিয়াকান্দি সদর ইউনিয়নের বাটিরচর গ্রামের বৃদ্ধ বাবুশাহ (৯০)। বৃদ্ধ বাবুর ৫ ছেলে, ২ মেয়ে। নদী ভাঙনের কারণে বসত বাড়ি হারিয়ে বর্তমানে চরের জমি চাষাবাদ করে সংসার চলে তার। শরীরে বিভিন্ন রোগ বাসা বাঁধলেও পেটের প্রচণ্ড ব্যথায় ছটফট করেন মাঝে মধ্যেই। গত শুক্রবার ভোরের দিকে অসহ্য পেট ব্যথা শুরু হলে ছোট আকারের চৌকিতে শুয়ে সাই করে নিয়ে আসার সময় বড় ছেলে শাহ আলম বলেন, বাবার পেটের ব্যথা যখন শুরু হয়, তখন চিৎকার করে হা-হুতাশ করতে থাকেন। যখন রাতের বেলা ব্যথা শুরু হয় তখন চরে করার কিছুই থাকে না আমাদের। বাড়ি থেকে সারিয়াকান্দি হাসপাতালে আসতে প্রায় ৪ কি.মি পথ পাড়ি দিতে হয়। এর মধ্যে প্রায় ৩ কি.মি. বালুময় পথ পাড়ি দিয়ে খেয়া পারের জন্য ঘাটে পৌঁছুতে হয়। ঘণ্টাখানেক অপেক্ষার পর খেয়া পার হয়ে আবার আধা ঘণ্টা সাই করে রুগীকে চিকিৎসকের কাছে নিতে হয়। সব মিলিয়ে আধা ঘণ্টার পথ, দীর্ঘ ২ আড়াই ঘণ্টাতেও যেন চরের পথ শেষ হতে চায় না। এ রকম সমস্যা শুধু আমাদের একার নয়।

যমুনা ব্রিজের পশ্চিম পাশ থেকে শুরু করে উত্তর প্রান্ত কুড়িগ্রাম পর্যন্ত যমুনার অববাহিকায় দেড় হাজারের বেশি চর জেগেছে। এসব চরের মধ্যে প্রায় সাড়ে তিন শতাধিক চরে মানুষ বসবাস করে। শিক্ষার আলো, স্বাস্থ্যসেবা, সড়ক সেবাসহ প্রায় সব ধরনের নাগরিক সেবা বঞ্চিত বরাবরই এই মানুষগুলো। বালির মাঝেই চাষাবাদ এবং গরু ছাগল পালন এদের প্রধান পেশা। এখন অবশ্য অনেক চরে মরিচ, আলু, বাদাম, গোম, ভুট্টাসহ প্রায় সব রকমের ফসলের চাষ হয়। তার পরেও এই চারের কৃষিকরা বঞ্চিত কৃষি সেবা থেকেও। কিছু না পেলেও এই মানুষগুলোর না পাওয়ার কোনো অভিযোগ নেই। সারিয়াকান্দি উপজেলার চন্দনবাইশা চরের জমির উদ্দিন বলেন, আমরা চরের মানুষ নিজেদের মতো করে ভালো আছি। আমরা ভালো থাকতে চাই। কারো কাছেই আমাদের চাওয়ার কিছু নেই। জনবসতি এসব চর এলাকার মধ্যে উল্লেখযোগ্য চর হচ্ছে, গাইবান্ধার ফুলছড়ি, টেংরাকান্দি, গাবগাছি, পারুল, খাটিয়ামারি, গলনা, খোলবাড়ী, সাঘাটা উপজেলার দিগলকান্দি, পাতিলবাড়ী, গুয়াবাড়ী, গাড়ামারা, হরিচন্দ্র, এজেন্ডাবাড়ী, বগুড়ার ধুনটের, বৈশাখী, ভাণ্ডাবাড়ী, মাঝিরারচর সারিয়াকান্দি উপজেলার ধারা বর্ষা, শংকরপুর, চন্দনবাইশা, চরলক্ষিকোলা, ডাকাতমারিরচর, ইন্দুরমারিরচর, চরকর্নিবাড়ি, তালতলা, বেনুপুর, পাকুরিয়া, চরমানিকদাইর, চরদলিকা, শিমুলতাইড়, চরকালুয়াবাড়ী, চরবিরামে পাঁচগাছি, নয়াপাড়া, জামথল, চরবাকিয়া, ময়ূরেরচর, চরদেলুয়াবাড়ী, কুড়িপাড়ারচর, চরশালিকা, করমজাপাড়া, টেকামাগুড়ারচর। এসব চর ছাড়াও যমুনা পাড়ের আরো অসংখ্য চর আছে। এসব চরের  মানুষরা আধুনিক বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরে এখনো অবস্থান করছে। অনেক এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। বিদ্যুত তাদের কল্পনার বিষয়। সমসাময়িক প্রেক্ষাপট, দ্বীন-দুনিয়ার অনেক তথ্য থেকে তারা এখনো অনেক ব্যবধানে আছে।

 বেশির ভাগ চরে বালির মাটি হওয়ার কারণে রাস্তা বাধার কোন পরিস্থিতি নেই। তবে যেসব চর দীর্ঘদিন আগে জেগেছে সে সব চরে এখন দোঁ-আশ, এঁটেল মাটির স্তর তৈরি হয়েছে। এসব এটেল, দোঁ-আশ মাটির চরগুলোতেও রাস্তা ঘাট চোখে পড়ে না। দশ-বিশ কিলোমিটার রাস্তা পায়ে হেঁটেই তাদের বাজারে কেনাবেচা করতে হয়। বিশেষ করে এসব চরাঞ্চলের কৃষিপণ্য বিক্রির সময় চাষিদের বিপাকে পড়তে হয়। ঘাড়ে-পিঠে বহন করেই বাজার পর্যন্ত আনতে হয় তাদের। তবে বর্ষা মৌসুমে প্রতিটি বাড়ির কিনারায় পানি ওঠায় নৌকায় এসব পণ্য বহন করতে সুবিধা হয়। এই সুবিধা বেশি দিন স্থায়ী হয় না। মাস দুয়েক পরে আবারো আগের হালে চলে চরের মানুষ।

আমাদের দেশের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মানুষ নদী অববাহিকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করে এ তথ্য সবার জানা। তাদের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা এবং চরের উন্নয়নের জন্য সরকারকে আরো বেশি নজর দিতে হবে। তাদের নিয়ে কাজ করতে হবে। চরবাসিদের কাজে লাগাতে হবে। চরের মানুষ অনেক পরিশ্রমী, তাদের শ্রমকে সম্পদে পরিণত করা শুধু উদ্যোগের ব্যাপার। যদিও বেসরকারি কিছু এনজিও চরের মানুষদের ভাগ্য পরিবর্তনের কথা বলে দু-একটি প্রল্পের কার্যক্রম চালিয়েছে। তবে এসব প্রল্পের বেশির ভাগই লোক দেখানো মাত্র।  নদীপাড়ের মানুষদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন না হলেও ভাগ্যের পরির্বতন হয়েছে এনজিওগুলোর।

চরের মানুষের স্বাস্থবেসা নিশ্চিৎ করার জন্য স্থায়ী চিকিৎসালয় স্থাপন করা সময়ের দাবি। বিশেষ করে একজন সন্তানসম্ভাবা নারীদের  যখন প্রসব ব্যথা ওঠে কখন তাদের তাৎক্ষণিক চিকিৎসা দেয়ার কিছুই থাকে না এই সব এলাকায়। এছাড়াও শিশু বৃদ্ধদের বেলাতেও একই অবস্থার সম্মুখীন হতে হয় তাদের। মধ্যযুগীয় পদ্ধতি কাঠের চকিতে রোগীকে শুয়ে তাতে বাঁশ লাগিয়ে ঘাড়ে করে বহন করে অনেক পথ পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে আনতে হয়। এছাড়া শিক্ষা উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় চরের শত শত শিশু প্রথমিক শিক্ষা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। হাতে গোণা কিছু চরে প্রাথমিক শিক্ষার স্বল্প পরিসরে থাকলেও বেশির ভাগ চরেই নেই। মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই বললেই চলে। পর্যাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না থাকায় চরের শিশু কিশোররা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয়ে শ্রমের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। মেয়েদের কিশোরীকালেই বিবাহ দিয়ে দিচ্ছেন পরিবারের পক্ষ থেকে। এই আধুনিক বাংলাদেশে এই অঞ্চলগুলোয় এখনো বাল্যবিবাহ প্রতিনিয়তই হচ্ছে। তাদের সেই ভাবে সচেতনা সৃষ্টির জন্য কেউ এগিয়ে আসছে না।
বাংলাদেশ সামনের দিকে এগুলোও দিন দিন পেছনের পথে হাঁটছে চরের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মানুষ। তাদের ভাগ্যের পরিবর্তনে কেউ না আসলেও নিজেরাই সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ না থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে কিছু চরে সৌর বিদ্যুতের ব্যবহার হচ্ছে স্বপ্ল পরিসরে। বিস্তর পরিসরের ডিশ না থাকলেও স্থানীয়ভাবে ছোট ছোট ডিশ এন্টেনার সংযোগে চলছে টেলিভিশন। তাদের প্রচেষ্টার পাশাপাশি সরকার ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান পাশে দাঁড়ালে চরবাসীর জীবন যাত্রার মান কিছুটা হলেও বড়বে বলে মনে করছেন তারা। এদিকে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো ছাড়া এই মানুষগুলোর কোনো কাজে পাশে আসে না। প্রতি পাঁচ বছর পরপর তাদের সাময়িক পদচারণা দেখা গেলেও ভোট শেষে চরের বালুতে আর কখনো পা রাখেন না তারা।  

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. এসএম মামুনুর রশিদ বলেছেন, এ উপজেলায় দায়িত্ব নেয়ার পরপরই চর অঞ্চলের জনৈক মা ও শিশু মৃত্যু ঘটনা আমাকে দারুণভাবে নাড়া দিয়েছে। সেজন্য বগুড়া জেলা প্রশাসক ফয়েজ উদ্দিনকে চরের মানুষের জরুরি চিকিৎসা সেবার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের প্রয়োজনের কথা জানিয়েছি। তবে তিনি বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নিয়েছেন এবং চরের ইউপি চেয়ারম্যানদের তত্ত্বাবধানে নৌ-অ্যাম্বুলেন্স চালুর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আশ্বাস দিয়েছেন।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর