× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার , ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

রাসায়নিকের গোডাউন ওয়াহেদ ম্যানশন

প্রথম পাতা

রুদ্র মিজান ও শাহনেওয়াজ বাবলু
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, শনিবার

পুরান ঢাকার ঘরে ঘরে গোডাউন। সাধারণ পণ্যের পাশাপাশি এসব গোডাউনে রয়েছে বিপুল কেমিক্যাল। ট্রাকে-পিকআপে করে রাতে-দিনে কেমিক্যাল আনা-নেয়া হয় সেখানে। আছে নানা ধরনের কারখানাও। যেখানে তৈরি করা হয় কেমিক্যাল জাতীয় বিভিন্ন পণ্য। তেমনি একটি মার্কেট হচ্ছে আবদুল ওয়াহেদ ম্যানশন। চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর এই মার্কেট থেকেই সবচেয়ে বেশি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। চার তলা ভবনের বিশাল বেজমেন্ট জুড়ে নানা ধরনের কেমিক্যাল।
গোডাউনের কেমিক্যাল বিস্ফোরিত হলে অবস্থা হতো আরো ভয়াবহ। বিশেজ্ঞরা বলছেন পুরো ভবনটিই হয়তো উড়ে যেতো।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সহকারী পরিচালক ও চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তদন্ত কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন মানবজমিনকে বলেন, আবদুল ওয়াহেদ ম্যানশনের বেজমেন্টে বিপুল কেমিক্যাল। এখানে টিন, ড্রাম, কন্টিনার ভরা কেমিক্যাল পাওয়া গেছে। আগুন লাগার পর আমরা বিষয়টি জানতে পারি। তাই ফায়ার সার্ভিসের একটি টিম সক্রিয় ছিল যাতে বেজমেন্টে আগুন ছড়াতে না পারে। এখানে আগুন ছড়ালে ভয়াবহতা আরো বেশি হতো। এগুলো বিস্ফোরিত হলে বিল্ডিং হয়তো ধসে পড়তো। পার্কিংয়ের স্থানে কেমিক্যালের গোডাউনটি বেআইনি বলে দাবি করেন তিনি।

আবদুল ওয়াহেদ ম্যানশনের বেজমেন্টের ভেতরে গাঢ় অন্ধকার। গতকাল সেখানে ঢুকে আলো জ্বেলে দেখা গেছে, সরু রাস্তা ছাড়া পুরো বেজমেন্টজুড়ে নানা ধরনের ড্রাম, বস্তা রাখা হয়েছে। বস্তার গায়ে বড় করে লেখা আছে কেভিন পিগমেন্টেড। টেক্সটাইলে রঙে ব্যবহৃত হয় কেমিক্যাল। একইভাবে সারি সারি সাজানো আছে প্রিনটেক্স ভি, গ্লিসারিন, সোডিয়াম অ্যানহাইড্রোস, সোডিয়াম থায়োসালফেট, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, মিথাইল ইথাইল কাইটন, থিনার, আইসোপ্রোইল, রি-অ্যাকটিভ এসিড, বেসিক, সলভেন্ট ডাই, ইঙ্কজেক্ট, সোপ-ডিটারজেন্ট পিগমেন্ট, ন্যাফথল, ফাস্ট বেস এবং কালার সল্ট, টেক্সটাইল অক্সিলিয়ারি, অপটিকাল ব্রাইটনার, ক্যারামেল কালার, সিনথেটিক ফুড কালার, থিকেনার, এডহেসিভ, এনজাইম ও ল্যাব কেমিক্যাল। আগুনের সংস্পর্শে এলে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে এসব রাসায়নিক পদার্থ। এক-একটি বস্তা বা ড্রাম হয়ে উঠে এক একটি শক্তিশালী বোমা।

আবদুল ওয়াহেদ ম্যানশনের দ্বিতীয় তলায় উঠে দেখা গেছে, ফ্লোর পুড়ে কালো, বাদামি হয়ে গেছে হাজার হাজার কৌটা। কৌটাগুলো মূলত পারফিউম, লোশন, বডি স্প্রের। আশেপাশের বাসিন্দারা জানান, এখানে বডি স্প্রে ও পারফিউম তৈরি হতো। এসব তৈরি করতে গ্যাস ও কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। চুড়িহাট্টার মসজিদ মোড়ে গাড়ির সিলিন্ডার বিস্ফোরণের পর মুহূর্তের মধ্যে ওয়াহেদ ম্যানশনে ছড়িয়ে যায় আগুন। এ সময় বোমার মতো উড়ে উড়ে বিস্ফোরিত হচ্ছিল কেমিক্যালের কৌটা, বডি স্প্রে।

গতকাল এসব পরিষ্কার করছিলেন স্বেচ্ছাসেবী ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। পুড়ে যাওয়া রাজ্জাক ভবনে গিয়ে দেখা গেছে একই অবস্থা। বেশিরভাগ দোকানই কেমিক্যাল জাতীয় পণ্য ও প্লাস্টিকের দানার। পুরান ঢাকা জুড়েই এসব দোকান, কারখানা ও গোডাউন। ২০১৭ সালে পুরান ঢাকায় একটি জরিপ করে ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স। তাদের জরিপ অনুসারে সহস্রাধিক ঝুঁকিপূর্ণ কারখানা ও কেমিক্যাল গোডাউন রয়েছে ওই এলাকায়। লালবাগ ও মিটফোর্ড এলাকার ২৪ ও ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডে ৩৬০টি ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যাল কারখানা ও গুদাম শনাক্ত করেছিল ফায়ার সার্ভিস। ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যাল গোডাউন ও কারখানার বেশির ভাগই রয়েছে পুরান ঢাকার লালবাগ, ইসলামপুর, ইসলামবাগ, শহীদনগর, আরমানিটোলা, বাবুবাজার, মিটফোর্ড, চকবাজার, কামরাঙ্গীরচরসহ আশেপাশের এলাকায়। এগুলোর বেশির ভাগেরই সংশ্লিষ্ট বিভাগের কোনো অনুমোদন নেই। স্থানীয়দের অভিযোগ, মাঝেমধ্যে অভিযান, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হলেও পরবর্তীতে অসাধু কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে বহাল তবিয়তে চলে এই ব্যবসা।
তদন্ত কমিটির সদস্য বললেন ভবনে কেমিক্যাল ছিল

চকবাজারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ভবনগুলোতে কেমিক্যালের উপস্থিতি ছিলো কিনা তা নিয়ে চলছে বিতর্ক। এ নিয়ে পৃথক দু’ধরনের বক্তব্য দিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয় ও ফায়ার সার্ভিস। শিল্প মন্ত্রণালয় দাবি করেছে, এখানে কোনো কেমিক্যাল গোডাউন ছিল না। অন্যদিকে গতকালও ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা কেমিক্যাল থাকার কথা জানিয়েছেন।

গতকাল সকালে চুড়িহাট্টা মোড়ে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক লে. কর্নেল এস এম জুলফিকার রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ভবনের ভেতরে গ্যাস লাইটার রিফিলের পদার্থ ছিল। এটা নিজেই একটা দাহ্য পদার্থ। এ ছাড়া আরো অন্যান্য কেমিক্যাল ছিলো। প্রত্যেকটা জিনিসই আগুন দ্রুত ছড়িয়ে দিতে সহায়তা করেছে। তিনি বলেন, পারফিউমের বোতলে রিফিল করা হতো এখানে। সেই বোতলগুলো ব্লাস্ট হয়ে বোমের মতো কাজ করেছে।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে জুলফিকার বলেন, অবশ্যই কেমিক্যাল ছিল। যা যা ছিল, সেগুলো এক ধরনের কেমিক্যাল। এগুলোর জন্যই আগুন নিয়ন্ত্রণে সময় লেগেছে বেশি।

ডিএসসিসির তদন্ত কমিটির প্রধান প্রকৌশলী রেজাউল করিম বলেন, আমরা আজ সকাল ৯টার পর ক্ষতিগ্রস্ত ভবনগুলো পরিদর্শনে এসেছি। আগুনে পাঁচটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যেতিনটি ভবন প্রাথমিকভাবে ব্যবহারের অনুপযোগী বলে মনে হয়েছে।

আবাসিক এলাকায় কেমিক্যাল গোডাউনের কোনো অনুমতি নেই। সরকারের নির্দেশনার পর নতুন করে লাইসেন্স দেয়া হয়নি। এ ঘটনায় কয়েকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাদের রিপোর্টের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়া হবে। মেয়র বলেছেন, যে কোনো মূল্যে সবাই মিলে এসব এলাকার কেমিক্যাল গোডাউন সরিয়ে নেয়া হবে।

এতদিন সরানো হয়নি কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা প্রতিনিয়তই চেষ্টা করে যাচ্ছি। এবার যেকোনো মূল্যে সেগুলো সব সরিয়ে নেয়া হবে।

এ কমিটির সদস্য বুয়েটের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হওয়া ওয়াহেদ মঞ্জিলের গ্রাউন্ড ফ্লোর ও দোতলা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিম ও কলামগুলো বিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৩-৪ তলার বিম ও কলাম তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। তবে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এ বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। এক সপ্তাহ পর জানা যাবে, ভবনটি ব্যবহারের উপযোগী কি না। আগুন লাগা অন্যান্য ভবনগুলোও আমরা পরিদর্শন করেছি। তবে এগুলো ব্যবহারের উপযোগী কি না পরীক্ষা শেষে এক সপ্তাহ পর নিশ্চিত হওয়া যাবে।

দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান প্রকৌশলী মো. রেজাউল করিমকে আহ্বায়ক করে গঠিত কমিটির সদস্যরা হলেন প্রফেসর ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী (পুর কৌশল বিভাগ-বুয়েট), প্রফেসর ড. ইশতিয়াক আহমেদ (পুর কৌশল বিভাগ-বুয়েট), লে. কর্নেল এস এম জুলফিকার রহমান (পরিচালক-ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স), মো. আসাদুজ্জামান (অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী-ডিএসসিসি), মো. জাফর আহম্মেদ (অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী-ডিএসসিসি), মো. সিরাজুল ইসলাম (প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ-ডিএসসিসি), মো. নুরুল ইসলাম (তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী-রাজউক),  মো. শাহ আলম (পরিচালক-রাজউক), মো. নুরুজ্জামান জহির (অথরাইজড অফিসার-রাজউক) ও সদস্য সচিব মুন্সী মো. আবুল হাসেম (তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী-ডিএসসিসি)।

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সুরক্ষাসেবা বিভাগ সংশ্লিষ্ট জরুরি কার্যক্রম সমন্বয়ের জন্য একটি কন্ট্রোল রুম স্থাপন করেছে। কন্ট্রোল রুমটির সার্বিক কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষাসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব  প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী। কন্ট্রোল রুমের কার্যক্রম চলে গতকাল রাত ১২টা পর্যন্ত।

১২ সদস্যের আরেকটি কমিটি ঘোষণা করছে শিল্প মন্ত্রণালয়। শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মফিজুল হককে প্রধান করে এ কমিটি করা হয়। কমিটিকে পাঁচদিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

ওদিকে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহম্মেদ খান বলেছেন, ভবনে দাহ্য পদার্থ, থিনার থাকার কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এখানে প্লাস্টিকের জিনিসপত্র, বডি স্প্রে বানানো হয়। যে কারণে আগুনের ভয়াবহতা বেড়ে যায়। তিনি বলেন, আগুনের সূত্রপাতের বিষয়টি নিয়ে এখনও তদন্ত হচ্ছে।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর