বিনোদনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম সিনেমা। আর এই সিনেমা দেখার জন্য চাই প্রেক্ষাগৃহ বা হল। দেশে কেমন ছিল সিনেমা হলের সূচনাকাল? আর তারপর ক্রমে সিনেমা হলের সংখ্যা বেড়ে চলা, এসবের উন্নয়ন, আধুনিকায়নের পথ পেরিয়ে দেশজুড়ে সিনেমা হলের অবস্থা নিয়ে সাজানো হয়েছে ধারাবাহিক প্রতিবেদন বাংলাদেশের সিনেমা হল। লিখেছেন কামরুজ্জামান মিলু। আজ প্রকাশ হচ্ছে এর তৃতীয় পর্ব সিনেমা হলে ঝুলত ‘হাউজফুল’ লেখা বোর্ড
একটা সময় সারা দেশে নারী দর্শকদের সিনেমা হলে যাওয়া-আসা ছিল সবচেয়ে বেশি। স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন এমনকি পরিবারের অন্যরা এবং বন্ধু-বান্ধব মিলে সবাই একসঙ্গে সিনেমা হলে ভিড় করতে দেখা যেত। সোনালি সেই সময়ের সিনেমা হলগুলোর চিত্রটা ছিল একেবারেই ভিন্ন। পোস্টার, ব্যানারের পাশাপাশি বিয়ে বাড়ির মতো সুন্দর মরিচা বাতি দিয়ে সাজানো হতো সিনেমা হলগুলোকে।
দূর থেকে দেখে সব বয়সি নারী-পুরুষের সিনেমা হলে যেতে মন চাইতো- রাজ্জাক, শাবানা, আলমগীর, ববিতা, চম্পা, নূতন, ইলিয়াস কাঞ্চন কিংবা জসিমের ছবি দেখার জন্য। বিশেষ করে মধুমিতা, অভিসার, জোনাকী, বলাকা, সনি, চম্পাকলী, আলমাস, চিত্রা, আজাদ, মানসী, নেপচুন, গীত, পুনম, সংগীত, রাজমণি, রাজিয়া, পূরবী, সনি, সৈনিক ক্লাব, আনন্দ, ছন্দ ও শ্যামলীসহ দেশের বেশিরভাগ সিনেমা হলে দর্শকরা দলবেঁধে ছবি দেখতে যেত। দর্শক বেশি হওয়ার কারণে সিনেমা হলে ঝুলত ‘হাউজফুল’ লেখা বোর্ড।
সিনেমা হলের ব্যবসা সত্তর-আশির দশকে ক্রমশ বাড়তে থাকলে ব্যবসায়ীরা একই জেলা শহরে বা থানায় নির্মাণ করতে শুরু করেন একের পর এক সিনেমা হল। এ বিষয়ে দেশের জনপ্রিয় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান হার্টবিট প্রোডাকশনের কর্ণধার ও চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সাংস্কৃতিক, সমাজকল্যাণ ও আইনবিষয়ক সম্পাদক তাপসী ফারুক বলেন, দেখতে দেখতে সিনেমা হলের সংখ্যা ক্রমশ বেড়ে একটা সময় সারা দেশে ১২শ’এ পৌঁছায়। এমনকি ২০০৮ সালে আমার প্রযোজিত ছবি ‘মনে প্রাণে আছো তুমি’ যখন মুক্তি পায় তখনো দেশে ৭শ’-এর বেশি সিনেমা হল ছিল।
ওই সময়ে তো সপ্তাহে একসঙ্গে চার থেকে পাঁচটি ছবি পর্যন্ত মুক্তি পেতো এবং সবকটি ছবিই ব্যবসা করতো। গ্রামে মাইকিং করে, ব্যান্ড পার্টি ভাড়া করে এবং সিনেমা হলে মরিচা বাতি দিয়ে লাইটিং করে ছবির প্রচারণা করা হতো। গ্রামের দর্শকরা মুক্তি পেতে যাওয়া সিনেমার নাম আগে থেকেই জানত। দর্শকের মনে তখন সিনেমা হলে নতুন ছবি মুক্তি পাওয়া নিয়ে ছিল ব্যাপক উৎসাহ। সিনেমা হলে ব্যবসা যখন রমরমা হতে শুরু করলো তখন সারা দেশেই সিনেমা হল বাড়তে শুরু করে। আমার নিজের মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, মাদারীপুর, ফরিদপুরসহ বেশ কিছু জায়গায় ১০টি সিনেমা হল ছিল। ব্যবসা ভালো হওয়ার কারণেই তো মূলত এই সিনেমা হলগুলো পরিচালনা করেছিলাম আমি।
মনে আছে, শুক্রবার হলেই সবাই মিলে ছবি দেখার ধূম লেগে যেত। তখন ইন্টারনেট হাতে ছিল না। বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম ছিল সিনেমা। আমার প্রযোজনায় ‘প্রাণের প্রিয়া’, ‘মনে প্রাণে আছো তুমি’, ‘মনের জ্বালা’, ‘লাভ ম্যারেজ’সহ বেশকিছু ছবি একটানা কয়েক সপ্তাহ সিনেমা হলে চলেছে। এমনকি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে এক মাস চালানোর পর এক সিনেমা হলের কাছ থেকে আরেক সিনেমা হল ছবি ভাড়া করে নিয়ে যেত এবং সেখানেও দর্শক ছবি দেখার জন্য ভিড় জমাতো। এক ছবি পরিবারের অনেকে মিলে একাধিকবার সিনেমা হলে গিয়ে দেখতো।
এসব কারণেই দিন দিন বেড়ে চলে সিনেমা হলের সংখ্যা। ঢাকার পাশাপাশি চট্টগ্রামে চলচ্চিত্র চর্চার ইতিহাস অনেক পুরনো। বর্তমানে চট্টগ্রামে ‘আলমাস’ ও ‘সিনেমা প্যালেস’ নামে দুটি সিনেমা হল রয়েছে। ‘সিনেমা প্যালেস’ এর কর্ণধার ও চট্টগ্রাম প্রদর্শক সমিতির সভাপতি আবুল হোসেন বলেন, ভালো ভালো ছবি দর্শকরা দেখতে পেতো বলেই চট্টগ্রামে একটা সময় সিনেমা হল বাড়তে থাকে। ‘সিনেমা প্যালেস’, ‘আলমাস’, ‘সাগরিকা’, ‘গুলজার’, ‘রঙ্গম’, ‘উজালা’, ‘ঝুমুর’, ‘লায়ন’, ‘বনানী’, ‘সানাই’, ‘সংগীত’, ‘নূপুর,’ ‘চাঁদনী’, ‘কর্ণফুলি’, ‘পূরবী’সহ অনেক সিনেমা হল একটা সময় চট্টগ্রামে তৈরি হয়। ‘অবুঝ মন’, ‘রুপবান’, ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘বেদের মেয়ে জোসনা’সহ অসংখ্য ছবি বেশ ভালোভাবে চলেছে আমাদের ‘সিনেমা প্যালেস’ হলে। দর্শকদের সেসময় ছিল উপচে পড়া ভিড়। ‘হাউজফুল’ সাইনবোর্ড ঝুলত।
সিনেমা ভালো ব্যবসা করার কারণে হল মালিকদের মনে ছিল আনন্দ। ১৯২৭ সালে ‘সিনেমা প্যালেস’ নির্মাণ হয়। আমাদের এ সিনেমা হলে মহিলাদের বসার জন্য আলাদা করে ৬০টি আসন রয়েছে। নারী-পুরুষ সবাই সিনেমা উপভোগ করতে আসে। এখন সময়টা মন্দা। তাই চট্টগ্রাম শহরে মাত্র দুটি সিনেমা হল টিকে আছে। তবে, একটা সময় ব্যবসা ভালো ছিল এবং সিনেমা হলের সংখ্যা চট্টগ্রামে বেশ বেড়েছিল। আমরা পুরনো সেই দিনটি আবার ফিরে পেতে চাই। বন্ধ না হয়ে আবারো সিনেমা হলের সংখ্যা সারা দেশে বাড়তে থাকুক এটাই প্রত্যাশা থাকবে আমাদের।