× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার , ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৭ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

উদ্যমী তরুণী রিমার স্বপ্নজয়ের গল্প

বাংলারজমিন

আশরাফুল ইসলাম, কিশোরগঞ্জ থেকে
২৩ মার্চ ২০১৯, শনিবার

মাত্র ৭শ’ টাকা পুঁজি নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন রিমা। এখন প্রতি মাসে গড়ে অন্তত ৫০ হাজার টাকা আয় হয় রিমার। বিস্ময়করভাবে মাত্র সাড়ে তিন বছর সময়ে একজন সফল উদ্যোক্তায় পরিণত হয়েছেন তিনি। জামা-কাপড়ে হাতের কাজ, এপ্লিক ও ব্লক বাটিকের মাধ্যমে স্বাবলম্বী জীবনের স্বপ্ন ও বাস্তবের যোগসূত্র গড়ে দিচ্ছেন এই উদ্যমী তরুণী। কটিয়াদী উপজেলার জামষাইট গ্রামের এই তরুণী আজ তরুণী-নারীদের আদর্শ। তার জামা-কাপড়ে এপ্লিক, ব্লক বাটিক ও হাতের কাজের ব্যবসায় শ্রম দিয়ে জেলার অন্তত চার শতাধিক নারী পেয়েছেন সচ্ছল জীবনের খোঁজ। তার এই উদ্যোগ পথ দেখিয়েছে জেলার বিভিন্ন এলাকার নারীদেরও।

পুরো নাম রিমা আক্তার। দুই বোন ও এক ভাই এর মধ্যে সবার ছোট রিমা।
বাবা মো. আব্দুল হাশেম ও মা আনোয়ারা বেগমের তিন সন্তানের মধ্যে সবার বড় মেয়ে ইয়াসমিন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। দ্বিতীয় ছেলে মাহবুব আলম রুবেল মালয়েশিয়া প্রবাসী। ২০০৯ সালে বড় মেয়ে ইয়াসমিনের চাকরি হয়। ২০১৫ সালে ছোট মেয়ে রিমা আক্তার এইচএসসি পাশ করেন। স্বভাবতই বাবা-মা ও ভাই-বোনের প্রত্যাশা ছিল রিমাকেও চাকুরে বানানোর।
কিন্তু রিমার ভাবনা ছিল ভিন্ন। নিজে কাজ করার পাশাপাশি অন্যদের স্বাবলম্বী করার চিন্তা ছিল তার মাথায়। এজন্যে মায়ের কাছে পাঁচ হাজার টাকা চেয়েও ব্যর্থ হন রিমা। খালা লাভলী আক্তারের সঙ্গে বিষয়টি শেয়ার করলে তিনি কিশোরগঞ্জ শহরে একটি এক কক্ষের বাসা ভাড়া নিয়ে দেন। সেখানে খালার প্রাথমিক বিদ্যালয় পড়ুয়া দুই শিশু সন্তানকে পড়ানোর পাশাপাশি প্রশিক্ষণের জন্য ভর্তি হন জেলা পরিষদের এপ্লিক প্রশিক্ষণ কাজে।

অবশ্য ছোট বেলা থেকে হাতের কাজের ঝোঁক ছিল রিমার। মা আনোয়ারা বেগম নিজের হাতে কাজ করা জামা পড়াতেন রিমাকে। ফুফু রোকেয়া আক্তার ও খালা মনোয়ারা বেগম ভালো হাতের কাজ করতেন। মা, খালা ও ফুফুর হাতের কাজের এই দক্ষতা রিমাকে প্রভাবিত করে। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে রিমাও নিজের কাজ করা জামা তৈরি করেছেন।

২০১৫ সালের ১৫ই জানুয়ারি জেলা পরিষদের দুই মাসব্যাপী এপ্লিক প্রশিক্ষণে প্রথম হন রিমা। প্রশিক্ষণের দৈনিক ভাতা হিসেবে মোট ৭শ’ টাকা পান। এই টাকা দিয়ে শুরু হয় রিমার স্বপ্নযাত্রা। কিনেন সুতা। তৈরি করেন এক জোড়া কুশি কাটা জামার হাতা। এতে নিজের শ্রম ছাড়া ৬৫ টাকা খরচ হয়। বিক্রি হয় ৬শ’ টাকায়। দোকানে সুতা কেনার পরিচয়ের সূত্র ধরে আট হাজার টাকার কাজের অর্ডার পান রিমা। প্রশিক্ষণের সুবাদে আমতলা এলাকার কর্মীদের দিয়ে এই কাজ করান। এতে চার হাজার টাকার মতো লাভ হয়। প্রথম দিকে ১৫জন কর্মী হলেও পরবর্তিতে ৫০ জন কর্মী তৈরি হয়। অনলাইনে ফেসবুকভিত্তিক বিভিন্ন বেচাকেনা গ্রুপে জামার ডিজাইন দিলে, সেখান থেকে ভালো অর্ডার পান। এ সময় অর্ডারের কুশিকাটা তৈরির প্রয়োজনে বান্ধবী শ্যামলী রায়ের কাছ থেকে দুই হাজার টাকা হাওলাত নেন।

১২টি জামার কাজ থেকেও আয় হয় প্রায় হাজার দশেক টাকা। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি রিমাকে। পরিচিতজনদের মাধ্যমে রিমার কাজের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে শহরজুড়ে। ২০১৫ সালের শেষ দিকে জেলা পরিষদে ব্লক বাটিক প্রশিক্ষণ নিতে গিয়ে পরিচয় হয় যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের ইন্সট্রাক্টর শাহনাজ বেগমের সাথে। পরবর্তিতে সেলাই প্রশিক্ষণ নেয়ার সময়ে শাহনাজ বেগমের পরামর্শে যুব উন্নয়নেও সেলাই প্রশিক্ষণে ভর্তি হন। সকালে যুব উন্নয়ন বিকালে জেলা পরিষদে প্রশিক্ষণ নেয়ার পাশাপাশি হাতের কাজের জামা তৈরি করে বিক্রি করছিলেন। বর্তমানে রিমা একজন একজন সফল উদ্যোক্তা। কাজ করছেন পোশাক বিপণনে। গড়েছেন নিজের প্রতিষ্ঠানও। শুধু পোশাকই নয়। তিনি ক্রেতাদের পছন্দের অনেক পণ্যই তৈরি করে সরবরাহ করে থাকেন। ২০১৫ সালের মার্চে জামায় কুশি কাটা জামার হাতার কাজ করে তার পথ চলা শুরু। কিন্তু এতোদূর আসাটা মোটেও তার জন্য সহজ ছিলো না। তাছাড়া প্রতিযোগিতার এ শহরে তাকে টিকতে হলে জানতে হবে অনেক কিছুই। শিখতে হবে বাজার চাহিদা।

রিমা যখনই যেখানে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, পরিশ্রম আর নিষ্ঠা দিয়ে আলো ছড়িয়েছেন সেখানে। ব্লক বাটিক, সেলাই, এপ্লিক, স্ক্রিন প্রিন্ট, গ্রাফিক্স ডিজাইনের উপর নেন বেশ কয়েকটি প্রশিক্ষণ। বাস্তবিক জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি নেন হাতে কলমে প্রশিক্ষণ। রিমার সমবয়সীরা যে সময়টা গল্প গুজব করে কাটিয়ে দেন, রিমা তখন ব্যস্ত থাকেন হাতের কাজ নিয়ে। কাপড়ের কোয়ালিটি, কোথায় তৈরি হয়, নতুন নকশা, সুতার মান, বাজারে কিভাবে বিক্রি হয়, অনলাইনে কেমন চাহিদা এসবের উপর জানার চেষ্টা করেন। রিমি ফ্যাশন নামের একটি ফেসবুক পেইজও খুলেন রিমা। সেখানে নতুন ডিজাইনের পোশাক বিশেষ করে মেয়েদের পোশাকের পোস্ট দেন।

২০১৬ সালের উন্নয়ন মেলা বদলে দেয় রিমার জীবন। যুব উন্নয়নের স্টল সাজান নিজের তৈরি করা হাতের কাজের জামা দিয়ে। মেলায় তার স্টলে ছিল উপচে পড়া ভিড়। এই মেলায় ব্যাপক পরিচিতি পাওয়ার পাশাপাশি এক লাখ টাকার অর্ডার পান রিমা। পরবর্তিতে ডিজিটাল উদ্ভাবনী মেলা, বই মেলা, বৈশাখী মেলা, নবান্ন মেলা সবখানেই সফল অংশগ্রহণ ছিল রিমার। ২০১৮ সালে কিশোরগঞ্জে অনুষ্ঠিত প্রথম এসএমই মেলায় অংশ নিয়ে তৃতীয় হন। এবার ২০১৯ সালের এসএমই মেলায় হন প্রথম। এছাড়া নারী উন্নয়ন মেলায়ও প্রথম হন রিমা। ২০১৫ সালের নভেম্বরে বাসা পাল্টিয়ে শহরের বত্রিশ এলাকার একটি ফ্লাট বাসার দোতলা পাঁচ হাজার টাকায় ভাড়া নেন। এখন বাসা থেকেই ক্রেতারা লাইন ধরে জামা কিনে নিয়ে যান। জেলার বাইরে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পাঠান। এখন প্রতি মাসে গড়ে অন্তত ৫০ হাজার টাকা আয় হয় রিমার। এ ব্যাপারে রিমা বলেন, কাজটা ভালো পারি। পরিশ্রম করি। শত প্রতিকূলতা থাকলেও আমি আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। রিমা জানালেন, আগে পরিবারের কেউ রিমাকে এ কাজের জন্য নানা কথা শোনালেও এখন তারা সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। মা-বাবা, ভাবী, বোন, ভগ্নিপতি সবাই এখন তার সহযোগী।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর