× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার , ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

অন্ধকারে জোনাকী / পূর্বসূরিদের পদচিহ্ন ধরে

শেষের পাতা

মনিজা রহমান
২৩ মার্চ ২০১৯, শনিবার

কেউ ভাবেনি। কেউ না। বাংলাদেশের এক অজপাড়াগাঁর সাদামাটা তরুণ, সে-ও কি কখনো ভেবেছিল, নিয়তি যে তাকে একদিন শিপ জাম্পার করবে। শীতের রাতে কাঁথামুড়ি দিয়ে দাদি-নানিরা যে গল্প করে, এই কাহিনী তারচেয়েও ভয়ংকর। কূল নাই, কিনার নাই মহাসমুদ্রে জাহাজ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়তেন তারা। তারপর জীবন বাজি রেখে বরফের মতো শীতল পানিতে সাঁতরাতে হত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তাদের কেউ হয়ত কূলের দেখা পেতেন। কেউ হয়ত চিরতরে তলিয়ে যেতেন বিশাল মহাসমুদ্রে।
যারা বেঁচে যেতেন, তাদেরও তখন মুমূর্ষু অবস্থা। তবে আমেরিকার স্থানীয় মানুষ তাদের আশ্রয় দিতেন। দিতেন খাদ্য-বস্ত্র ও থাকার জায়গা।

জীবনের নানা পদে হোঁচট খেতে খেতে এক সময় তাদের জায়গা হতো কখনো এলেন স্ট্রিটে, কখনো হারলেমে। ভাবতে গর্ব লাগে এই দুঃসাহসী মানুষেরাই আমেরিকায় আমাদের পূর্বসূরি। তাদের পদচিহ্ন ধরে বঙ্গদ্বীপ নামে পৃথিবীর বুকে বিস্ময়কর এক জনপদ থেকে এখানে এসেছে একের পর এক বাঙালি। তাদের রক্ত পানি শ্রমে-ঘামে মার্কিন মুলুকে গড়ে উঠেছে বাঙালি বসতি। বৈধ-অবৈধ উপায়ে আগত পূর্বসূরিদের সেই শ্রম-ঘামের ঋণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আমরা আয়োজন করতে চলেছি একটি অনুষ্ঠান, যার শিরোনাম দেয়া হয়েছে- ‘পূর্বসূরিদের পদচিহ্ন ধরে’।

নিউ ইয়র্ক শহরে অন্যান্য দেশের অধিবাসীরা এখন বাঙালিকে ‘শিপ জাম্পার’ হিসেবে চেনে না। সবাই তাদের জানে অত্যন্ত মেধাবী ও পরিশ্রমী একটি জাতি হিসেবে। যাদের পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ যেকোনো সমপ্রদায়ের জন্য অনুকরণীয়। সর্বত্র এখন উড়ছে বাঙালির বিজয়ের নিশান। জীবনের নানা বাঁকে, চড়াই উতরাই পেরিয়ে এই জায়গায় আসতে হয়েছে তাদের। তবে এই নিউ ইয়র্ক শহরের প্রতিটি ধূলিকণায় রয়ে গেছে তাদের সংগ্রামের ইতিহাস। তারা ইতিহাস হলেও, তাদের উত্তরসূরিরা রয়ে গেছে পুরো শহরময়। উত্তরসূরিদের পালা এবার ইতিহাসের দায় স্বীকারের।

এ্যালেন স্ট্রিটের আগে ম্যানহাটানের পাশে হারলেমে পূর্বসূরি বাঙালিদের বসবাস ছিল বলে জানা যায়। তবে তাদের উত্তরসূরিদের এখন বাঙালি বলে চিহ্নিত করা কঠিন। তারা এখন মিশে গেছে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠির মধ্যে। ১৯১৫ সালের দিকে জাহাজে করে আমেরিকায় পা রেখেছিলেন সুনামগঞ্জের ফেরু খাঁ। তার বংশধররা এখনও টিকে আছেন। ফেরু খাঁর সঙ্গে প্রায় একই সময়ে বৃহত্তর সিলেটের আবদুল তাহের, সিকান্দার মিয়া, খলন্দর মিয়ারা আসেন। ১৯২৬ সালের দিকে আসেন ইব্রাহিম চৌধুরী। তিনি ছাত্রাবস্থায় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের জন্য দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। এক বন্ধুর সহযোগিতায় জাহাজে করে আমেরিকায় আসেন আজীবন অভিবাসীদের অধিকার নিয়ে প্রতিবাদী এই মানুষটি।

সুনামগঞ্জের ছাতক ও জগন্নাথপুরের বেশ কয়েকটি গ্রামের মানুষ ছিলেন বংশপরম্পরায় জাহাজের নাবিক। ভাগ্যান্বেষী ও প্রচণ্ড দুঃসাহসী ছিলেন তারা। উনিশ শতকের শুরুতে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমিয়েছেন, আটলান্টিক পার হয়ে এসেছেন নিউ ইয়র্কেও। ফেরু খাঁয়ের পথ অনুসরণ করে আমেরিকায় পাড়ি জমান তাঁর ভাতিজা ইসাদ আলী। আবার তার অনেক বছর পরে আমেরিকায় আসেন ইসাদ আলীর ভাতিজা আপতাব আলী। এভাবে ফেরু খাঁয়ের উসিলায় গত শতকে বৃহত্তর আমেরিকায় এসে নাগরিক হয়েছেন প্রায় হাজার খানেক সিলেটের মানুষ। বৃহত্তর সিলেট ছাড়াও পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রাম, সন্দ্বীপ, নোয়াখালীর মানুষ এখানে এসে বসতি স্থাপন করেছে।

দীর্ঘ লড়াইয়ের পরে আমেরিকার নাগরিকত্ব পান ইব্রাহিম চৌধুরী। তারপর তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ডাউন টাউন ইস্ট ইন্ডিয়া ক্লাব। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পরে ক্লাবের নাম হয়- পাকিস্তান লিগ অব ক্লাব। দুটি ক্লাবেরই প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তিনি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে ক্লাবের নাম হয়- বাংলাদেশ লিগ অব ক্লাব। যার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন সামছুদ্দিন আহমেদ। ১৯৩০ সালে জাহাজে করে নিউ ইয়র্কে আসেন বৃহত্তর সিলেটের খোরশেদ আলী। ইব্রাহিম চৌধুরী ও খোরশেদ আলী ছিলেন বন্ধু ও সমাজসেবায় ছিলেন দুজনেই ব্রত। কারো বিপদে এগিয়ে যাওয়া, হাসপাতালে নেয়া, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন তারা। এই নব্বই দশকের আগে পর্যন্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা এত আধুনিক ছিল না। বাংলাদেশ থেকে আগত বাঙালিরা জেএফকে তে পা রেখে কোথায় যাবেন, কিভাবে যাবেন, কোথায় থাকবেন বুঝে উঠতে পারত না। তখন কিছু সহৃদয় বাঙালি এগিয়ে আসতেন জন্মভূমির মানুষের জন্য। এভাবেই এই শহরে হাতে হাত রেখে চলেছে বাঙালি প্রজন্ম।

১৯৫৮ সালের মে মাসে ৪৬৫ ওয়েস্ট ১২৫ স্ট্রিটে  ‘বোম্বে ইন্ডিয়া’ নামে সম্পূর্ণ নিজের মালিকানায় একটি রেস্টুরেন্ট চালু করেন জাহাজ থেকে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়া সেই ইসাদ আলী। নিউ ইয়র্কে রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় উপমহাদেশের মধ্যে দ্বিতীয় ও বাংলাদেশিদের মধ্যে প্রথম ব্যক্তি হলেন তিনি। ১৯৭৩ সালে ২৩৪ ওয়েস্ট ৫৬ স্ট্রিটে খোলেন বোম্বে ইন্ডিয়া-২ নামে আরেকটি রেস্টুরেন্ট। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবাসীদের গড়া ফান্ডে একাই এক হাজার ডলার দিয়েছিলেন ইসাদ আলী। ১৯৮২ সালে তিনি প্রথিবী ছেড়ে চলে যান। সারাজীবন নিউ ইয়র্কে রুটি-রুজির জন্য সংগ্রাম করলেও অন্তিম ইচ্ছা অনুযায়ী নিজ গ্রামে কবর দেয়া হয় ইসাদ আলীকে। জন্মভূমি সুনামগঞ্জের ছাতকের কাইষ্টোকোনা গ্রামের মাটিতে চিরশায়িত এই মানুষটিকে মনে রাখেনি কেউই। অথচ তার সহযোগিতায় অনেক বাংলাদেশিই বৈধ কিংবা অবৈধ উপায়ে স্বপ্নের দেশ আমেরিকায় এসেছিলেন।

আমি এই লেখায় ইব্রাহিম চৌধুরী ও ইসাদ আলীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করলেও, তাদের মতো আরো অনেকের অবদানে ভিত রচিত হয়েছে ভিনদেশে বাঙালি জাতিগোষ্ঠির। ক্রমবর্ধমান হারে পুরো আমেরিকার অলিগলিতে এখন বাঙালির জয়জয়কার। ডাউনটাউন থেকে আপটাউন, ব্রুকলীন থেকে ম্যানহাটান, কুইন্স থেকে ব্রঙ্কস, জ্যাকসন হাইটস থেকে ওজনপার্ক কিংবা পার্কচেস্টার থেকে হিলসাইড- কোথায় নেই বাঙালি? প্রশাসন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়িক পরিমণ্ডল, মূলধারার রাজনীতি- সর্বত্র দেশ-জাতির মুখ উজ্জ্বল করেছে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতরা। রিলে রেসের মতো পুর্বসূরিদের দেয়া মশাল হাতে নিয়ে স্বদর্পে এগিয়ে চলেছে লাল-সবুজ পতাকা বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো মানুষেরা।

পূর্ব প্রজন্মের বাঙালিদের কথা শুনলে জীবনানন্দ দাসের ‘বনলতা সেন’ কবিতার কথা মনে পড়ে যায়। ‘হাল ভেঙ্গে যে নাবিক হারিয়েছে দিশা। সবুজ ঘাসের দ্বীপ দেখেছে সে দারুচিনি দ্বীপের ভেতর’। নিউ ইয়র্ক শহর ছিল যেন সেই সবুজ ঘাসের দ্বীপ। যেখানে এসে দিশা খুঁজে পেয়েছে হাল ভাঙ্গা নাবিকেরা। সেই সব অভিযাত্রী নাবিকদের এখন কেউ বেঁচে নেই। আছেন তাদের উত্তরসূরিরা। এখন তাদের মহান দায়িত্ব পূর্বসূরিদের অবদানকে কৃতজ্ঞতা ভরে স্বীকার করা। তাহলেই নতুন যে প্রজন্ম বেড়ে উঠছে, তারাও একদিন গর্ব ভরে স্মরণ করবে আমাদের। আর এভাবেই শুরু হবে ইতিহাসের পরম্পরা।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর