× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার , ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৭ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

গণপরিবহনে বিশৃঙ্খলার নেপথ্যে

প্রথম পাতা

শুভ্র দেব
২৩ মার্চ ২০১৯, শনিবার

কিছুতেই শৃঙ্খলা আনা যাচ্ছে না গণপরিবহনে। বিশেষ করে রাজধানীর গণপরিবহনের শৃঙ্খলা ফেরানোর কোনো চেষ্টাই যেন কাজে আসছে না। গত বছর শিক্ষার্থীদের নজিবিহীন আন্দোলনে ঘুম ভেঙেছিল সবার। স্কুলের শিক্ষার্থীরা সড়কে নেমে যেভাবে নানা অনিয়ম তুলে ধরেছিল জাতির সামনে তা খবরের শিরোনাম হয়েছিল আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও। ব্যাপক এই আন্দোলনের পর রাজধানীর গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে নানামুখী উদ্যোগ নেয়া হয়। দেয়া হয় নানা প্রতিশ্রুতি। কিন্তু গত আট মাসে সড়ক নিরাপত্তার উন্নতি খুব একটা দৃশ্যমান হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরীর মৃত্যুর পর আবারো আলোচনায় সড়ক নিরাপত্তা।
পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু পরিকল্পনা করেই সড়কে নিরাপত্তা ফেরানো যাবে না। এই খাত ঘিরে চাঁদাবাজি ও অনৈতিক বাণিজ্য বন্ধ করতে না পারলে শৃঙ্খলা ফেরানো অসম্ভব। মূলত এই বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত চক্রই এ খাতে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে রাখতে চায়।

সড়কে বিশৃঙ্খলার পেছনে চাঁদাবাজি বড় কারণ বলে পরিবহন সংশ্লিষ্টরাও মনে করছেন। নামে বেনামে বিভিন্ন সমিতি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, ক্ষমতাসীন সংগঠনসহ নানা খাতে দিতে হয় চাঁদা। বিশেষ করে দূরপাল্লার যাত্রীবাহী ও মালবাহী যানবাহনগুলোকে গুনতে হয় বড় অঙ্কের টাকা। আর রাজধানী ঢাকার গণপরিবহনগুলোতে এই চিত্র আরো ভয়ঙ্কর।
রাজধানীর গুলিস্তান থেকে পুরান ঢাকার নিমতলী ও কেরানীগঞ্জের রুহিতপুরে চলাচলকারী লেগুনাগুলো নিয়মিত চাঁদা দিয়ে চলাচল করে জানিয়েছেন চালকরা। এখানে টেম্পু চালাতে শুধু গুলিস্তানেই দিনে ৫১০ টাকা এবং লেগুনা চালাতে দিতে হয় ৬শ’ টাকা চাঁদা। এ ছাড়া কেরানীগঞ্জে দিতে হয় দেড় থেকে ২শ’ টাকা। সব মিলিয়ে ৮শ’ থেকে ৯শ’ টাকা চাঁদা দিয়ে গাড়ি চালাতে হয়। এ রুটে চলাচালকারী এসব যানের বেশিরভাগেরই লাইসেন্স, ফিটনেস নেই বলে। প্রভাবশালী চক্র নেপথ্যে থাকায় নির্বিঘ্নে চলছে এসব।

যাত্রাবাড়ী থেকে ডেমরার ৬টি রুটসহ গেন্ডারিয়া, পোস্তগোলা, চিটাগাংরোড, গুলিস্তান রুটে লেগুনা চলে। সবকটি রুটে প্রতিদিন প্রায় ৫শ’ লেগুনা চলে। চালক ও লাইনম্যানদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এসব লেগুনা থেকে মালিক সমিতির লাইনম্যানরা প্রতিদিন ৪শ’ থেকে ৪৫০ টাকা চাঁদা উঠায়। চিটাগাং রুটের এক লেগুনা চালক জানান, আমরা যাত্রাবাড়ীতে দেই ২১০ টাকা আর চিটাগাংরোডে দেই আরো ২শ’ টাকা।

এ ছাড়াও বিভিন্ন অজুহাতে ২০ টাকা ৫০ টাকা করে আরো একশত টাকা উঠানো হয়। শুধু লেগুনাই নয়, গাজীপুর থেকে সদরঘাটগামী বাসে দিনে অন্তত ১২শ’ থেকে ১৩শ’ টাকা চাঁদা দিতে হয়। পথে কয়েক স্থানে নির্ধারিত স্পটে এ চাঁদা আদায় করা হয়। অন্য রুটে চলাচলকারী যানবাহনও চলে চাঁদা দিয়ে। পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রুট পারমিট নিয়ে প্রভাবশালীরা কোনো পুঁজি ছাড়াই পরিবহন ব্যবসা করছেন। তারা কোম্পানি খুলে বিভিন্ন মালিকের বাস নিয়ে পরিচালনা করে থাকেন। এসব বাস মালিকরা  দৈনিকভিত্তিতে ভাড়া পান। আর কোম্পানি সংশ্লিষ্টরা কোনো পুঁজি ছাড়াই মোটা অঙ্কের অর্থ আয় করছেন। চালক ও শ্রমিকরা জানান, এ ধরনের ব্যবস্থার কারণে পরিবহনে বাস মালিকদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।  কোম্পানিগুলোই সব নিয়ন্ত্রণ করে। চালক ও সহকারী নিয়োগ দেয়। তারা সব সময় বেশি লাভের আশায় চুক্তিতে বা কম বেতনে চালক ও সহকারী নিয়োগ দিয়ে থাকে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চাঁদা দিয়ে গণপরিবহন চালানোয় গাড়ির লাইসেন্স, চালকের লাইসেন্স, ফিটনেস না থাকলেও দিব্যি চলছে বাস-লেগুনাসহ যাত্রীবাহী যান। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় সদস্য এই অনৈতিক বাণিজ্যে জড়িত থাকায় এসব যানবাহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেয়া হয় না খুব একটা। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরীকে চাপা দেয়া সুপ্রভাত বাসটির রুট পারমিট ছিল না রাজধানীতে চলার। এ ছাড়া এ বাসের বিরুদ্ধে অনেকগুলো মামলাও ছিল। এ অবস্থায় বাসটি নিয়মিত যাত্রী পরিবহন করেছে অনায়াসে। খোদ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকেই প্রশ্ন উঠেছে পারমিট ছাড়া এ বাস ঢাকার সড়কে এতদিন চলেছে কিভাবে? এদিকে, গতকাল গাজীপুর রুটে চলাচলকারী বলাকা সার্ভিসের একটি বাস সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেননের গাড়িতে ধাক্কা দেয়। অল্পের জন্য তিনি প্রাণে বেঁচে যান। ওই বাসটি আটকের পর পুলিশ জানিয়েছে, লাইসেন্স ছাড়াই গাড়ি চালাচ্ছিলেন চালক।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী মানবজমিনকে বলেন, গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে। পরিবহন সেক্টরে মালিক সমিতি ও পুলিশ যেভাবে জড়িয়ে পড়েছে এটা যদি বন্ধ না হয় তবে ভবিষ্যতে এটি আরো ভয়াবহ রূপ নিবে। তিনি বলেন, চাঁদাবাজির ভয়াবহতা এতটাই বেড়ে গেছে শুধু পণ্যবাহী গাড়ি নয় সদরঘাট থেকে একটি বাস গাবতলী পর্যন্ত যাতায়াত করতে গেলে তাকে প্রতিদিন ১২০০ টাকা থেকে শুরু করে ১৫০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফেরাতে রাজনৈতিক সদিচ্ছার কোনো বিকল্প নাই। বিশেষ করে রাজধানীর গণপরিবহন গুলোকে যদি সরকারি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে স্বীকৃত ভালো কোম্পানিকে দিয়ে পরিচালনা করতে হবে। তিনি বলেন, ছয়টি কোম্পানির মাধ্যমে গণপরিবহন পরিচালনা করার যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে সেটাও ভালো উদ্যোগ। মালিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে এটা করা হয়েছে। তবে এটিকে যাত্রীবান্ধব করার জন্য যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিনিধিকে সঙ্গে রাখা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

পুলিশের সাবেক আইজি নুর মোহাম্মদ মানবজমিনকে বলেন, সড়কে যা ঘটে যাচ্ছে তা পুরোপুরি ভীতিকর একটা অবস্থা হয়ে গেছে। আমরা বাইরে বের হলে সুস্থ বা জীবিত ফিরে আসব সেটার কোনো নিশ্চয়তা নেই। গণপরিবহনের  বিশৃঙ্খলা নিয়ে আমরা সবাই দেখছি, কথা বলছি, আলাপ আলোচনা করছি আবার কিছু ব্যবস্থা নিচ্ছি। কিন্তু দিন শেষে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। এখানে সমন্বয়ের একটা অভাব আছে। শৃঙ্খলার দায়িত্বে পুলিশ, ফিটনেস লাইসেন্সের দায়িত্বে বিআরটিএ, আবার যারা রাস্তা দেখে সবার মধ্যে সমন্বয় রেখে কাজ করতে হবে।

তিনি বলেন, হাইওয়েতে যে বাস, ট্রাক, লরি চলে সেগুলো খুবই বেপরোয়া ও নিয়ন্ত্রণহীন। এসব চালকের না আছে ড্রাইভিং লাইসেন্স না আছে গাড়ির ফিটনেস। তাই আমাদের কাজ করতে হবে। যার যেখানে দায়িত্ব সেখানে কাজ করতে হবে। যে কাজ করতে পারে নাই তাকে ধরতে হবে কেন সে করতে পারে নাই। তাকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তিনি বলেন, সবাই সবার জায়গা থেকে কাজ করে যেতে হবে। শুধু পুলিশকে বললে হবে না। পুলিশেরও একটা সীমাবদ্ধতা থাকে। এ ছাড়া যে ছেলে মেয়ে কানে হেডফোন দিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায় তাদেরকে সচেতন হতে হবে। আমাদের সমস্যা আমরা প্রধানমন্ত্রীর দিকে চেয়ে থাকি। উনি বললে আমরা করব। কেন? আমাদের কোনো দায়িত্ব নাই। আমরা সবাই চাকরি করি। সে হিসেবে আমাদের নিজেদের তো একটা দায়িত্ব আছে। তাই এসব বিষয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এসেছে।

তা না হলে ভবিষ্যতে এই সমস্যা মারাত্মক আকার ধারণ করবে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক হোসাইন আহম্মেদ মজুমদার মানবজমিনকে বলেন, রাস্তা-ঘাটে সাধারণত দুইভাবে চাঁদা নেয়া হচ্ছে। পুলিশের পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠনের নামে চাঁদা নেয়া হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে জেলা বা পৌরসভা পর্যায়ে যে সকল সংগঠনের গাড়ি রাখার নির্দিষ্ট জায়গা আছে, তাদের নিরাপত্তাকর্মী নিয়োগ দেয়া আছে, চালকরা গাড়ি থামিয়ে খেয়ে দেয়ে একটু বিশ্রাম নিতে পারবে এসব সংগঠনই ৩০-৪০ টাকা চাঁদা নেয়ার নিয়ম আছে। কিন্তু দেখা যায় রাস্তা ঘাটে নামে বেনামে কিছু সংগঠন টাকা তুলে।

এটা বন্ধের জন্য আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বলার পরও কোনো কাজ হচ্ছে না। আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে নিয়মবর্হিভূত কোনো চাঁদাবাজি যাতে না হয়। তিনি বলেন, পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ১৬ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছেন। এই কমিটির একজন সদস্য আমি। বৃহস্পতিবার বিআরটিএতে এই কমিটির পঞ্চম সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য ইতিমধ্যে বিভিন্ন সেক্টর থেকে ১২৮টি সুপারিশ করা হয়েছে। আমরা এই সুপারিশ নিয়েই কাজ করছি। তিনি বলেন, শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য উল্লেখযোগ্য সুপারিশের মধ্যে রয়েছে চালকদের দক্ষ করার জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। মালিক, শ্রমিক, পথচারীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা। কোন রোড দিয়ে কোন গাড়ি চলবে তা চিহ্নিত করে দেয়া। ফুটওভারব্রিজ, জেব্রা ক্রসিং উন্নত করে চলাচলের উপযোগী ও মেনে চলতে বাধ্য করা। ফিটনেস, রেজিস্ট্রেশনসহ অন্যান্য কাগজপত্র ঠিক না থাকলে সড়কে যাতে গাড়ি নামানো না হয়।  

সড়ক পথে চাঁদাবাজি নিয়ে হাইওয়ে পুলিশের ডিআইজি মো. আতিকুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, সড়কে মালিক পরিবহন সংগঠনের সদস্যরা চাঁদা নেয়। যারা সংগঠনের সদস্য তারাই  চাঁদা দেয়। তবে জোর করে যদি কেউ চাঁদাবাজি করে সে অভিযোগ আমাদের দেয়া হলে চাঁদাবাজির মামলা নিয়ে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর যদি সমিতির রিসিটের মাধ্যমে টাকা উঠালে কেউ অভিযোগ করবে না। পুলিশের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ নিয়ে তিনি বলেন, যেকোনো পুলিশ সদস্যের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেয়া হয়।

গত বছরে শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার জেরে নিরাপদ সড়কের আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। নজিরবিহীন আন্দোলনে অচল হয়ে পড়ে ঢাকা। তখন সড়ক ব্যবস্থাপনার নানা উদ্যোগ নেয় সরকার। তবে এ পর্যন্ত এসব উদ্যোগের খুব একটা বাস্তবায়ন হয়নি বলে দাবি পরিবহন বিশেষজ্ঞদের।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর