× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার , ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১১ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

সন্ত্রাসী ব্রেনটনের আদ্যোপান্ত

বিশ্বজমিন

মানবজমিন ডেস্ক
(৫ বছর আগে) মার্চ ২৪, ২০১৯, রবিবার, ২:১৯ পূর্বাহ্ন
ব্রেনটন ও তার বাড়ি

সন্ত্রাসী ব্রেনটন হ্যারিসন টেরেন্ট (২৮)। অস্ট্রেলিয়ার সাউথ ওয়েলসে তার জন্ম। সংক্ষেপে তাকে ডাকা হয় ব্রেনটন টেরেন্ট নামে। তার জন্ম এক কর্মজীবী পরিবারে। তার ছিল সাধারণ জীবন। শ্বেতাঙ্গ যুবক সে। একাকী থাকতো। পড়াশোনা নেই।
অশিক্ষিত।

নিউজিল্যান্ডে গিয়ে ডুনেদিনের পূর্বদিকে বসবাস করতো সমারভিলে স্ট্রিটের একটি বাড়িতে। কিন্তু এই বাড়ির আশপাশে যারা বসবাস করেন তারা কখনো ক্রাইস্টচার্চে মসজিদে হামলাকারী এই সন্ত্রাসীকে দেখেন নি। হয়তো প্রতিবেশীরা একে অন্যকে পথে অতিক্রম করে গেছেন কাজে যাওয়ার সময়। আবার সন্ধ্যায় ফিরেছেন বাসায়। কিন্তু ব্রেনটন টেরেন্টকে তারা দেখতে পান নি। কারণ, সে সব সময়ই থাকতো দৃষ্টির আড়ালে। নিজের মতো করে সময় কাটাতো। কোনো চাকরি বা কাজ ছিল না। তবে শহরের দক্ষিণে প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি ‘গান ক্লাবে’ যেতো, জিমে যেতো। মাঝে মাঝেই বিদেশ সফরে যেতো। সে কিভাবে উগ্রপন্থি বা সন্ত্রাসী হয়ে উঠল তা নিয়ে এক প্রতিবেদনে এসব কথা লিখেছে অনলাইন নিউজিল্যান্ড হেরাল্ড।

এক বছরের বেশি সময় সমারভিলে স্ট্রিটের ডুপ্লেক্স বাড়িতে সে একাকী বসবাস করতো। ১৫ই মার্চ ক্রাইস্টচার্চে আল নূর ও উইনউড মসজিদে হামলা চালিয়ে সে কমপক্ষে ৫০ জন মুসল্লিকে হত্যা করে। নিউজিল্যান্ডে সবচেয়ে ন্যক্কারজনক এই সন্ত্রাসী হামলা। তারপর থেকে তার জীবনকে দেখা হচ্ছে আলাদা করে। তদন্ত চলছে কিভাবে সে এমন উগ্রবাদী, সন্ত্রাসী হয়ে উঠলো।

তার বস্তাব জীবন ছিল ইন্টারনেটভিত্তিক। একজন প্রতিবেশী বলেছেন, আমাদের পাশেই সে ছিল-  এটা ভেবে বুক কাঁপে। এখন প্রতিবারই যখন রান্নাঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই তখন ভাবি, ওই বাড়িতে সে কতগুলো বন্দুক, কি পরিমাণ বোমা লুকিয়ে রেখেছিল? তার এমন কর্মকান্ডের জন্য আমরা নিজেদের অপরাধী মনে করি।

নিজের প্রকাশিত ‘ম্যানিফেস্টো’তে ব্রেনটন নিজেই বলেছে, নিউজিল্যান্ডে থাকার জন্য কেন সে ডুনেদিনকে বেছে নিয়েছে তার কোনো বিশেষ কারণ নেই। সে শুধু চেয়েছিল অস্থায়ীভাবে কোথাও থাকতে এবং নিজের প্রশিক্ষণ নিতে। তাই সে স্থানীয় একটি রাইফেল ক্লাবে যোগ দেয়। নিউজিল্যান্ডের অস্ত্র বিষয়ক আইন ব্যবহার করে অস্ত্র কিনেছে, এই অস্ত্র ব্যবহার করে সে হামলা চালায়। সে বলেছে, এমন হামলা পরিকল্পনা করেছে সে দু’বছর ধরে। বিশেষ করে শেষ তিন মাসে এসে তার পরিকল্পনা চূড়ান্ত আকার ধারণ করে।

২০১০ সালে তার পিতা রোডনি মারা যান। তার পর থেকেই সে বিদেশ ভ্রমণ শুরু করে। এ সময় থেকেই তার মধ্যে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদের প্রতি ঝোঁক সৃষ্টি হয় বলে মনে করা হয়। দম্ভ করতে থাকে অনলাইনে। বলতে থাকে তার কাছে উত্তরাধিকার সূত্রে ৫ লাখ ডলার আছে। বিনিয়োগ করেছে ক্রিপ্টোকারেন্সি বা ডিজিটাল মুদ্রায়। এসব অর্থের কারণে সে কোনো কাজ না করেই দিন কাটাতে পারতো। সে বলেছে, যখন সে ইউরোপে তখনই রাজনৈতিক বিশ্বাসটা তার ভিতর ব্যক্তিগত বিষয় হয়ে উঠতে শুরু করে।

সে ইঙ্গিত করেছে তার দৃষ্টিভঙ্গি প্রভাবিত হয়েছে তিনটি সুনির্দিষ্ট ইভেন্ট থেকে। তার মধ্যে একটি হলো সুইডেনে সন্ত্রাসী হামলায় ১১ বছরের একটি মেয়েকে হত্যা। ২০১৭ সালে ফরাসি নির্বাচনের ফল এবং বিশ্বে যেসব দেশে যুদ্ধ হয়েছে সেখানকার সমাধিক্ষেত্রগুলো দেখে। সে যেসব দেশ ভ্রমণ করেছে তার মধ্যে রয়েছে উত্তর কোরিয়া, পাকিস্তান, তুরস্ক ও গ্রিস। সম্প্রতি সে সফর করেছে বুলগেরিয়া, রোমুানিয়া ও হাঙ্গেরি। প্রথম দিকে তার সফরের ছবি বলতে বানর বা কচ্ছপের ছবি থাকতো। অথবা কোনো ডুবুরির ছবি থাকতো। কিন্তু পরে সেই ধারা পাল্টে যায়। তার সফরে যেসব ছবি প্রাধান্য পায় তার মধ্যে রয়েছে খ্রিস্টান-মুসলিম যুদ্ধের ঐতিহাসিক স্থানগুলোর ছবি।

রিপোর্ট অনুয়ায়ী সে যেসব স্থান সবশেষে সফর করেছে তার মধ্যে রয়েছে মন্টেনেগ্রো। সেখানে ১৮৬০ এর দশকে অটোম্যান সেনাবাহিনী যে আশ্রমে হামলা চালিয়েছিল সেখানে গিয়েছিল সে। ওই স্থানটি রক্ষার জন্য চেষ্টা করেছিলেন যে সার্বিয়ান নেতা, পরে তেমনই একটি অস্ত্র ব্যবহার করেছে সে ক্রাইস্টচার্চে হামলায়। অভিযুক্ত এই সন্ত্রাসী তার ম্যানিফেস্টো ও ফেসবুকে আগের ঘটে যাওয়া কিছু সন্ত্রাসী ঘটনার উল্লেখ করেছে। এতে সে উল্লেখ করেছে নরওয়ের উগ্র ডানপন্থি সন্ত্রাসী অ্যান্ডার্স ব্রেইভিকের নাম। তুলে ধরেছে অসওয়াল্ড মোসলের মতো ঐতিহাসিক ফ্যাসিস্টদের নাম।

কোনোমতে স্কুলের পড়াশোনা শেষ করেছে সে। একজন ব্যক্তিগত প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করতে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে পা রাখে নি। এরপরই সে অনলাইনে বিভিন্ন জিনিস খোঁজা শুরু করে। সে লিখেছে, এর বাইরে আপনি অন্য কোথাও সত্য খুঁজে পাবেন না।
 
তার ম্যানিফেস্টো বিশ্লেষণ করেছেন নিউজিল্যান্ড ইন্সটিটিউট অব সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম সায়েন্সের জয়েন্ট ডিরেক্টর ডেভেন পোলাশচেক। তিনি বলেছেন, সমস্যা হলো টেরেন্ট স্বশিক্ষিত। নিজে নিজে তথ্য বাছাই করেছে। আর সেই তথ্যগুলো যাচাই বাছাই না করে সে ধারণ করেছে। সে দৃশ্যত নরডিক, আর্য্য আদর্শ ধারণ করতো বলে মনে হয়। তার পোস্টগুলোতে ভরা স্বর্ণালী চুলের নারী ও শিশুতে। আর থাকতো দেখতে শক্তিমান পুরুষ। তাকে দেখা যেতো কখনো ঘোড়ার পিছে। প্রথম দিকে তার এসব ম্যাসেজকে দেখে অনেকে কল্পনা করতেন কৌতুক হিসেবে।

পিএইচডি করছেন বেন এলি। তিনি বলেন, অনেক মানুষ এসবই সত্যিকারভাবে বিশ্বাস করে। তাদের মধ্যে এমন আদর্শ কাজ করে যে নরডিক বিষয় হলো ইতিহাসের অংশ। যেমনটা প্রাচীনযুগে পূজা করা হতো। একই রকমভাবে কিছু মানুষ ১৯৫০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রকে একটি আদর্শ হিসেবে দেখতো। তারা ভাইকিংসকে পছন্দ করতো।

ক্রাইস্টচার্চে হামলার পর বিশেষজ্ঞরা ও সাংবাদিকরা সন্ত্রাসী ব্রেনটন টেরেন্টের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ শুরু করেছেন। তারা সেুলোকে ইতিহাসের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করছেন। টেরেন্ট বলেছে, সে একজন ‘ইকো-ফ্যাসিস্ট’। আল নূর মসজিদে হামলার কয়েক মিনিট আগে সে তার বন্ধুদের জন্য (8chan )-এ  পোস্ট দেয়া কিছু সময়ের জন্য স্থগিত করে। (8chan ) হলো একটি অনলাইন ম্যাসেজ বোর্ড। তার প্রোফাইল ছবিতে ছিল একটি কার্টুন। তাতে তার হ্যাটে ব্যবহার করা হয়েছে অস্ট্রেলিয়ান কিছু বিষয়। হাতে ধরা ভিক্টোরিয়া বিটার বিয়ারের বোতল। কৌতুক করে সে লিখেছে, ওকে ল্যাডস, এখন পোস্টিং দেয়া বন্ধের সময়। এখন সময় বাস্তব জীবনধর্মী প্রচেষ্টার পোস্ট। এ সংক্রান্ত আরো কিছু পোস্ট দেয় সে ওই বোর্ডে।

তাৎক্ষণিকভাবে এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় ওই (8chan ) বোর্ডে। বেশির ভাগ ব্যবহারকারী তার সফলতা কামনা করে। এখানেই ফেসবুক লাইভের লিঙ্ক দিয়েছিল সে। কিন্তু অনেকেই ওই লিঙ্কে যেতে অস্বীকৃতি জানায়। কারণ, এতে ব্যবহার করা হচ্ছিল ফেসবুক। অনেকে ত্রস্ত হয়ে পড়ে। তারা মডারেটরদের প্রতি ওই লিঙ্ক ডিলিট করতে অনুরোধ জানায়। তাদের মধ্যে ভয় কাজ করতে থাকে যে, এ কারণে তাদের ফোরামটি বাতিল হয়ে যেতে পারে।

এরপরই শুরু হয় হামলা। 8chan ও ফেসবুক ব্যবহারকারীরা সরাসরি সম্প্রচার করা ভিডিও সেভ করতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। অন্য স্থানে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। ইউটিউব ও ফেসবুক অনুযায়ী, মুহূর্তের মধ্যে ওই ভিডিও হাজার হাজার বার পোস্ট হয়ে যায়। যত তাড়াতাড়ি তা ডিলিট করা যায়, তার চেয়ে বেশি গতিতে এটি ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ইন্টারনেট সেবাদানকারীরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সব ফুটেজ বাতিল করে দিতে বা ব্লক করে দেয়ার চেষ্টা করতে থাকে।

সন্ত্রাসী ব্রেনটন টেরেন্ট এখন বন্দি। তার বিচার চলছে। কিন্তু আদালতেও সে বুক চেতিয়ে দাঁড়িয়েছে প্রথম দফায়। সে চেয়েছে তার দৃষ্টিভঙ্গি ছড়িয়ে দিতে। আদালতে তাকে দেখা গেছে ফিটফাট। মনোবল যেন ভাঙে নি। এমন কি এ সময় কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদের চিহ্ন ফুটিয়ে তোলে হাতে। তাকে গ্রেপ্তারের পর শুরু হয় ব্লেম গেম। কেউ কেউ দায়ী করার চেষ্টা করে তার ‘গান ক্লাব’কে ও এর সদস্যদের। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় উগ্রবাদের বিস্তার ঘটানোর। এর জবাবে ভাইস প্রেসিডেন্ট স্কট উইলয়ামস বলেছেন, সন্ত্রাসী ব্রেনটন যে ক্লাবে ওই অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিতো, তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর