জীবনে এই প্রথম কোন জন্মদিনে আমার মায়ের সঙ্গে কথা হল না। আর কোনদিন হবেও না। আমার মা কোনদিন বলবে না, ‘শুভ জন্মদিন আব্বা, তুমি কেমন আছ?’ আমার মা সব সময় আমাকে ‘আব্বা’ বলে ডাকতেন। আমি ছিলাম মায়ের প্রথম সন্তান। জন্মদিনটা তাই শুধু আমার ছিল না, জন্মদিন ছিল আমার মায়েরও। কারণ আমি জন্ম নিলাম বলেই তো তিনি মা হলেন!
আমার জন্মদিনের মনে রেখেছে খুব কম মানুষই। কোন পত্রিকায় জন্মদিনের খবর আসেনি। ফেসবুকে আমি জানাইনি।
বিস্মরণপ্রিয় মানুষের কাছ থেকে আমি আশা করি নাই কিছু। ফেসবুকের মেমোরিতে জানান দিচ্ছিল, এক সময় আমাকে ঘিরে নানাজনের আবেগের আতিশয্য। তাদের কেউ কেউ পাল্টে গেল রাতারাতি। ইস্টরিভারের তীরে বসে সেই সব ভাবনা বার বার ফিরে আসছিল।
মাত্র চারদিনের সফর শেষ করে বাংলাদেশ থেকে ফিরেছি নিউইয়র্কে। অনেকে জানে না আমি এখন কোথায়? ঢাকা থেকে আম্মার শবদেহ নিয়ে গিয়েছি পিরোজপুরে আমার দাদার বাড়িতে। ওখানে শ্যাওলা ধরা পুকুর ধারে আব্বার কবরের পাশে শুইয়ে এসেছি মাকে। পাশে নদী বলেশ্বর। বহুদিন পরে গিয়েছিলাম পিরোজপুরে। আমার ভাবনায় বলেশ্বর আর ইস্ট রিভার যেন এক হয়ে যায়।
শেষ বিকেলের মনোরম আলো ছড়িয়ে পড়েছে ইস্ট রিভারের দুই পাশে। ওই পাশের পার্ক নির্জন। এই পাশে মানুষের কোলাহল। শেষ বিকেলের আলোয় মাখামাখি হয়ে বসেছিলাম নদীর ধারে। চার পাশে মানুষের ভীড়, কলরব। দূরে শিশুরা পার্কে খেলছে। আবহাওয়া ভালো ছিল মানুষের ভীড় অন্যদিনের চেয়ে বেশী। সবার হৃদয়ে যেন আগত বসন্তের মধুরেন সঙ্গীত। চারপাশের আনন্দিত মানুষের মধ্যে একমাত্র আমিই বসেছিলাম ভাঙ্গা হৃদয় নিয়ে। স্কুলে পরীক্ষার আগের দিন নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে দুঃখী মানুষ মনে হত, পথে-ঘাটে কাউকে দেখলে ভাবতাম, তারা কত সুখী, আমার মতো কেউ না, বিশাল এক ভারী পাথর বসিয়ে দিয়েছে কেউ আমার বুকের ওপর, সেইরকম পাথরচাপা অনুভূতি যেন ফিরে এল বহুকাল পরে।
নদীর ধার ঘেষে থাকা রেলিংয়ের ওপাশে গিয়ে পাথরের ওপরে বসি। আমার মুখ কেউ দেখতে পায় না। প্রবাহমান স্রোতের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। আমি সারা শরীর কাঁপিয়ে কাঁদতে থাকি। মনে হয় এই নদীর সমান কান্না জমে আছে বুকে। প্রবাহমান স্রোত আর সবকিছুর মতো আমাকেও ভাসিয়ে নিয়ে যেতে যায়। দূরে নদীর ওদিকে ট্রাইবোরো ব্রিজের ওপর দিয়ে প্রতি মিনিটে কত শত গাড়ি যায়, কত তাদের ব্যস্ততা, কত ভাষায় তারা কথা বলে! তারা কেউ কোনদিন জানবে না, নদীর তীরে কত আবেগ নিয়ে বসে আছে একজন।
আমি জীবন্মৃত হয়ে কাটাই সারা বেলা । কখনও আয়নার দিকে তাকালে নিজেকে নয় যেন আম্মাকেই দেখতে পাই। অনেক সাধ থাকার পরেও আমেরিকায় আনতে পারিনি তাঁকে, অথচ সকাল বেলায় যখন রোদ এসে ভাসিয়ে দেয় আমার ঘর দোর-জানালা, তখন বাইরে তাকিয়ে দেখি, আমার মা হেঁটে আসছেন, পরনে গোলাপী শাড়ি, মাথায় আধ ঘোমটা, কালো একটা ব্যাগ নিয়ে তিনি আসছেন হাসতে হাসতে। চোখ বন্ধ করলে, চোখ খুললে শুধু আম্মাকে দেখি।
আমার আব্বা-আম্মা দুজনেই খুব প্রগতিশীল মানুষ ছিলেন। এটা তাদের চেষ্টাকৃত ছিল না। ছিল অর্জিত। আর তখন বুঝতামও না তাদের মনের উদারতা। সেই ছোটবেলা থেকে দেখেছি অতি সাদামাটা হলেও আমার জন্মদিন পালন করা হত। কনফেকশনারি থেকে একটা ছোট কেক, বিস্কুট, ক্রিম রোল এসব কিনে আনা হত। সঙ্গে ছিল কলা বা কমলা। বছর জুড়ে আমাদের সব ভাইবোনদের জন্মদিন পালনের উৎসব চলতো। কেক কাটার পাশাপাশি বাসায় মিলাদও দেয়া হত। এমনকি আমি নিউইয়র্কে আসার পরেও প্রতি বছর আম্মা ফোন করে বলতেন, ‘ আব্বা, তোমার জন্য আজকে সন্ধ্যায় মসজিদের হুজুরকে আসতে বলছি। মিলাদ পড়ানো হবে।’ এবার আমার জন্মদিনে কোথাও কিছু হল না।
চারদিকের সমস্ত দুনিয়াদারি পানসে মনে হয়। কেন মানুষ কিসের আশায় বেঁচে থাকে, সেই প্রশ্ন জাগে মনে। জন্ম, তারপর মৃত্যু দীর্ঘকর একটি প্রক্রিয়া, তারমধ্যে মানুষকে কতভাবে সারাক্ষণ প্রমাণ দিয়ে যাওয়া। কত প্রতিযোগিতা, কত হানাহানি, মনকষাকষি- সব কিছু খুব সামান্য আর তুচ্ছ মনে হয়। বেশ কিছুদিন ফেসবুকে কিছু লিখিনা। মাঝেমধ্যে ফেসবুকে অন্যদের পোস্ট দেখি। চারদিকে মানুষের আনন্দ-উৎসব দেখে নিজেকে মনে হয় অন্য জগতের মানুষ। আমি নিজেকে মৃত ভেবে অন্যদের উদযাপন দেখি। আম্মার মতো আমিও হয়ত চলে যেতে পারতাম। তারপর এক মিনিটের জন্যেও বন্ধ থাকতো না কোন কিছু। সবাই আবার হেসে উঠতো। আনন্দে মেতে উঠতো।
আমি চলে যাবার পরেও সব কিছু তেমনই থাকবে। যেমন আম্মা চলে যাবার পরে তাঁর ঘরের খাট, আলমারি, ওয়ার্ডড্রোবের ওপর ওষুধের শিশি-পাউডার, জায়নামাজ-কোরআন শরীফ-ওজিফা সব তেমনই আছে। তেমনি থাকবে আমার সব কিছু। কারো হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হবে না সেসব স্পর্শ করে। এই যে আমি লিখছি, আর ভাবছি, আবার লিখছি, এসব কিছু অতীত ইতিহাস হয়ে যাবে। বাতাসে ছড়িয়ে থাকা আমার দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনবে না কেউ। একা ঘরে আমার হাহাকার মিলিয়ে যাবে হাওয়ায় হাওয়ায়।