কোনো ধরনের নিরাপত্তামূলক সরঞ্জামাদির ব্যবহার ছাড়াই সনাতন পদ্ধতিতে বর্জ্য অপসারণ করায় স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে রংপুর সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন তাদের চর্ম, শ্বাস-প্রশ্বাসের রোগের পাশাপাশি বড় ধরনের রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি সরবরাহ করা হলেও সচেতনতার অভাবে তা ব্যবহারের অভ্যাস গড়ে না উঠা এবং নিরাপত্তার বিষয়টি উপেক্ষা করে কাজ করছে পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা বলছে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ।
রংপুর সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা গেছে, রংপুর সিটি কর্পোরেশনের বাণিজ্যিক এলাকা ও গৃহস্থালি হতে প্রতিদিন প্লাস্টিক, কাচের বোতল, ধাতব বস্তু, কাগজ, ইলেক্ট্রনিক দ্রব্যসহ পচনশীল-অপচনশীল নানা বর্জ্য তৈরি হয়। এছাড়া বিভিন্ন হাসপাতাল-ক্লিনিক হতে আসে বড় ধরনের মেডিকেল বর্জ্য। সিটি কর্পোরেশনের হিসাব মতে প্রতিদিন প্রায় ১০০ থেকে ১১০ টন বর্জ্য তৈরি হয় নগরীতে। এসব বর্জ্য অপসারণের জন্য সিটি কর্পোরেশনের ৬১৭ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী কাজ করে। হাসপাতাল-ক্লিনিক, বাজার, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাড়ি বাড়ি গিয়ে তারা ছোট ছোট ভ্যানে করে বর্জ্য সংগ্রহ করে ডাস্টবিনে ফেলে এবং ডাস্টবিন থেকে বর্জ্য অপসারণে ২৬ গাড়িতে লোড-আনলোডের কাজ করা হয়। পরিচ্ছন্নতায় দলিতদের মধ্যে একটি বড় অংশ কাজ করে।
বর্জ্য অপসারণে হাতে গ্লাভস্, পায়ে গামবুট, মাস্ক এবং নির্ধারিত পোশাক পরে কাজ করার কথা থাকলেও তারা হাত দিয়ে বর্জ্য অপসারণ করছেন। নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা না নেয়ায় তাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি দিন দিন বেড়েই চলেছে। বর্জ্য অপসারণের কাজ করতে গিয়ে হাত-পা কেটে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে প্রায়ই। সর্দি-কাশি, জ্বর, গায়ে ব্যথা, পেটের ব্যথা, গ্যাস্ট্রিক, চর্মরোগ, শ্বাস-প্রশ্বাসের রোগে পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের অনেকেই ভুগছেন। সমাজের নিম্ন শ্রেণির মানুষ হওয়া ও অসচেতনতার কারণে সঠিক সময়ে তারা সুচিকিৎসা নেন না। এতে করে রোগের মাত্রা বেশি হলে চিকিৎসকের কাছে শরণাপন্ন হলেও অর্থের অভাবে তাদের চিকিৎসা বেশি দূর এগোয় না। এছাড়া এইসব পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের বেশিরভাগই সিটি কর্পোরেশনের নিয়োগপ্রাপ্ত পরিচ্ছন্নতা কর্মী নন, কাজের বিনিময়ে মজুরির ভিত্তিতে এ কাজ করেন তারা। পরিচ্ছন্নতা কর্মী হরিজন সম্প্রদায়ের শ্রী সুমন (২৬) বলেন, জ্বর, মাথাব্যথা, সর্দি, শ্বাসকষ্ট তো লেগেই থাকে আমাদের। সিটি কর্পোরেশন থেকে গামবুট ও গ্লাভস দেয়া হয়েছিল। আমরা দীর্ঘদিন ধরে কোনো নিরাপত্তামূলক সরঞ্জামাদি ছাড়াই আবর্জনা পরিস্কার করে আসছি। তাই এসব আমাদের লাগে না।
পরিচ্ছন্নতা কর্মী আমজাদ হোসেন (৫৬) বলেন, বর্জ্য অপসারণ করতে গিয়ে অনেক সময় কাচে পা কেটে যায়। তখন সিটি কর্পোরেশন থেকে আমরা প্রতিষেধকমূলক টিকা নিয়ে থাকি। সারা বছরের বেশিরভাগ সময় বিভিন্ন রোগে ভুগতে হয়। যে কাজটি করি সেই তুলনায় আমাদের বেতন কম। আগে আড়াই হাজার ছিল, এই মেয়র এসে সাড়ে তিন হাজার বেতন করে দিয়েছে। কিন্তু সেটি দিয়ে আমাদের সংসার চলে না। নগরকে পরিচ্ছন্ন রাখার কাজ করি, আমরা অনেক অবহেলিত।
পরিচ্ছন্নতা বিভাগের প্রধান মো. শাহিনুর রহমান শাহীন বলেন, ডেঞ্জার পয়েন্টে গুলো বাধ্যতামূলক নিরাপত্তামূলক সরঞ্জামাদি পরার বিধান চালু করেছি। সেই অনুযায়ী তারা পরিচ্ছন্নতার কাজ করে। পরিচ্ছন্নতা বিভাগে হরিজন সম্প্রদায়ের যারা রয়েছে তাদের কাজের প্রতি অনেক অনীহা। নিরাপত্তা সরঞ্জমাদি তাদের দেয়া হলেও তার এপ্রোনই পরতে চায় না। তাদের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টিতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এছাড়া প্রতিটি পরিচ্ছন্নতার কাজে নিয়োজিত গাড়িগুলোতে আমরা গজ ব্যান্ডেজ, ডেটলসহ অন্যান্য প্রাথমিক চিকিৎসার প্রয়োজনীয় পথ্য সরবরাহ করার কাজ চলছে। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. সারোয়ার হোসেন বলেন, পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা মেডিকেল বর্জ্যের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য অপসারণের কাজ করে। তাদের হেপাটাইটিস বি ভাইরাস, টিটেনাস, এইচআইভি ভাইরাস, পানিবাহিত রোগ, চর্মরোগ হতে পারে। এছাড়া নাক-মুখ সুরক্ষিত না থাকায় নিঃশ্বাসের সঙ্গে দেহের ভেতরে ঢুকছে মারাত্মক সব জীবাণু। প্রতিদিন ধুলা ঢুকে শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা হতে পারে। এ ব্যাপারে রংপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের নিরাপত্তামূলক সরঞ্জমাদি সরবরাহ করা হয়েছে। কিভাবে সেগুলো ব্যবহার করবে, কেন ব্যবহার করবে, তাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয়গুলো জানিয়ে তাদের মাঝে মাস্ক, গ্লাভস, গামবুট সরবরাহ করা হয়েছে। সচেতনতার অভাবে তারা এসব ব্যবহার না করেই বর্জ্য অপসারণ করছে। শতভাগ পরিচ্ছন্নতাকর্মী যেন নিরাপত্তামূলক সরঞ্জমাদি ব্যবহার করেই বর্জ্য অপসারণ করে সেদিকে সিটি কর্পোরেশনের বিশেষ নজরদারি রয়েছে। যেহেত নিরাপত্তামূলক সরঞ্জামাদি ছাড়াই কাজ করার অভ্যাস দীর্ঘদিনের। তাই তাদের সরঞ্জামাদি ব্যবহারে অভ্যস্ত করতে একটু সময় লাগবে।