ভৌগোলিক অবস্থান ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নানা দুর্বলতার কারণে স্বর্ণ চোরাচালানের নিরাপদ রুট হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। আকাশ পথে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও ঢাকা শাহ জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে প্রায়ই আসছে স্বর্ণের চোরাচালান।
যার মধ্যে কিঞ্চিত ধরা পড়ছে শুল্ক ও গোয়েন্দা সংস্থার হাতে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই, আবুধাবী, শারজাহ, মাস্কাটের ওমান, সৌদি আরবের জেদ্দা ও কাতার থেকে বাংলাদেশের দুই বিমানবন্দর দিয়ে আসছে স্বর্ণের চোরাচালান। ফলে এসব দেশ থেকে আসা বিমানগুলোর প্রতি নজরদারি ছিল শুল্ক ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনের।
কিন্তু গত রোববার হঠাৎ করে ব্যাংকক থেকে আসা বেসরকারি বিমান সংস্থা রিজেন্ট এয়ারের একটি ফ্লাইটের এক যাত্রীর কাছ থেকে প্রায় চার কোটি টাকার স্বর্ণের একটি চালান ধরা পড়ে। যাকে স্বর্ণ চোরাচালানের কৌশল বদলে ফেলার ইঙ্গিত বলে মনে করছেন শুল্ক ও গোয়েন্দা কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক।
তিনি বলেন, এজন্য শুধু মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা ফ্লাইটই নয়, শাহ আমানত বিমানবন্দরে অবতরণকারী সব ফ্লাইটের ব্যাপারে সর্বোচ্চ নজরদারি রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
শুল্ক ও গোয়েন্দা কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক জানান, গত কয়েক বছর ধরে কোটি কোটি টাকার স্বর্ণ আসছে দেশে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন ফ্লাইটে এসব স্বর্ণের চালান আসার ঘটনা ধরা পড়েছে। বিভিন্ন সময় মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা যাত্রীর কাছ থেকে যেমন স্বর্ণের চালান পাওয়া গেছে তেমনি এসব ফ্লাইটে পরিত্যক্ত অবস্থায়ও বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ পাওয়া গেছে। গত বছর দেড়েকের মধ্যে অন্তত একশ’ কোটি টাকা দামের দুইশ’ কেজিরও বেশি স্বর্ণ আটক করা হয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে দুবাই, আবুধাবী, শারজাহ কিংবা সৌদি আরব থেকে আনা স্বর্ণের চালানের সঙ্গে জড়িত চোরাচালানিদের চুনোপুটিরা ধরা পড়লেও রাঘব বোয়ালরা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। দিনের পর দিন স্বর্ণ চোরাচালান হলেও এসবের সঙ্গে কারা জড়িত, এত স্বর্ণ কোত্থেকে কেন আনা হচ্ছে, এগুলো যাচ্ছে কোথায় তার কোনো কুল কিনারা করা সম্ভব হয়নি।
তিনি বলেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে আসা যাত্রীদের ব্যাপারে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বাড়তি সতর্কতা গ্রহণ করা হয়। সবসময় কঠোর নজরদারিতে রাখা হয় এসব ফ্লাইট এবং যাত্রীদের। এতে একের পর এক চালান ধরা পড়ার ঘটনা ঘটে। কাস্টমস এবং বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের কড়া নজরদারির কারণে চোরাচালানিরা রুট পরিবর্তন করে চট্টগ্রামে স্বর্ণ আনছে।
গত রোববার ব্যাংকক থেকে আসা রিজেন্ট এয়ারের একটি ফ্লাইটের এক যাত্রীর কাছ থেকে প্রায় সাড়ে এগার কেজি স্বর্ণ উদ্ধারের পর নয়া এই রুট নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।
তিনি জানান, শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চার কোটি টাকা মূল্যের ১১ কেজি স্বর্ণের বারসহ ব্যাংকক ফেরত এক যাত্রীকে আটক করেছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। মোহাম্মদ শাহজাহান নামের ওই যাত্রীর ব্লেজারের ভেতরে ৯৬টি স্বর্ণের বার লুকানো ছিল। তার গতিবিধি সন্দেহজনক হওয়ায় তল্লাশি করে উক্ত স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়। বারগুলোর ওজন ১১ কেজি ২৫০ গ্রাম। আটককৃত স্বর্ণের বাজার দর চার কোটি টাকা। শাহজাহান একজন প্লাম্বার মিস্ত্রি। তার বাড়ি সাতকানিয়ায়।
শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ম্যানেজার উইং কমান্ডার এবিএম সারোয়ার ই জামান বলেন, রোববার বিকাল পৌনে ৫টার দিকে রিজেন্ট এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইট ব্যাংকক থেকে চট্টগ্রামে পৌঁছে। ওই ফ্লাইটের যাত্রী হিসেবে মোহাম্মদ শাহজাহান চট্টগ্রাম পৌঁছে। তীব্র গরমের মাঝে তার গায়ে ব্লেজার ছিল। বিমানবন্দরে নামার পর থেকে তার গতিবিধি বেশ সন্দেহজনক ঠেকে শুল্ক বিভাগের লোকজনের কাছে।
চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজের উপ-কমিশনার নূর উদ্দিন মিলন বলেন, সংঘবদ্ধ চক্র এই স্বর্ণের চালানটি শাহজাহানকে দিয়ে আনার ব্যবস্থা করে। তার কাছে দুবাইয়ের রেসিডেন্ট কার্ডও রয়েছে। মাস দেড়েক আগে তিনি দুবাই থেকে থাইল্যান্ড যান এবং ওখানে প্লাম্বারের কাজ করতে থাকেন। ব্যাংকক বিমানবন্দরে রিজেন্ট এয়ারের ফ্লাইটে ওঠার আগে তাকে এক ব্যক্তি বারগুলো দিয়ে চট্টগ্রামে এক ব্যক্তিকে পৌঁছে দেয়ার জন্য দেয়। চট্টগ্রামে ওই ব্যক্তি শাহজাহানের সঙ্গে যোগাযোগ করার কথা ছিল বলেও কাস্টমস কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন তিনি।
তিনি জানান, শাহজাহান চট্টগ্রামে নামার পর একটি রবি নম্বর থেকে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু শাহজাহান ধরা পড়ার বিষয়টি বুঝতে পেরে ওই ব্যক্তি ফোনটি বন্ধ করে দেয়। তার মোবাইল নম্বরটি পুলিশকে দেয়া হয়েছে। ওই মোবাইল ফোনের সূত্র ধরে চোরাচালানি চক্রের হোতারা ধরা পড়তে পারে।
কাস্টমস কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আটক শাহজাহান গত ফেব্রুয়ারি মাসেও শাহ আমানত বিমানবন্দরে মোবাইল ফোন সেট, ক্রিম ও সিগারেটসহ ধরা পড়েছিল। বিদেশে থাকলেও প্রায়ই সে বাংলাদেশে আসা-যাওয়া করার প্রমাণ রয়েছে তার পাসপোর্টে। শাহজাহানকে পতেঙ্গা থানায় সোপর্দ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে একটি মামলা করা হয়েছে।