ব্রিস্টলের মাঠে প্রবেশ করতেই শুরু হলো ভীষণ বৃষ্টি। একটু দৌড়ে ছাউনি খুঁজতেই কেউ একজন বলে উঠলেন, ‘ঐদিকে যান।’ নারী কণ্ঠের দিক নিদের্শনা শুনে চমকেই উঠতে হলো। পিছন ফিরে তাকাতেই দেখা গেল মাঠে নিরাপত্তাকর্মীর দায়িত্ব পালন করা নারী স্পষ্ট বাংলাতেই কথা বলছেন। এমন ঘটনা ওভাল স্টেডিয়ামেও ঘটেছে। তাই খোঁজখবর নেয়া শুরু সেখান থেকেই। কিছুটা বৃষ্টি কমতেই এগিয়ে গেলাম সেই নারী নিরাপত্তাকর্মীর দিকে। তিনি হেসে বলেন, ‘আমি বাংলাদেশের, ঢাকায় আমার বাসা। আমার নাম রুবিনা ইয়াসমিন।
আমরা এখানে প্রাইভেট নিরাপত্তা বাহিনীতে কাজ করি। আমাদের অনেকেই আছে এবার স্টেডিয়ামের নিরাপত্তার কাজে। কম হলেও এবার ৩০ জনের মতো বাংলাদেশি আছি যারা এখানে কাজ করছে। আমাদের সৌভাগ্য যে এখানে বাংলাদেশের খেলা দেখতে পারার সুযোগ হয়েছে। দলকে সমর্থন করার সুযোগ হয়েছে। শুধু তাই না, এখানে আসা বাংলাদেশি দর্শক ও ক্রিকেটারদের নিরাপত্তা দিতে পেরে বেশ গর্বিত।’
নারী নিরাপাত্তাকর্মীর সঙ্গে আলাপ শেষে লিফটে ব্রিস্টল কাউন্টি ক্রিকেট স্টেডিয়ামের প্রেসবক্সে উঠতেই ফের চমকাতে হলো। লিফটের সামনে বসে থাকা নিরাপত্তাকর্মী বলে উঠলেন কেমন আছেন ভাই? হেসে বললেন, ‘আপনার সঙ্গে আমার ওভাল স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের শেষ খেলার দিন দেখা হয়েছিল। সেদিন কথা বলতে পারিনি। আমার নাম আবদুল হাকিম অপু। ইতালিতে ছিলাম ১৬ বছর। আর ৪ বছর ধরে লন্ডনে আছি। এখানে নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কাজ করছি। এখানে আমি ছাড়াও আরো ১০ জন বাংলাদেশি আছেন যারা রয়েছেন নিরাপত্তার দায়িত্বে।’
হঠাৎ করেই ইংল্যান্ডে ক্রিকেট বিশ্বকাপে কেন এত বাংলাদেশি এই প্রশ্ন খুব স্বাভাবিকভাবেই আসবে আপনার মনে! আমার মনেও এসেছে। ভাবতে পারেন বাংলাদেশ খেলছে বলেই তাদের নিয়োগ। আসলে সেটি নয়, বৃটেনে পুলিশের বেশ অভাব। যারা আছেন তারা রাষ্ট্রীয় ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিয়েই বেশি ব্যস্ত। মূলত পুলিশ সদস্যের স্বল্পতার কারণে এখানে বিভিন্ন দেশ থেকে নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে জায়গা পেয়েছেন অনেকে। কীভাবে এখানে নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে আসা তা নিয়ে অপু বলেন, ‘আসলে এখানে পুলিশের ভীষণ অভাব। এখানে পুলিশ যারা আছে তারা দেশের নিরাপত্তায় বেশি ব্যস্ত। আর খেলা হলে তারা তেমন একটা মাঠে থাকে না। যারা থাকে তারাও সাদা পোশাকে কিংবা মাঠের বাইরে।’ প্রশ্ন আসতে পারে তাহলে এত বড় বিশ্বকাপের নিরাপত্তা কিভাবে দিচ্ছে ব্রিটেনের সরকার! অপু বলেন, ‘পুলিশ কম হলেও গোটা ব্রিটেনের নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ হয় সিসি টিভি ক্যামেরার মাধ্যমে। এখানে রাস্তায় চলা মানুষ থেকে গাড়ি সবই থাকে তাদের ক্যামেরার নজরে। জরুরি কিছু না হলে পুলিশ সশরীরে আসে না।’
বাংলাদেশ দলের নিরাপত্তা নিয়ে বিশ্বকাপের আগে বেশ তোড়জোড় করেছে বিসিবি। বিশেষ করে নিউজিল্যান্ডের ঘটনার পর। কিন্তু ইংল্যান্ড ও ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ড তা দিতে অপারগতা জানিয়েছে। এ নিয়ে বেশ অসন্তুষ্ট বিশ্বকাপে নিয়োজিত বাংলাদেশের নিরাপত্তাকর্মীরা। নিরাপত্তাকর্মী খাইরুল আলম রানা বলেন, ‘আসলে ইচ্ছা করলে বাংলাদেশ দলের সঙ্গে পুলিশ দিতে পারতো। আসলে বিষয়টি আমাদের ভালো লাগেনি। কারণ এখানে যেভাবে মাঠ থেকে বাংলাদেশ দল আসে তাতে নিরাপত্তার ফাঁক ফোকর থেকেই যাচ্ছে। আমি মনে করি নিউজিল্যান্ডের ঘটনার পর আমাদের ক্রিকেটারদের নিরাপত্তা বাড়ানো উচিত ছিল।’
অন্যদিকে বৃটেনে প্রাইভেট নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কাজ করা ভীষণ কঠিন বলেই জানালেন রুবিনা ইয়াসমিন। তিনি বলেন, ‘আসলে এখানে যেকোনো কাজ অনেক কঠিন। তবে অন্যদের চেয়ে বেশি কঠিন এখানে যারা প্রাইভেট নিরাপত্তার কাজ করে। বিশেষ করে আমাদের তারা বাছাই করে ট্রেনিং দেন। কীভাবে নিরাপত্তার কাজ করতে হবে। এরপর ক্রিকেট, ফুটবল খেলা, কনসার্ট, কাউন্সিলসহ নানা স্থানে আমাদের নিরাপত্তার কাজে পাঠানো হয়। সবচেয়ে কষ্ট হলো ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকা। এখানে যারা আমরা মাঠের দায়িত্ব পালন করছি তাদের সকাল ৮টা থেকে ম্যাচ শেষ হওয়ার এক ঘণ্টা পর পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। অনেক জায়গাতে তো এক মিনিটও বসার সুযোগ হয় না।’
এত কষ্টের পরও তারা কেন নিরাপত্তাকর্মীর কাজ করছেন তা নিয়ে প্রশ্ন আসতেই পারে। কারণটা জানিয়ে দিলেন রুবিনা ও অপু। তারা বলেন, ‘দেখেন বাংলাদেশে সন্তানের শিক্ষার কোনো নিরাপত্তা নেই। এখানে আমাদের ছেলেমেয়েরা স্কুল কলেজ পর্যন্ত ফ্রি পড়ালেখা করছে। তাদের চাকরির নিশ্চয়তা আছে। আমাদের ছেলেমেয়েরা এখানে স্কুল ও ইউনিভার্সিটিতে পড়ে- কোনো টিউটর রাখতে হয় না। তাদের পিঠে বইয়ের বোঝা বয়ে নিতে হয় না। মনের আনন্দেই শিক্ষিত হচ্ছে ওরা। এছাড়াও এখানে চিকিৎসা সেবাতো অসাধারণ।’