বৈরী আবহাওয়ায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের আমদানি-রপ্তানি। ৬ দিনের টানা বর্ষণে সাগর উত্তাল থাকায় বন্দরের বহির্নোঙরে বড় জাহাজ থেকে পণ্য খালাস কার্যত বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া জলজট ও যানজটে পণ্য পরিবহনেও সৃষ্টি হয়েছে অচলাবস্থা।
ফলে, কনটেইনার জটের পাশাপাশি জেটিতেও জাহাজ জট তৈরি হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে এ পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারলে
ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে আমদানি-রপ্তানিকারকেরা। যার প্রভাব পড়বে বাজারেও। এমন মত ব্যবসায়ীদের।
বন্দরের কর্মকর্তারাও বলছেন, বৈরী আবহাওয়ায় বহির্নোঙরে বড় জাহাজ থেকে পণ্য খালাস বন্ধ রয়েছে ঠিকই।
কিন্তু এর চেয়েও মারাত্মক সংকটে ফেলেছে বন্দরের পণ্যবাহী সড়কে জলজট ও যানজট। এ কারণে বন্দর থেকে ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান-লরি স্বাভাবিক গতিতে বের হতেও পারছে না, প্রবেশেও ব্যাঘাত ঘটছে। ফলে ইয়ার্ড থেকে পণ্য খালাস স্থবির হয়ে পড়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের চিফ পার্সোনাল অফিসার মো. নাসির উদ্দিন এ প্রসঙ্গে বলেন, টানা বর্ষণে চট্টগ্রাম বন্দরে কিছুটা প্রভাব পড়েছে। দিনে প্রায় ৫ হাজার ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান বন্দরে ঢোকে আর বের হয়। কিন্তু চলমান সংকটের কারণে সেটা অনেক কমে গেছে। পণ্য খালাস স্বাভাবিক না থাকলে বন্দরে তো প্রভাব পড়বেই।
ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের সদস্য (অপারেশন) জাহাঙ্গীর আলম দোভাষ বলেন, সাগরে লাইটারেজ জাহাজ তো যেতেই পারছে না। গেলেও হ্যাজ খুলতে না পারায় পণ্য খালাস তো হবে না। শুধু লোহার পাত ছাড়া আর কিছু খালাসের সুযোগ নেই। খালাস হলেও ঘাটে এসে সেগুলো নামানো যাচ্ছে না। আমরা বড় ধরনের ক্ষতির মধ্যে পড়ে গেছি। আমাদের প্রায় ৪০০ জাহাজ এখন অলস বসে আছে।
সূত্র জানায়, গত ৪ঠা জুলাই থেকে চট্টগ্রামে বৃষ্টিপাত শুরু হয়। ৭ই জুলাই রাত থেকে তা টানা বর্ষণে রূপ নেয়। থেমে থেমে বর্ষণ এখনো অব্যাহত আছে। পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে, গত ৮ই জুলাই চট্টগ্রামে ২৫৯ মিলিমিটার, ৯ই জুলাই ৬৭ মিলিমিটার, ১০ই জুলাই ১৪৬ মিলিমিটার এবং বৃহস্পতিবার ১০৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়।
সেই সঙ্গে সাগর উত্তাল থাকায় চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে গত ৭ই জুলাই থেকে বড় জাহাজের পণ্য খালাস বন্ধ আছে। ১৯০ মিটারের বেশি লম্বা জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে ভিড়তে পারে না। লাইটারেজ জাহাজ পাঠিয়ে পণ্য খালাস করে কর্ণফুলী নদীর ঘাটে অথবা নৌপথে দেশের বিভিন্ন ঘাটে গিয়ে সেই পণ্য খালাস করা হয়।
ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের কর্মকর্তারা জানান, বন্দরের বহির্নোঙরে গত শনিবার থেকে পাঁচদিনে পণ্য খালাসের কাজ হয়েছে মাত্র ২৫টি জাহাজে। স্বাভাবিক নিয়মে প্রতিদিন বহির্নোঙরে ৪৫ থেকে ৫০টি জাহাজ থেকে একযোগে পণ্য খালাস চলে। এ অবস্থায় বন্দরে ৭৯টি বড় জাহাজ পণ্য খালাসের অপেক্ষায় বসে আছে। বৃহস্পতিবার সকালে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কিছুটা কমলে ২৬টি জাহাজ থেকে খালাস শুরু হয়। কিন্তু বেলা গড়াতেই আবারো বৃষ্টি শুরু হলে বন্ধ হয়ে যায় খালাস।
বন্দরের তথ্যমতে, ৭ই জুলাই বহির্নোঙরে জাহাজ ছিল ৬৮টি, কাজ হয়েছে ৫টিতে। ৮ই জুলাই ছিল ৬৮টি, কাজ হয়েছে ২টিতে। ৯ই জুলাই ছিল ৭৪টি, কাজ হয়েছে ৭টিতে। ১০ই জুলাই ছিল ৭৫টি, কাজ হয়েছে ১২টিতে। ১১ই জুলাই ছিল ৯৭টি কাজ হয়েছে ২৬টিতে। বন্দরের বিভিন্ন ইয়ার্ডে কনটেইনার আছে ৪৪ হাজার ৪৪৭টি। বন্দরের ইয়ার্ডে কনটেইনার রাখার ধারণক্ষমতা ৪৯ হাজার ১৮টি। বহির্নোঙরের মতো সড়কে ভয়াবহ যানজটই বন্দরের অভ্যন্তরেও সংকট তৈরি করেছে।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (ট্রাফিক-বন্দর) তারেক আহম্মদ জানান, গত ৮ই জুলাই সকাল থেকে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাওয়ার দুটি সড়কে কার্যত অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে একটি সিমেন্ট ক্রসিং থেকে রুবি সিমেন্টের দিকে, আরেকটি কাটগড়-পতেঙ্গা হয়ে বিমানবন্দর। রুবি সিমেন্টের সামনের সড়কে পানি জমে থাকায় স্বাভাবিক গতিতে গাড়ি চালানো যাচ্ছে না। কাটগড় সড়কটিতে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের কাজ চলছে। সড়কটির প্রায় ৮ কিলোমিটার অংশে বড় বড় গর্ত তৈরি হয়েছে। সেসব গর্তের ওপর পানি জমে আছে। সেই সড়ক দিয়েও ছোট যানবাহন চলাচল প্রায় বন্ধ আছে। বড় বড় গাড়িগুলোও স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারছে না। এর ফলে, ভয়াবহ যানজট তৈরি হয়েছে আশপাশের সড়কগুলোতে। চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে যানবাহন প্রবেশের ফটকও যানজটে প্রায় অবরুদ্ধ। বিমানবন্দর সড়কের এই যানজট কাস্টমস মোড়, আগ্রাবাদ, চৌমুহনী, টাইগারপাস পেরিয়ে ওয়াসা-জিইসি মোড় পর্যন্ত ১০ কিলোমিটারে পৌঁছেছে।
শিপিং এজেন্ট এসোসিয়েশনের সভাপতি আহসানুল হক চৌধুরী বলেন, টানা বর্ষণে বন্দরে মারাত্মক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। জাহাজ থেকে যে কনটেইনার দুইদিনে নামানো সম্ভব সেগুলো দ্বিগুণ সময় লাগছে। ইয়ার্ড থেকে কনটেইনার ডেলিভারি দেয়া যাচ্ছে না। কারণ, সেখানে অনেক গাড়ি। যানজটের কারণে সেগুলো বের হতে পারছে না। এতে কনটেইনার জট তৈরি হচ্ছে।
আবার অফডক থেকে রপ্তানি কনটেইনারগুলোও যানজটের কারণে বন্দরে ঠিকভাবে আসতে পারছে না। এতে কনটেইনার ফেলেই জাহাজকে চলে যেতে হচ্ছে। আমরা দুইদিক থেকেই সমস্যায় পড়েছি। একদিকে জাহাজের ওয়েটিং টাইম ও চার্জ বাড়ছে। আবার কনটেইনার লোড করতে না পেরে জাহাজ চলে যাচ্ছে।