ফ্লাশ ফ্লাড বা বিজলি বন্যা। ধলাই নদী তীরের বাসিন্দাদের আতঙ্ক। প্রতিবছরই বর্ষা মৌসুমে এই আতঙ্কে তাদের রাত দিন একাকার। ওখানে কিংবা উজানে বৃষ্টি হলেই কাটে নির্ঘুম রাত। দিনের শুরুতে বাঁধ ভেঙে দেখা দেয় ভয়াবহ বন্যা। দিন শেষে শান্ত নদী ঠিক আগের মতই। মধ্যখানের ভয়ার্ত রূপ। চোখের পলকে সবই শেষ।
আকস্মিক নদীর পানি উপচে উঠে ঘরবাড়ি, কৃষিক্ষেত, মৎস্য খামার, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, হাটবাজার ডুবিয়ে দেয়। কেড়ে নেয় সব। নিঃস্ব হয় নদী তীরের বাসিন্দারা। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ধলাই নদী এমনি করে তার ভয়ার্ত হিংস্র রূপ দেখাচ্ছে। আর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন নদী তীরের লক্ষাধিক মানুষ। কিন্তু নদী শাসনের ওই অবস্থা থেকে উত্তরণের নেই কোনো স্থায়ী সমাধান। ধলাই নদীর তীরবর্তী ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দারা জানান, স্থানীয় অন্যান্য নদী থেকে ধলাই নদীর বৈশিষ্ট্য স্বতন্ত্র। প্রতিবছরই নদী তীরের কোথাও না কোথাও তার এই অগ্নিমূর্তি দেখাবেই। কারণ দীর্ঘদিন থেকে নদীর নাব্যহ্রাস। আর ভরাট হওয়া নদীর দু’পারের বাঁধও জরাজীর্ণ। দুর্ভোগগ্রস্তদের অভিযোগ চরম ঝুঁকিপূর্ণ দু’একটি স্থানে মেরামত হলেও হয় না অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধের মেরামত।
নদী তীরের বাসিন্দারা ধলাই নদীর এমন বন্যার নাম দিয়েছেন ‘ঝলক বা বিজলি বন্যা’। কারণ আকস্মিক ও ক্ষণস্থায়ী বন্যা ভয়ার্ত রূপ দেখায় মাত্র হাতেগোনা কয়েক ঘণ্টা। এই কয়েক ঘণ্টার তাণ্ডবেই সব গ্রাস করে রাক্ষুসে নদী। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর অফিসের তথ্যমতে জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সবজি চাষ হয় কমলগঞ্জ উপজেলার ধলাই নদীর তীরবর্তী এলাকায়। কিন্তু সবজি চাষের ঐতিহ্যবাহী উপজেলাটি শুধুমাত্র ধলাই নদী ভরাট ও বাঁধ মেরামত না হওয়ায় তাদের সেই সুনাম ও ঐতিহ্য এখন হারাতে বসেছে। গতকাল সকালে ধলাই নদীর রামপাশা এলাকায় গেলে বিজলি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত নদী তীরের বাসিন্দারা তাদের নানা ক্ষোভ ও দুঃখের কথা জানান। শুক্রবার মধ্যরাতে হঠাৎ বন্যায় কমলগঞ্জ পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ডের রামপাশা এলাকায় বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় নারায়ণপুর, রামপুর, কুমড়াকাপন, চৈতন্যগঞ্জ, বালিগাঁও আংশিক, কান্দিগাঁও, বনগাঁও, গণ্ডামারা গ্রাম।
এতে ওই এলাকার ঘরবাড়ি, কৃষিক্ষেত, মৎস্য খামার, আমন ধানের বীজতলা প্লাবিত হয়। ভাঙন দেয়া বাঁধের পাশে নকুল মালাকার, নিখিল মালাকার, জগিন্দ্র মালাকারসহ পাঁচ পরিবারের বসতঘর ভেঙে পানিতে তলিয়ে যায়। রামপাশার নিপুনাথ বলেন, গতকাল রাতেই দুবাই থেকে দেশে ফিরেছি। বাড়িতে এসেই বন্যার কবলে পড়ি। রাতে বাড়ি আর সড়কে কোমর পানি থাকলে এখন কমেছে। কিন্তু বন্যায় জলাবদ্ধতা না হলেও আমাদের ক্ষতি যা হবার তাতো হয়েই গেছে। হঠাৎ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত নির্মলপাল চৌধুরী, গোলাম নবী, পদন্য পাল, নিখিল মালাকার, নমিতা রাণী পাল জানান, রাতে হঠাৎ বাঁধ ভেঙে নদীর পানি প্রবেশ করে আমাদের রান্নাঘর, বসতভিটাসহ বাড়িঘর ডুবিয়ে দেয়। এখন বানের পানি অনেকটা কমে গেলেও আমাদের চরম দুর্ভোগে ফেলেছে। তারা অভিযোগ করে বলেন, প্রতিবছরই আমরা এরকম দুর্ভোগ আর ক্ষতিগ্রস্ত হলেও নদী শাসনের স্থায়ী কোনো উদ্যোগই নেই কর্তৃপক্ষের। টুকটাক যে মেরামত করা হয় তা বর্ষা মৌসুমে হওয়ায় কোনো উপকারে আসে না। তারা বলেন, নদী আমাদের সব নিয়ে গেছে। এখন কোনো রকম মাথাগুঁজার ঠাঁইটা টিকে আছে। দ্রুত ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ মেরামত না করলে তাদের বাড়িঘরও নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। এখন ওই ভাঙন দিয়ে পানি বের না হলে বা বন্যা কমে গেলেও রামপাশা এলাকার প্রায় ১২-১৫শ’ ফুট নদীর বাঁধ রয়েছে চরম ঝুঁকিতে।
কমলগঞ্জ পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রাসেল মতলিব তরফদার ও সংরক্ষিত ওয়ার্ডের মহিলা কাউন্সিলর শিউলি আক্তার শাপলা জানান, ধলাই নদীর বন্যা এই আছে এই নাই। আকস্মিক বন্যার হাত থেকে রক্ষায় দ্রুত ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ মেরামতের প্রয়োজন। তারা জানান, ওই ভাঙন এলাকায় ২৪০ ও ৭২ মিটার স্থানে বাঁধ মেরামতের কাজ চলছে। স্থানীয় জনগণের সঙ্গে একাত্ম হয়ে আমাদেরও দাবি মেরামত কাজ যেন শুষ্ক মৌসুমেই হয়। পৌরসভার ৮নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আনোয়ার হোসেন জানান, রামপাশা ছাড়াও পৌর এলাকার ৬নং ওয়ার্ডের আইডিয়াল স্কুলের পাশ ও ৮নং ওয়ার্ডের পুরাতন মসজিদের পাশের নদীর বাঁধ চরম ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি বলেন, বর্ষা মৌসুমে নদীর বাঁধ আমরাও বাঁধি ও ওরাও বাঁধে। কিন্তু কোনো কাজে আসে না। পানি উন্নয়ন বোর্ড মৌলভীবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী রণেন্দ্র শংকর চক্রবর্ত্তী মানবজমিনকে জানান, ধলাই নদীর ৫৭ কিলোমিটার স্থায়ী নদী শাসনের পরিকল্পনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এখন নকশা প্রণয়নের কাজ চলছে। নকশা প্রণয়নের কাজ শেষ হলে প্রকল্প প্রণয়ন হবে। যেখানে ভূমি অধিগ্রহণের জন্য আলাদা বরাদ্দ থাকবে। তিনি জানান, এখন অস্থায়ী ভিত্তিতে দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ মেরামত করা হবে।