ফেনীর আলোচিত মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির আলিম পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়েছে। গতকাল প্রকাশিত মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের আলিম পরীক্ষার ফলাফলে ‘কোরআন মাজিদ, হাদিস ও উসুলে হাদিস’ পরীক্ষায় নুসরাত জাহান রাফি ‘এ’ গ্রেড পেয়েছে। ওই পরীক্ষা দুটি দেয়ার পর পরবর্তী পরীক্ষা দিতে মাদ্রাসা কেন্দ্রে গেলে দুর্বৃত্তের দেয়া আগুনে দগ্ধ হয়। এতে নুসরাত মারা যাওয়ায় তার আর পরীক্ষা দেয়া হয়নি।
গতকাল সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসায় পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর হৃদয়বিদারক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। নুসরাতের সহপাঠী, শিক্ষক ও স্বজনরা শোকে বিহ্বল হয়ে পড়ে। পরীক্ষার ফলাফল জানতে আসা শিক্ষার্থীরা নুসরাতের জন্য কান্নায় ভেঙে পড়েন। এ সময় উপস্থিত শিক্ষকদের চোখও অশ্রুসজল ছিল।
মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাওলানা মো. হুসাইন বলেন, সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসা থেকে এবার আলিম পরীক্ষায় নুসরাতসহ ১৭৫ শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে। এদের মধ্যে ১৫২ জন পাস করে। এ মাদ্রাসায় এবার পাসের হার ৮৬.৮৬ শতাংশ। নিহত নুসরাতসহ ২৭ জন ফেল করে।
ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাওলানা মো. হুসাইন আরো বলেন, নুসরাত জাহান রাফি মেধাবী ছাত্রী ছিল। দুই বিষয়ে পরীক্ষা দেয় নুসরাত। সব পরীক্ষা দিতে পারলে নুসরাত ভালো ফল করতো।
ফলাফল জানতে আসা নুসরাতের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী নিশাত সুলতানা, সহপাঠী তামান্না, নাসরিন সুলতানা জানায়, আমাদের সঙ্গে আজ নুসরাতেরও পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে। আমাদের মতো তারও আনন্দিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নুসরাত আমাদের মাঝে নেই। আমরা কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হলেও কোনো সহপাঠীর মধ্যে আনন্দ নেই।
এদিকে আলিম পরীক্ষার ফল প্রকাশের খবর পাওয়ার পর থেকে কান্না থামছে না নুসরাতের স্বজনদের। নুসরাতের মা শিরিনা আক্তার কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমাদের পরিবারে আজ আনন্দ-উৎসবে ভরে যেত। কিন্তু আমার মেয়ে সবগুলো পরীক্ষা দিতে পারে নি। আমার মেয়ে দুনিয়ার পরীক্ষায় পাস করতে না পারলেও আখেরাতের পরীক্ষায় পাস করবে’।
নুসরাতের বড় ভাই ও মামলার বাদী মাহমুদুল হাসান নোমান বলেন, আমার বোন খুব মেধাবী ছিল। ২৭শে মার্চের শ্লীলতাহানির ঘটনার পর আমরা তাকে পরীক্ষা দিতে নিরুৎসাহিত করেছিলাম। কিন্তু সে পরীক্ষায় অংশ নিতে চায়। আমি নিজে তাকে পরীক্ষা হলে নিয়ে যেতাম। ১ ও ২রা এপ্রিল দুটি পরীক্ষায় অংশও নেয় সে। পরে ৬ই এপ্রিল পরীক্ষা দিতে গেলে তাকে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়। নোমান আরো বলেন, বুধবার সকাল থেকে পরিবারে সবাই খুব হতাশ। নুসরাতের বেশ কয়েকজন সহপাঠী ফোন করে তাদের রেজাল্টের খবর জানায়। এ সময় ওরা নুসরাতের কথা বলে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
প্রসঙ্গত, চলতি বছরের ২৭শে মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ (সাবেক) সিরাজ-উদ-দৌলা নুসরাত জাহান রাফিকে নিজ কক্ষে ডেকে নিয়ে যৌন নিপীড়ন করেন। ওই ঘটনার পর ওই দিন নুসরাতের মা শিরিন আক্তার বাদী হয়ে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন। ওই দিনই অধ্যক্ষকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এর জের ধরে অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ- দৌলার সহযোগীরা নানাভাবে নুসরাতের পরিবারকে মামলা তুলে নিতে চাপ দেয়। তারা মামলা তুলে নিতে অস্বীকৃতি জানালে ৬ই এপ্রিল নুসরাত পরীক্ষা দিতে গেলে কৌশলে তাকে মাদ্রাসার সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে নিয়ে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয় অধ্যক্ষের অনুসারীরা। অগ্নিদগ্ধ নুসরাতকে উদ্ধার করে প্রথমে সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও পরে ফেনী জেলা সদর হাসপাতালে নিলে অবস্থার অবনতি হওয়ায় ওই দিনই তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। ৫ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে গত ১০ই এপ্রিল রাতে নুসরাত মারা যায়।