‘ঐতিহ্য সংরক্ষণ’ না ‘হাসপাতাল’- এই বিতর্কের মধ্যেই ভেঙে ফেলা হচ্ছে সিলেটের শতবর্ষী আবু সিনা ছাত্রাবাস। গত তিন দিন ধরে শ্রমিক নিয়োগ করে এই ছাত্রাবাস ভেঙে ফেলার দৃশ্য দেখে ক্ষুব্ধ হয়েছে ঐতিহ্য সংরক্ষণ পরিষদের নেতারা। গতকাল তারা এ নিয়ে সিলেটের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে উন্মুক্ত সংবাদ সম্মেলন করেছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন- আবু সিনা ছাত্রাবাসের কিছু অংশ সংরক্ষণ করে জেলা হাসপাতাল নির্মাণের অংশ হিসেবে এই ভাঙার কাজ শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে ঠিকাদারও নিয়োগ দেয়া হয়েছে। সিলেটের আবু সিনা ছাত্রাবাস। শতবর্ষী একটি স্থাপনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষী এটি।
এটি দীর্ঘ দিন ধরে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাস হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদের শেষ দিকে আবু সিনা ছাত্রাবাসের স্থলে সিলেট জেলা হাসপাতাল নির্মানের উদ্যোগ নেয়া হয়। সিলেট সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের সঙ্গে এ হাসপাতালেরও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। কয়েক মাস আগে হাসপাতাল নির্মাণের লক্ষ্যে যখন শতবর্ষী ভবন ভাঙার কাজ শুরু হয় তখন এতে সিলেটের ঐতিহ্য সংরক্ষণে ঐক্যবদ্ধ নাগরিক সমাজ প্রতিবাদ জানায়। তাদের দাবি- আবু সিনা ছাত্রাবাস শতবর্ষী প্রতিষ্ঠান। এটিকে সংরক্ষণ করে জেলা হাসপাতাল অন্যত্র স্থানান্তর করা হোক। তাদের দাবির মুখে ভাঙার কাজ প্রায় তিন মাস বন্ধ ছিলো। কিন্তু গত মঙ্গলবার আবার ভাঙার কাজ শুরু হয়েছে। গণপূর্ত বিভাগের নিয়োজিত ঠিকাদার ছাত্রাবাস ভবনের টিনের চাল খোলার কাজ শুরু করতে দেখা যায়। তথ্য মতে- ১৮৫০ সালে সিলেট নগরের কেন্দ্র্রস্থলে ইউরোপিয়ান মিশনারিরা এই ভবনের প্রথম-পর্বের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। প্রায় তিন একর জায়গাজুড়ে প্রতিষ্ঠিত এই ভবন আসাম ও বৃটিশ স্থাপত্যরীতির নান্দনিক স্থাপনা। এর সাথে দুইটি বিশ্বযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের বুদ্ধিজীবী হত্যার স্মৃতিজড়িত। পুরাতন মেডিকেল ভবন বা ‘আবুসিনা ছাত্রাবাস ভবন’ নামে পরিচিত এই ভবনটি এ অঞ্চলের শত বছরের ইতিহাস ঐতিহ্যের স্মারক। সিলেট ভূকম্পপ্রবণ এলাকা হওয়ায় ১৮৬৯ ও ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে হাজার বছরের পুরনো বিভিন্ন শাসনামালের প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনাগুলো ধ্বংস হয়। টিকে থাকা হাতগোনা কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনও বিনষ্ট হতে চলেছে। দ্বিতীয় দফা কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে ক্ষোভ বেড়েছে। গত বুধবার আবু সিনা ছাত্রাবাস ভেঙে ফেলার প্রতিবাদে নগরীতে বিক্ষোভ সমাবেশ করা হয়েছে। আর গতকাল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে উন্মুক্ত সংবাদ সম্মেলন করে তারা। এতে জানানো হয়- কোনরূপ গণশুনানি ব্যতীত গোপনীয়ভাবেই আদি-স্থাপত্যের এই ভবনটি ভেঙে সিলেট জেলা হাসপাতালের জন্য ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট ১৫তলা ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ২০১৮ সালের ৩০শে জানুয়ারি সিলেটে ১৯টি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। সেখানে ২৫০ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণের কথা উল্লেখ ছিল। কিন্তু কোথাও উল্লেখ করা হয়নি শতবর্ষী ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা আবু সিনা ভবন ভেঙে এখানেই হাসপাতাল নির্মাণ করা হচ্ছে। তাই ভবনটি ভেঙ্গে হাসপাতাল নির্মাণের পদক্ষেপ অবিলম্বে বন্ধ করার দাবিতে সিলেটে প্রতিবাদ শুরু হয়। ২২শে মার্চ সংবাদপত্রে প্রেরিত এক বিবৃতিতে দেশ ও দেশের বাইরে থাকা প্রতিনিধিত্বশীল একশ জন নাগরিক আবু সিনা ছাত্রাবাস ভবন সংরক্ষণের চলমান আন্দোলনের সাথে একাত্মতা পোষণ করে নগরের কেন্দ্রস্থলে থাকা বৃটিশ ও আসাম স্থাপত্যরীতির এই ঐতিহাসিক ভবন সংরক্ষণ ও সংস্কার করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। ২৩শে মার্চ সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত সাহেবের সাথে আমাদের নেতৃবৃন্দ সাক্ষাৎ করেন। তাঁর আমলেই এই হাসপাতালটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। সাক্ষাৎকালে আমাদের নেতৃবৃন্দ ভবনটি রক্ষার জন্য উদ্যোগ নিতে তাকে অনুরোধ জানালে তিনি জানান, ভবনটি প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে বলে তিনি শুনেছেন। ২৪শে মার্চ তিনি ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা আবুসিনা ছাত্রাবাস ভবন পরিদর্শনে আসেন। পরিদর্শনের পর মতবিনিময়কালে আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেন, ভবনটি ভাঙ্গা ঠিক হবে না। এটি সংরক্ষণ করা উচিৎ। এ সময় আন্দোলনকারিদের পক্ষে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন, সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম ভবনটি সংরক্ষণ করে এই স্থানে জাদুঘর করার প্রস্তাব দেন। সংবাদ সম্মেলনে তারা জানান- সাবেক অর্থমন্ত্রী ও সরকারের অন্যতম নীতি নির্ধারক হিসাবে পরিচিত আবুল মাল আব্দুল মুহিত আবু সিনা ভবন সংরক্ষণে একমত হওয়ার পর থেকেই পর্দার আড়ালে খেলা শুরু করে সিলেট বিরোধী, ইতিহাস বিরোধী, ঐতিহ্য বিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের স্মারক সংরক্ষণ বিরোধী, পরিকল্পিত নগরায়ন বিরোধী অপশক্তি। এরা দেশ চলমান লুটপাটেরধারা অব্যাহত রাখতে মরিয়া হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে ‘উন্নয়ন না প্রসাধন’, ‘হাসপাতাল না জাদুঘর’ ইত্যাদি প্রশ্ন তোলে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের পাশাপাশি একটি যৌক্তিক আন্দোলনকে ‘হাসপাতাল নির্মাণ বিরোধী আন্দোলন’ বলার জন্য অতি উৎসাহী নিয়ে কিছু নব্য চাটুকার মাঠে নামে। এদের সম্মিলিত অপতৎপরতার জবাবে ৭ই এপ্রিল মুসলিম সাহিত্য সংসদে ‘ঐতিহ্যবাহী শতবর্ষী স্থাপত্য আবু সিনা ছাত্রাবাস ভবন সংরক্ষণ ও পরিকল্পিত নগর উন্নয়ন’ বিষয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের সাথে মত বিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। এ অবস্থায় ঐতিহ্যবাহী আবু সিনা ছাত্রাবাস ভবন সংরক্ষণ ও সংস্কারের দাবিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর স্মারকলিপি দেয়া হয়। ৩০শে এপ্রিল সিলেট কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে প্রতিবাদী অবস্থান কর্মসূচিতে দেশ বরেন্য ব্যক্তিরা উপস্থিত হয়ে ভবন রক্ষার পক্ষে বক্তব্য রাখেন। সংবাদ সম্মেলনে তারা জানান- এর বাইরেও নানা প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করা হয়। দুর্ভাগ্যের বিষয় সিলেটবাসীর আবেগ অনুভূতির তোয়াক্কা না করে একগুঁয়েমি সিদ্ধান্তে শত বছরের প্রাচীন এই ঐতিহ্যবাহী ভবন ভেঙে ফেলার কাজ শুরু করা হয়েছে। আমরা গতকাল বিক্ষোভ সমাবেশ শেষে মিছিল সহকারে ভবনটির অবস্থা দেখে এসেছি। পুরো বিষয়টি দুঃখজনক। এই ভবন ধ্বংস ইতিহাসের একটি কালো অধ্যায় বলে বিবেচিত হবে। লিখিত বক্তব্য রাখেন, বাপার সিলেট জেলার সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কীম। এছাড়া অনুষ্ঠানে প্রবীন রাজনীতিবিদ ব্যারিস্টার আরশ আলী, সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ইইউ শহীদুল ইসলাম শাহীন, রাজনীতিবিদ জাকির হোসেন, ধীরেন সিংহ সহ পেশাজীবী সংগঠনের নেতারা বক্তব্য রাখেন।