× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার , ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৬ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

এক সিগন্যালেই ৬৭ মিনিট

এক্সক্লুসিভ

শামীমুল হক
২২ জুলাই ২০১৯, সোমবার

গাড়ির স্টার্ট বন্ধ। নেই ভেঁপুর আওয়াজ। ঠায় দাঁড়িয়ে আছে গাড়ি। রেড সিগন্যাল। এক মিনিট, দুই মিনিট করে দশ মিনিট চলে গেছে। গ্রিন সিগন্যাল এসেছে। কিন্তু গাড়ি চলছে না। এবার যাত্রীরা নড়েচড়ে বসেছে।
বাইরে প্রচণ্ড গরম। ভেতরের মানুষগুলো ঘামে ভিজছে। এভাবে কেটেছে আরো ১২ মিনিট। আস্তে আস্তে একজন একজন করে নেমে হাঁটা দিচ্ছেন গন্তব্যে। এ চিত্র রাজধানীর একমাত্র ভিআইপি রোড বলে খ্যাত শেরাটন সিগন্যালের। মতিঝিল থেকে ছেড়ে আসা ওয়েলকাম গাড়ির যাত্রী রুবেল বললেন, এটি ভয়ঙ্কর সিগন্যাল। ভিআইপি রোডে চলাচলকারী গাড়ি ও যাত্রীদের কাছে এ সিগন্যাল এক আতঙ্ক। এক বসায় ৬৭ মিনিট পার। এরপর গাড়ি স্টার্ট নিলো ফের। কিছু নতুন যাত্রী দৌড়ে গাড়িতে উঠলেন। কিন্তু কপাল খারাপ। তিন চার কদম যাওয়ার পর আবার রেড সিগন্যাল। তবে এবার মাত্র ১১ মিনিট।

গাড়ি চলছে। অনেক কষ্টে সিগন্যাল পেরিয়েছে। হলে কি হবে? পরীবাগ এসে ফের বাংলামোটরের সিগন্যালে আটকা পড়েছে গাড়ি। কাছের যাত্রীরা নেমে গেলেও দূরের যাত্রীদের জন্য বিপদ। নানা মন্তব্য গাড়ি জুড়ে। কেউ ট্রাফিক পুলিশকে গালমন্দ করছেন। কেউবা দুষছেন নিয়ম শৃঙ্খলাকে। গতকাল রোববার সপ্তাহের প্রথম দিন বলে এমন হয়েছে? না এমনটা প্রতিদিনের। এ রোড এড়িয়ে চলারও উপায় নেই। শেরাটন সিগন্যালের এ জট গিয়ে ঠেকেছে গুলিস্তান পর্যন্ত। ফলে একেবারে কলাপস গুলিস্তান টু ফার্মগেট। শেরাটন সিগন্যালে দায়িত্বরত একজন ট্রাফিক সার্জেন্ট বলেন, কি করবো বলুন?  গাড়ি ছাড়লে যাবে কোথায়? সামনেওতো জ্যাম। বাংলামোটরের সিগন্যাল ছাড়লে সামনের রাস্তা ফাঁকা হবে। তারপর এখানকার সিগন্যাল ছাড়া হবে। কিন্তু এখানে দুদিক থেকে গাড়ি ছাড়তে হয়। কাকরাইল মসজিদ হয়ে আসা রোডে অফিস ছুটির পর আসেন ভিআইপিরা। ফলে এ সড়ককে গুরুত্ব দিতে হয়। এ ছাড়া এখন প্রতিটি সিগন্যালই ছাড়া না ছাড়া নির্ভর করে পরবর্তী সিগন্যালের ওপর। পরবর্তী সিগন্যাল ছাড়লেই কেবল সামনের রাস্তা ফাঁকা হয়। তিনি বলেন, মেট্রোরেলের কাজ চলায় ফার্মগেট থেকে শাহবাগ পর্যন্ত মাঝ রাস্তা বন্ধ। দু’পাশে সরু রাস্তা হওয়ায় যানজট বেড়ে গেছে। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি।

ওদিকে পুরানা পল্টন থেকে প্রেস ক্লাব পর্যন্ত রাস্তাও সরু। শত শত যাত্রী গাড়ি ভাড়া দিয়েও মাঝপথে নেমে হেঁটে যাচ্ছেন গন্তব্যে। প্রেস ক্লাবের সামনে নেমে হাঁটতে হাঁটতে  এগুচ্ছেন আমজাদ হোসেন নামে একজন চাকরিজীবী। তিনি পল্টন থেকে গাড়িতে উঠেছিলেন। চোখে দেখা পল্টন থেকে প্রেস ক্লাব আসতে সময় লেগেছে ২১ মিনিট। তিনি বলেন, আর কত বসে থাকব? এর চেয়ে হেঁটে গেলে অনেক আগে যেতে পারবো। আমজাদের কথা- এটা আমাদের নিয়তি। মাসে এক বা দুই দিন গাড়িতে যেতে পারি। না হয়, পল্টন থেকে হেঁটেই তেজকুনি পাড়া যাই। কারণ হেঁটে গেলে ঘণ্টাখানেক সময় লাগে। কিন্তু গাড়িতে গেলে কখনো আড়াইঘণ্টা। কখনো তিন ঘণ্টা। মৎস্য ভবন মোড় থেকে ফুটপাত ধরে হাঁটছেন মানুষ আর মানুষ। যেন কোনো মিছিল। শাহবাগ পর্যন্ত কোনো রকমে হেঁটে আসতে পারলেও, এরপর শুরু হয় যন্ত্রণা। ফুটপাতেও স্বাচ্ছন্দ্যে হাঁটার উপায় নেই। সেখানে মানুষের জট। সবার এক কথা- আর পারছি না। রাজধানী এখন বসবাসের অযোগ্য হয়ে গেছে। কিন্তু আমরা যাবো কোথায়? রুটি, রুজি সবইতো রাজধানীকে ঘিরে। মোহাম্মদ ফয়সাল নামের এক শিক্ষার্থী সপ্তাহে চারদিন ফার্মগেট আসেন কোচিং করতে। ফয়সাল একটি মেডিকেল কোচিংয়ে ভর্তি হয়েছেন। ফয়সাল বলেন, ১২টায় ক্লাস শুরু। বাসা থেকে বের হই সকাল সাড়ে ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে। মাঝে মাঝে যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের মাঝ থেকে শুরু হয় যানজট। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বাস থেকে নেমে হাঁটতে থাকি।

গুলিস্তান হলের সামনে এসে আবার গাড়িতে ওঠি। কোনো রকমে শাহবাগ পর্যন্ত এসে বাস থেকে আবার নেমে পড়ি। প্রায় প্রতিদিনই শাহবাগ থেকে হেঁটে ফার্মগেট যাই। কোনো দিন ক্লাসে সময়মতো পোঁছাই। আবার কোনোদিন ১০ মিনিট কোনো দিন ২০ মিনিট লেট হয়। কি করবো বলুন? মা-বাবা আশা নিয়ে কোচিংয়ে ভর্তি করিয়েছেন। আমরাও চেষ্টা করছি। কিন্তু শনির আখড়া থেকে ফার্মগেট আধা ঘণ্টার রাস্তা আড়াই ঘণ্টায়ও পৌঁছাতে পারি না। এরপর যানজট পেরিয়ে বাসায় ফিরতে পাঁচটা বেজে যায়। শরীর হয়ে পড়ে কাহিল। তখন আর পড়ার ইচ্ছা হয় না। মাসুদুর রহমান নামের এক বৃদ্ধ বলেন, মিরপুরে থাকি। ছেলের কাপড়ের দোকান আছে। গুলিস্তান থেকে আমি কাপড় আনতে গিয়েছিলাম সকাল ১০টায়। কাপড় নিয়ে গাড়িতে উঠেছি বেলা ১টায়। এখন বাজে প্রায় চারটা। এখনও ফার্মগেট পেরুতে পারিনি। সন্ধ্যা হয়ে যাবে পৌঁছাতে। কি করবো বলুন? মিরপুর থেকে সকালে গুলিস্তান গিয়ে ফিরতে হয় সন্ধ্যায়। পুরো দিনটিই মাটি। সিএনজি চালক কবির বলেন, এখন আর শাহবাগ রাস্তা দিয়ে যেতে চাই না। অন্যকোনো রাস্তা হলে যাত্রী নেই। শাহবাগ রাস্তা মানে অনিশ্চিত যাত্রা। এতো গেলো লোকাল বাসের যাত্রীদের কথা। যারা প্রাইভেট গাড়ি নিয়ে চলাফেরা করেন তাদের জন্য আরো ভয়াবহ এ ভিআইপি সড়ক। কারণ তারা গাড়ি ছেড়ে নামতেও পারেন না। আবার গাড়ি সিগন্যালে থাকায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়িতেই বসে থাকতে হচ্ছে। এক ট্রাভল এজেন্সির মালিক জুমান চৌধুরী বলেন, আমি এখন আর গাড়ি নিয়ে বের হই না। কোথাও যেতে হলে রিকশা কিংবা সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে যাই। এতে আমার সময়ও বাঁচে। সঠিক সময়ে কাজও সারতে পারি। বাংলামোটর ফ্লাইওভার থেকে নেমে গাড়িগুলোকে সিগন্যাল পেরুতে স্বাভাবিকভাবে আধাঘণ্টা থেকে চল্লিশ মিনিট সময় লাগে। লাব্বাইক গাড়ির চালক মজনু বলেন, কোনো দিনও এক সিগন্যালে বাংলামোটর মোড় পেরুতে পারিনি। কখনো তিনটি সিগন্যাল, কখনো চারটি সিগন্যাল আটকে থাকতে হয়। ওদিকে সোনারগাঁও হোটেলের সামনের ফ্লাইওভারেও একই অবস্থা।

সবমিলিয়ে যানজটে কাবু রাজধানীবাসী। এ থেকে শিগগিরই পরিত্রাণের কোনো উপায়ও নেই।  রাজধানীতে আগেও যানজট ছিল। এখনও আছে। এ যানজট নিরসনে নানা সময় বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বানানো হয়েছে ফ্লাইওভারও। কিন্তু যানজট নিরসন হয়নি। বরং মগবাজার ফ্লাইওভারে মাঝে মাঝে দেখা যায় তিনতলা যানজট। এখন আর মানুষ নির্দিষ্ট সময় নিয়ে কোথাও যাবে এর নিশ্চয়তা দিতে পারে না। তাই যানজটকে নিয়তি মেনেই চলতে হচ্ছে সবাইকে।     
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর