শুধু এনআইডি জালিয়াতি নয়, দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যে রোহিঙ্গাদের পাচারও করতো চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন অফিসের ডবলমুরিং থানার অফিস সহকারী আটক জয়নাল আবেদীন। এ কাজে খুব অল্প সময়ে শূন্য থেকে কোটিপতি বনে যান জয়নাল।
বর্তমানে চট্টগ্রামের বাঁশখালী পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের আসকরিয়া পাড়ায় টিনশেড পাকা বাড়ি ছাড়াও বর্তমানে আসকরিয়া শাহ মাজারের দক্ষিণে নতুন সাড়ে তিন গণ্ডা জমির উপর তৈরি করা হচ্ছে ছয় তলার বিশাল অট্টালিকা ভবন।
ইতিমধ্যেই চারতলা ভবনের নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। বাঁশখালী পৌরসভায় রয়েছে ক্রয় করা জমি। তার রয়েছে বিভিন্ন ব্যাংকে নামে-বেনামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট। রাতারাতি এত সম্পদের মালিক হয়ে যাওয়ায় জয়নাল আবেদীনকে নিয়ে স্থানীয় জনমনে নানা কৌতূহলের সৃষ্টি হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে আলাপ করে এসব তথ্য জানা গেছে। এ বিষয়ে সত্যতাও স্বীকার করেছেন চট্টগ্রামের বাঁশখালী পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. হারুন।
তিনি বলেন, জয়নাল আবেদীন বাঁশখালী পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মোনাফ মাঝির ছেলে। মোনাফ মাঝি খুবই দরিদ্র ছিল। ২০ বছর আগে তিনকড়া জমির উপর শুধু বসতভিটাই ছিল তাদের। অর্থের অভাবের কারণে ছেলে সন্তানদের লেখাপড়া করাতে পারেননি তিনি। তবে আত্মীয়ের মাধ্যমে চট্টগ্রাম নির্বাচন অফিসে পিয়নের চাকরি হয় জয়নালের। সেই থেকে ফুলে ফেঁপে উঠে জয়নাল। ৭ নম্বর ওয়ার্ডের আসকারিয়াপাড়ায় নতুন বাড়ি করেন তিনি। ভোটার আইডি কার্ডে নাম সংশোধন করা মো. মোস্তফা আলী নামে একজনের সঙ্গে জয়নাল আবেদীনের সুসমপর্কের কারণে একই স্থানে দুজনে মিলে একই মালিক থেকে সাড়ে ৮ গণ্ডা জমি ক্রয় করেন।
সীমানাঘেরা জায়গার পাশেই জয়নাল আবেদীন গত দু’মাসে মাটি পরীক্ষা করে পাইলিংয়ের মাধ্যমে ছয়তলা ভবনের চারতলার কাজ সমপন্ন করেন। শ্রমিকরা দিনে রাতেই নির্মাণ কাজ করছেন। ওই বাড়িতে রোহিঙ্গাদের এনে রাখতো জয়নাল। সেখান থেকে দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাচারও করতো সে।
জয়নালের আরেক ভাই থাকেন দুবাইয়ে। সে এক সময় বাবুর্চির কাজ করতো সেখানে। জালিয়াতির মাধ্যমে এনআইডি দেয়া রোহিঙ্গাদের সে নিজের বাড়িতে রেখে দুবাইয়ে তার ভাইয়ের কাছে পাঠাতো। যা মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে করতো সে। ফলে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয়া ও পাচারের বিষয়টিও এলাকায় প্রচার পেয়েছে ব্যাপকভাবে।
কাউন্সিলর হারুন জানান, গত ছয় মাসে আত্মীয়স্বজন ও ভিন্ন ভিন্ন নামে বাঁশখালীর জলদীসহ বিভিন্ন স্থানে অনেক জায়গা ক্রয় করেছে জয়নাল। যে বাড়িটি তৈরি হয়েছে সবকিছু মিলে অন্তত ৬০-৭০ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। জলদীতে তার ক্রয় করা জমি ছাড়াও বিভিন্ন স্থানে কোটি টাকার জমি রয়েছে।
এ ছাড়াও বিভিন্ন ব্যাংকে ভিন্ন ভিন্ন নামে টাকা রয়েছে। তার এই অবৈধ সমপদ দেখভালের জন্য রাখা হয়েছে বাহাদুর নামের একজন লোকও। যাকে গ্রেপ্তার করলে তার সম্পদের হিসাব পাওয়া যাবে।
জানা যায়, ১৪ বছর আগে অফিস সহকারী (পিয়ন) হিসেবে চট্টগ্রাম নির্বাচন কার্যালয়ে যোগদান করেন জয়নাল আবেদীন। বর্তমানে সে ডবলমুরিং থানার নির্বাচন কার্যালয়ে অফিস সহকারী হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তবে রোহিঙ্গাদের এনআইডি তৈরির কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে গত সোমবার দিনগত রাত ১১টার দিকে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ সময় তার আরো দুই সহযোগীকেও গ্রেপ্তার করা হয়।
এ ঘটনায় চট্টগ্রাম নগরীর কোতোয়ালি থানায় আটক জয়নাল ও দুই সহযোগীসহ মোট ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
কোতোয়ালি থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন বলেন, ২০১৫ সালে চট্টগ্রাম নির্বাচন কার্যালয় থেকে একটি ল্যাপটপ হারিয়ে যায়। হারিয়ে যাওয়া ওই ল্যাপটপ থেকে রোহিঙ্গাদের ভোটার করতে সহায়তা করেন জয়নুলসহ অন্যরা।
এই ল্যাপটপ হারিয়ে যাওয়ার বিষয় নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হলেই জালিয়াতির মাধ্যমে রোহিঙ্গা ভোটার করার রহস্য উন্মোচন হয়। এর আগে রোহিঙ্গা ডাকাত নুর মোহাম্মদ ওরফে নুর আলম, লাকি আক্তারসহ বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গার হাতে এনআইডি ও পাসপোর্ট পাওয়া নিয়ে তোলপাড় শুরু হয় পুলিশ প্রশাসন, দুদক ও নির্বাচন কমিশনে। যা তদন্ত করতে গিয়ে এনআইডি জালিয়াতির ঘটনায় জয়নাল আবেদীন চক্রের জড়িত থাকার বিষয়টি উঠে আসে।
ওসি মোহাম্মদ মহসীন আরো বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে জয়নাল আবেদীন তার অবৈধ সম্পদের হিসাব দিয়েছেন। এ ছাড়া তার সঙ্গে নির্বাচন অফিসের আর কারা কারা এনআইডি জালিয়াতিতে জড়িত ছিল তাদের বিষয়েও চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন।