বিশ্বজমিন

সিরিয়ায় কুর্দিদের বিরুদ্ধে হামলা চালাচ্ছে কেন তুরস্ক?

মানবজমিন ডেস্ক

২০১৯-১০-১১

বুধবার (০৯ অক্টোবর) সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত কুর্দিদের বিরুদ্ধে বহুল প্রতীক্ষিত একটি সামরিক অভিযান চালু করেছে তুরস্ক। অভিযানে তুর্কি বাহিনীর মূল লক্ষ্য, ওই অঞ্চল কুর্দি-নেতৃত্বাধীন মিলিশিয়ামুক্ত করা। এছাড়া তুরস্কে অবস্থানরত ৩৬ লাখ শরণার্থীর জন্য বাসস্থান নির্মাণ করা। তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়্যিপ এরদোগান জানান, অঞ্চলটিকে একটি সন্ত্রাসী করিডোর হওয়া থেকে রক্ষা করতে কুর্দিদের বিরুদ্ধে এই অভিযান চালাচ্ছেন তিনি। তার এই অভিযান বিশ্বজুড়ে আলোচনার শীর্ষে চলে এসেছে। নানা কারণে সমালোচিত হচ্ছে অভিযানটি। ইইউ, ন্যাটো, আরব লীগ, যুক্তরাষ্ট্র, সিরিয়া সহ বিশ্বজুড়ে নেতারা এই অভিযানের সমালোচনা করছেন।
তুরস্ক সরকার ও কুর্দিদের মধ্যকার বিবাদ বেশ পুরনো। এর শেকড় ছড়িয়ে আছে আঞ্চলিক ক্ষমতা বলয়ের এক জটিল জালে। যেই জালে জড়িয়ে রয়েছে আঞ্চলিক ও বিশ্ব শক্তিদের অনেকের স্বার্থ। পুরো পরিস্থিতিটি আরো জটিল আকার ধারণ করেছে এজন্য যে, তুরস্ক ও কুর্দি-নেতৃত্বাধীন মিলিশিয়া উভয় পক্ষই যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হিসেবে পরিচিত।  এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন ওঠেছে, অন্য একটি দেশে কুর্দিদের বিরুদ্ধে তুরস্ক কেন এই অভিযান চালাচ্ছে ও এর গুরুত্ব কী? তা বুঝতে তুরস্ক ও কুর্দিদের অতীত সম্পর্ক ঘেঁটে দেখতে হবে।
কুর্দিরা কারা?
কুর্দি সম্প্রদায় হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের চতুর্থ বৃহত্তম জাতগোষ্ঠী। সংখ্যায় বড় হলেও তাদের বেশিরভাগই রাষ্ট্রহীন বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হিসেবে বসবাস করছে। তাদের জন্মভূমি ছড়িয়ে আছে তুরস্ক, ইরাক, সিরিয়া, ইরান ও আর্মেনিয়াজুড়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ও অটোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটার পর বহু সংখ্যক কুর্দিরা একটি স্বাধীন কুর্দি-রাষ্ট্র গঠনের দাবি জানায়। প্রথমদিকে তাদের একটি রাষ্ট্র দেয়ার প্রতিশ্রুতি করেন তৎকালীন নেতারা। কিন্তু সময়ের আবর্তে পুরো অঞ্চলটি বিভিন্ন ভাগে ভাগ হয়ে গেলেও, আজও প্রতিশ্রুত রাষ্ট্র পায়নি কুর্দিরা। প্রথম আন্দোলনের পর আরো বহুবার রাষ্ট্র গঠনের দাবি বাস্তবায়নে চেষ্টা চালিয়েছিল তারা। কিন্তু সেসব চেষ্টা মূলত নস্যাৎ করে দেয়া হয়।
তুরস্কের চোখে কুর্দিরা কেমন?
তুরস্ক ও রাষ্ট্রহীন কুর্দিদের মধ্যকার সম্পর্কের ইতিহাস মূলত বিরোধে ভরা। দক্ষিণাঞ্চলে সীমান্ত-বেষ্টনীর ওপারে প্রতিনিয়ত শক্তিশালী হতে থাকা কুর্দি বাহিনীগুলোকে হুমকি হিসেবে দেখে তুরস্ক। বেশ কয়েক বছর ধরেই সীমান্ত ছাড়িয়ে সিরিয়ায় কুর্দিদের বিরুদ্ধে হামলা চালানোর পরিকল্পনা করে আসছেন এরদোগান। এর পেছনে লুকিয়ে রয়েছে কুর্দি ও তুরস্ক সরকারের মধ্যে প্রায় ৪০ বছর ধরে চলা ঘরোয়া দ্বন্দ্ব।
গত শতকের আশির দশক থেকে কুর্দিস্তান ওয়ার্কার’স পার্টি (পিকেকে) এর সঙ্গে তুর্কি সরকার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে আছে। সেসময় থেকে তুরস্কে সহিংস বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন শুরু করে পিকেকে। তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই পিকেকে’কে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে ঘোষিত করেছে। অপরদিকে সীমান্তের ওপারে সিরিয়ায় ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে ওঠেছে ওয়াইপিজি ও তাদের সহযোগী কুর্দি মিলিশিয়ারা। ২০০৪ সাল থেকেই সেখানে সক্রিয় রয়েছে এই মিলিশিয়ারা। তারাও বহুদিন ধরে কুর্দিদের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু আইএস ও অন্যান্য ইসলামী চরমপন্থি দলগুলোর বিরোধীতা করায় পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন রয়েছে তাদের প্রতি। সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের আইএস-বিরোধী অভিযানে মার্কিন সেনাদের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করেছে কুর্দি যোদ্ধারা। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে উত্তরাঞ্চলে একটি শান্তিপূর্ণ উপত্যকাও প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল তারা। উপত্যকাটির নাম দিয়েছিল রোজাভা। ধীরে ধীরে অন্যান্য আঞ্চলিক দলও তাদের সঙ্গে যোগ দেয় ও এক পর্যায়ে এসডিএফ গঠিত হয়। সিরিয়া থেকে আইএস দূরীকরণে এসডিএফ মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। সিরিয়াকে আইএস মুক্ত করার এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে ওঠে কুর্দিরা। তাদের এই শক্তি এরদোগানের জন্য চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কী?
কুর্দিদের বিরুদ্ধে তুরস্কের অভিযানে দুই পক্ষের মাঝে আটকে আছে যুক্তরাষ্ট্রের নাম। অভিযান শুরুর কয়েকদিন আগে ট্রাম্পের সঙ্গে এক ফোনালাপ করেন এরদোগান। এর পরপরই সিরীয় অঞ্চলটি থেকে মার্কিন সেনাদের প্রত্যাহার করে নেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্ক উভয়ই ন্যাটো সদস্য। ঘনিষ্ঠ মিত্রদেশ হিসেবেই পরিচিত দেশ দুটি। অন্যদিকে, কুর্দিদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রতাও বেশ পুরনো রয়েছে। কুর্দি-নেতৃত্বাধীন জোট বাহিনী সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্স (এসডিএফ), ট্রাম্পের সেনা প্রত্যাহারকে ‘পেছন থেকে ছুরি মারা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। অঞ্চলটিতে জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র বাহিনী ছিল এসডিএফ। সমালোচনার মুখে ট্রাম্প তুরস্ককে হুমকি দিয়েছেন, কুর্দিদের বিরুদ্ধে অভিযানে সীমা ছাড়ালে তুরস্কের অর্থনীতি ধ্বংস করে দেবে যুক্তরাষ্ট্র। অভিযান শুরুর পরে দুই পক্ষের মধ্যে মধ্যস্ততার প্রস্তাবও দিয়েছেন তিনি।
এই অভিযানের সুবিধা পেতে পারে আইএস?
সিরিয়ায় তুরস্কের এই অভিযানের সবচেয়ে অনাকাক্সিক্ষত পরিণতি হতে পারে, আইএসের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া। সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে কয়েক হাজার আইএস বন্দিদের দেখাশোনা করে থাকে কুর্দি-নেতৃত্বাধীন মিলিশিয়ারা। তুরস্কের অভিযানে ওইসব জঙ্গিদের বন্দিত্ব ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। এছাড়া, সিরিয়ায় আইএস’র স্বঘোষিত খিলাফতের পতন ঘটলেও দেশটির নিরাপত্তা পরিস্থিতি এখনো নাজুক। অনেকে আশঙ্কা করছেন, সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলের তুরস্কের এই সামরিক অভিযানে সৃষ্ট অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সুযোগে ফের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠবে আইএস। সেখানে এখনো বিচ্ছিন্নভাবে সক্রিয় রয়েছে আইএস। (নিউ ইয়র্ক টাইমস অবলম্বনে)
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status